অস্ত্র নয় কলম হাতে যুদ্ধ করে শহীদ হন সাংবাদিক মোহাম্মদ আলী

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে চুয়াডাঙ্গা প্রেসক্লাব আয়োজিত স্মরণসভায় বক্তারা

 

স্টাফ রিপোর্টার: চুয়াডাঙ্গা প্রেসক্লাব আয়োজিত স্মরণসভায় শহীদ সাংবাদিক মোহাম্মদ আলীর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়লেন প্রেসক্লাব নেতৃবৃন্দসহ উপস্থিত সাংবাদিকরা। বক্তারা বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় সাংবাদিক মোহাম্মদ আলীকে পাকহানাদার বাহিনী ধরে নিয়ে নির্মমভাবে নির্যাতনের পর দর্শনায় নিয়ে হত্যা করে। তার মৃতদেহটিও পাওয়া যায়নি। চুয়াডাঙ্গার একজন সাংবাদিক মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কলম ধরে শহীদ হয়েছেন। এটা একদিকে যেমন গর্বের তেমনই বেদনার। তিনি অস্ত্র নয় কলম ধরে শহীদ হয়েছেন।

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে চুয়াডাঙ্গা প্রেসক্লাব মিলনায়তনে স্মরণসভার অয়োজন করা হয়। প্রেসক্লাব সভাপতি প্রবীণ সাংবাদিক মাহতাব উদ্দীনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত স্মরণসভা সঞ্চালনে ছিলেন সাধারণ সম্পাদক সরদার আল আমিন। বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতি চুয়াডাঙ্গা জেলা ইউনিট সভাপতি অ্যাড. শরীফ উদ্দীন হাসু, সাধারণ সম্পাদক শাহার আলী, প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রাজীব হাসান কচি, সাবেক সাধারণ সম্পাদক মরিয়ম শেলী, রির্চাড রহমান, বিপুল আশরাফ, আব্দুস সালাম প্রমুখ।

স্মরণসভায় মরিয়ম শেলী বক্তব্য দিতে গিয়ে বলেন, মোহাম্মদ আলী তৎকালীন অবজারভার ও দৈনিক সংবাদের চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তিনি তার শানিত কলম ধরেন। ১৯৭১ সালের ২৬ জুলাই তাকে তার বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে পাকহানাদার বাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করে। এ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে তার নিকটজনদের নিকট থেকে যে বর্ণনা শুনেছি তা রোমহর্ষক।

নিকজনেরা বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, দু মেয়ে আর আড়াই বছরের ছেলে স্বপনকে নিয়ে মোহাম্মদ আলী এবং মনোয়ারা বেগম অন্যান্য রাতের মতো ঘুমিয়ে ছিলেন। নিজ ঘরে। রাতের আঁধারে দরজা ভেঙে পাকবাহিনীর ঘরে প্রবেশ। এরপর তাদের গাড়িতে করে মোহাম্মদ আলীকে নিয়ে যাওয়া। যাওয়ার আগে যথারীতি পাকবাহিনী মনোয়ারাকে বলে গিয়েছিলো চিন্তার কোনো কারণ নেই। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ফিরিয়ে দিয়ে যাবে তার স্বামীকে। এর আগেও চুয়াডাঙ্গা প্রেসক্লাবে তৎকালীন কোষাধক্ষ মোহাম্মদ আলীকে পাকবাহিনীর মুখোমুখি হতে হয়েছিলো কয়েকবার। তবে সেটা ছিলো দিনের আলোয়। থানাতে। দিনের আলোয় তার বাড়ি ফেরা হয় প্রতিবার। তবে রাতের আঁধারে হারিয়ে যাওয়া মোহাম্মদ আলী আর ফিরেনি স্ত্রী-সন্তানের কাছে। তার অপেক্ষায় স্ত্রী মনোয়ারার কেটে যায় দিন। মাস। বছর। না জীবিত মোহম্মদ আলী আর ফেরেননি। পাওয়া যায়নি তার লাশটিও।

মরিয়ম শেলী তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে পাওয়া তথ্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, চুয়াডাঙ্গা শহরের জিনতলাপাড়ার মরহুম শামসুদ্দিন আহম্মদের ছেলে শহীদ সাংবাদিক মোহাম্মদ আলী। মহকুমা শহরে যখন ইংরেজি পত্রিকায় কাজ করার মানুষ পাওয়া দুষ্কর ছিলো তখন তিনি হন পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকার মহকুমা প্রতিনিধি। পাশাপাশি দৈনিক সংবাদের মহকুমা প্রতিনিধি হিসাবেও কাজ করতেন। শহীদ সাংবাদিক মোহাম্মদ আলী ছিলেন প্রগতিশীল চিন্তায় বিশ্বাসী। সৎ, নিষ্ঠাবান এ মানুষটি কখনও নিজের দুঃখকে পাত্তা দিতেন না। দীনহীন, দরিদ্র, শোষিত, নিপীড়িত আর নির্যাতিত মানুষের জন্য ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। পাকিস্তান প্রশাসন চায়তো তাদের পক্ষে সংবাদগুলো পত্রিকায় প্রকাশিত হক। কিন্তু মোহাম্মদ আলী লিখতেন এ দেশের স্বাধীনতাকামী মানুষের দুঃখ কষ্টের কথা। নিপীড়িত নির্যাতিত মানুষের কথা। ফলে টার্গেটে পড়েন তিনি রাজাকার আলবদর বাহিনীর। বিষয়টি বুঝতে পেরে কিছুদিন গ্রামে আত্মগোপন করেন। তবে গ্রামে থেকে কাজ করায় সমস্য দেখা দেয়। সেই সাথে স্থানীয় কিছু লোকের আশ্বাসে তিনি আবার চুয়াডাঙ্গায় ফিরে আসেন। সাংবাদিকতা, ব্যবসা আর গোপনে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন বেশ ভালোই। এর মাঝে হঠাৎ করে ১৯৭১ সালের ২৬ জুলাই গভীর রাতে নিজ বাড়ি থেকে মোহাম্মদ আলীকে তুলে নিয়ে যায় খানসেনারা। এরপর আর কোনোদিন তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।

জানা গেছে, শহীদ সাংবাদিক মোহাম্মদ আলীর পরিবারের পাশে দাঁড়ান চুয়াডাঙ্গা প্রেসক্লাবের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মো. আতিয়ার রহমান। তিনি তার স্ত্রী মনোয়ারা বেগমকে ঝিনুক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার চাকরি দেন। পরে মনোয়ারা বেগম ওল্ডজেএম স্কুলে স্থানান্তরিত হন। তবে স্বামী হারানোর শোক ভুলতে না পেরে ১৯৭৮ সালে মনোয়ারা বেগম দুনিয়া থেকে চিরবিদায় নেন। এতিম এই তিন শিশু বড় হয় নানাবাড়ি। মামা-মামিদের নিকট। তারা বড় হয়ে জানতে পারেন পিতার বীরত্বের কথা। আর কিছু নয়। খাতা-কলমে শহীদ সাংবাদিক মোহাম্মদ আলীর কোনো স্বীকৃতি মেলেনি। কেননা তিনি অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেতে যেয়ে শহীদ হননি। কলম হাতে যুদ্ধ করেছিলেন। শহীদ হয়েছিলেন। ফলে তিনি মুক্তিযোদ্ধা এ রকম কোনো সনদ আজও জোগাড় করা যায়নি। তাইতো শহীদ হয়েও এখনও পর্যন্ত তার কোনো স্বীকৃতি পাওয়া মেলেনি।

এবারের শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে চুয়াডাঙ্গা প্রেসক্লাব আয়োজিত স্মরণসভা জুড়েই ছিলো শহীদ সাংবাদিক মোহাম্মদ আলী প্রসঙ্গ। আগামীকাল মহান বিজয় দিবসে শহীদ সাংবাদিক মোহাম্মদ আলীর ছেলেকে প্রেসক্লাবে নিয়ে বিশেষ সম্মানে ভূষিত করা হবে।

স্মরণসভার সভাপতি বক্তব্য দিতে গিয়ে বলেন, সাংবাদিক মোহাম্মদ আলী ছিলেন সহকর্মী। তিনি প্রেসক্লাবের অর্থসম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাকে আজ চুয়াডাঙ্গা প্রেসক্লাব স্মরণ করতে পেরে যেমন ধন্য, তেমনই তাকে হারানোর কষ্টে প্রেসক্লাব ব্যথিত। তার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি আমরা।