স্টাফ রিপোর্টার: দফায় দফায় সময় আবেদন। দিনভর উত্তেজনা। হট্টগোল, হইচই, বাকবিতণ্ডা। এরই মধ্যে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণ। যদিও মামলার বাদী দুর্নীতি দমন কমিশনের উপপরিচালক হারুনুর রশীদ কয়েক মিনিটের সাক্ষ্যে ঠিক কি বলেছেন, তা স্পষ্ট বোঝা যায়নি। আলিয়া মাদরাসার বিশেষ জজ আদালতে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় এ নিয়ে তৃতীয় দিনের মতো সাক্ষ্য গ্রহণ করা হলো। পরে আদালত আগামী ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত সাক্ষ্য গ্রহণ মুলতবি করে। কড়া নিরাপত্তা। মোতায়েন বিপুলসংখ্যক পুলিশ। ঘড়ির কাঁটায় সকাল ১১টা ২৫ মিনিট। এজলাসে এলেন ঢাকার বিশেষ জজ-৩ বাসুদেব রায়। এ সময় বেগম খালেদা জিয়ার পক্ষে চারটি আবেদন জমা দেন তার আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া। হাইকোর্টে আদালত পরিবর্তনের আবেদন বিচারাধীন থাকার কথা জানিয়ে সাক্ষ্য গ্রহণ মুলতবির জন্য করা হয় দুটি আবেদন। নিরাপত্তার কারণে খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতির প্রসঙ্গে দায়ের করা হয় আরও দুটি আবেদন। অনুপস্থিতির আবেদন গ্রহণ করেন আদালত। সাক্ষ্য মুলতবি চেয়ে দায়ের করা আবেদনের শুনানি চলতে থাকে। বেলা সাড়ে তিনটার দিকে শেষ হয় শুনানি। শেষ মুহূর্তে সাক্ষীকে সাক্ষ্য দিতে নির্দেশ দেন আদালত। এ সময় খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা বারবার আদালত মুলতবির আহ্বান জানাতে থাকেন। বিচারক সাক্ষ্য গ্রহণের ব্যাপারে অনড় থাকলে তারা হইচই, চিৎকার করতে থাকেন। বিচারক ও সাক্ষীর বিরুদ্ধেও তারা নানা মন্তব্য করতে থাকেন। অন্যদিকে সাক্ষ্য গ্রহণের অনুরোধ জানিয়ে বক্তব্য রাখতে থাকেন দুদকের আইনজীবীরা। এজলাসকক্ষে এ সময় বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়। যদিও এরই মধ্যে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য সাক্ষ্য দেন মামলার বাদী।
এর আগে সময় আবেদনের শুনানির শুরুতে খালেদা জিয়ার আইনজীবী ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, আমরা চার্জ গঠনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে আবেদন করেছিলাম। আপিল বিভাগ আমাদের আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন। কিন্তু আদেশের কপি আমরা এখনও পাইনি। কপি পেলে রিভিউয়ের সুযোগ আছে। এছাড়া বেগম জিয়া মনে করেন- তিনি এই আদালতে ন্যায়বিচার পাবেন না। তাই আদালত পরিবর্তন চেয়ে আমরা উচ্চ আদালতে আবেদন করেছি। আমাদের আবেদন কার্যতালিকায় এসেছে। বিষয়টির উপর দ্রুত শুনানি করতে অ্যাটর্নি জেনারেল ও দুদকের আইনজীবীও আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। শুনানি হলে একটা রেজাল্ট আসবে। ততদিন পর্যন্ত মামলার কার্যক্রম মুলতবি করা হোক। এ সময় তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের আর কোন মামলায় প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে কখন এত চাপ তৈরি করা হয়নি। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায়ও এত চাপ সৃষ্টি করা হয়নি। এক-এগারোর সময়ও কোন মামলায় এতো চাপ ছিলো না। আশা করি- পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে।
এ সময় দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, আসামিপক্ষ এ মামলার পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালতে গিয়েছেন। কিন্তু তারা কোনো স্থগিতাদেশ আনতে পারেননি। তাই এই বিচারকাজ আইনের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য হবে। তিনি বলেন, আসামি পক্ষ ফৌজদারি কার্যবিধির ৫২৬ ধারায় আবেদন করলেই আদালত বিচারকাজ স্থগিত করতে বাধ্য নন। তিনি বলেন, একটি মামলায় কিছু ভুল থাকলে মামলা স্থগিত রাখতে হলে উচ্চ আদালত থেকে স্থগিতাদেশ আনতে হয়। তা আনতে আসামি পক্ষ বারবার ব্যর্থ হয়েছে। যেহেতু উচ্চ আদালত থেকে মামলা স্থগিত করা বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত আসেনি সেহেতু মামলার কার্যক্রম চালিয়ে যেতে কোন বাধা নেই। খালেদার নিরাপত্তাজনিত আবেদনের প্রেক্ষিতে খুরশিদ আলম বলেন, তিনি যে কয়বার এই কোর্টে এসেছেন তাতে কি নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়েছে বলে মনে হয়েছে? যদি না হয়ে থাকে তবে এখন কেন এমন আবেদন করা হচ্ছে? এরপর খালেদা জিয়ার আরেক আইনজীবী সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এজে মোহাম্মদ আলী শুনানিতে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫২৬ ধারা ও অন্যান্য আইনের ব্যাখ্যা দিয়ে আদালতকে উদ্দেশ্যে করে বলেন, আপনি যদি বিচারকাজ চালিয়ে যেতে চান সেটি আপনার ইচ্ছা। কিন্তু তার আগে সংশ্লিষ্ট আইনগুলো আপনাকে দেখে নেয়ার অনুরোধ করছি। তিনি বলেন, এই বিচারকাজ দ্রুত শেষ করতে কেন এত আগ্রহ তা আপনি নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করুন। শুনানি শেষে আবেদনগুলো খারিজ করে দিয়ে বিচাররক বাসুদেব রায় সাক্ষীর জবানবন্দি গ্রহণের নির্দেশ দিয়ে বলেন, সরকারকে অনুরোধ করছি বেগম খালেদা জিয়ার নিরাপত্তাজনিত বিষয়টি দেখার জন্য। একই সঙ্গে উভয়পক্ষের আইনজীবীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আদালতের পরিবেশ ও মর্যাদা আপনারা রক্ষা করবেন। এর জন্য যেন পুলিশকে ডাকতে না হয়। খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের উদ্দেশ্যে বিচারক বলেন, আপনারা যা বলবেন আমি সবই শুনবো। কিন্তু পেছন থেকে এভাবে সবাই যেন চিৎকার করতে করতে উঠে না দাঁড়ায়। শুনানি শেষে আদালত খালেদা জিয়ার সময় আবেদন নাকচ করে দেয়। এরই মধ্যে খালেদা জিয়ার অপর আইনজীবী জয়নুল আবেদিন ও সানাউল্লা মিয়া খারিজ হওয়া আবেদনগুলো পুনর্বিবেচনার আবেদন করেন। একই সঙ্গে তিনি এ বিষয়টি নিয়ে উচ্চ আদালতে যাওয়ার কথা বলে সাক্ষ্য গ্রহণ মুলতবির আবেদন করেন। শুনানিতে তিনি বলেন, বিচারকের উপরেও বিচারক আছে। আপনার উপরে ভগবান আছেন। একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার আইনজীবীরা উচ্চ আদালতে গেলে বিচারক হিসেবে বিষয়টি বিবেচনা করে সাক্ষ্য গ্রহণ স্থগিত করা উচিত। এ সময় হট্টগোলের মধ্য সাক্ষী হারুনুর রশীদ তার জবানবন্দি উপস্থাপন করতে পারেননি। এ সময় আদালত এক ঘণ্টার জন্য মুলতবি করে বিরতির পর সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হবে ঘোষণা দিয়ে এজলাস ত্যাগ করে তার ব্যক্তিগত কক্ষে চলে যান। বিরতির পর খালেদার পক্ষে আবারও শুনানিতে অংশ নেন সিনিয়র আইনজীবী এজে মোহাম্মদ আলী। তিনি বিচারকের উদ্দেশে বলেন, আপনি পক্ষপাতিত্ব করছেন। আপনি পূর্ববর্তী আদেশগুলোতেও আমাদের আবেদন গ্রহণ করেননি। আপনি আপনার বক্তব্যে অটল রয়েছেন। শুধু স্টে অর্ডারের কথা বলেছেন। আপনিই সব ক্ষমতার অধিকারী নন। বিচারকের প্রতি প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, আপনার পূর্ববর্তী আদেশগুলো দেখে বলুন আমাদের জন্য কোন সন্দেহাতীত সুযোগ দিয়েছিলেন কিনা? এভাবেই আপনি আমাদের ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করছেন।
এ সময় দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, মাননীয় আদালত আমরা যখনই কথা বলতে চাই ওনারা (খালেদার আইনজীবীরা) আদালতের পরিবেশ উত্তপ্ত করার চেষ্টা করেন। এটা ঠিক নয়। আপনি বিচারক। আপনিই নির্ধারণ করবেন কোর্ট কিভাবে চলবে। আপনার কাছ থেকে সঠিক সিদ্ধান্ত আশা করছি। তার বক্তব্য শেষ হওয়ার সাথে সাথেই আদালতে তুমুল হট্টগোল শুরু করেন বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা। এ সময় সিনিয়র আইনজীবী জয়নুল আবেদিন বিচারক বাসুদেব রায়ের উদ্দেশে বলেন, আপনি জোর করে সাক্ষ্য গ্রহণ করতে পারেন না। আমাদের বক্তব্য আপনাকে শুনতে হবে। বিচারক বাসুদেব এ সময় তার এজলাসের আসন ছেড়ে তার খাসকামরায় চলে যান। এর কিছুক্ষণ পর তার সহকারীর মাধ্যমে মামলার পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণ আগামী ১৭ ডিসেম্বর হবে বলে জানিয়ে দেন। পরে খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নুল আবেদীন সাংবাদিকদের বলেন, প্রসিকিউশন আসামিদেরকে সাজা দেয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে গেছে। আমরা আদালতের কাছে বারবার উচ্চ আদালতের কথা বললেও আদালত বিশ্বাস করছেন না, বা শুনছেন না। জয়নুল আবেদীন বলেন, একটা জুডিশিয়াল এনার্কি তৈরি করেছেন পাবলিক প্রসিকিউটর। প্রসিকিউটর বললেন, আদালত এখনই আদেশ দেবে। ওগুলো দেখা-টেখার দরকার নেই। বিচারকও একই মতে সাক্ষ্য গ্রহণের নির্দেশ দেন। এটাই হচ্ছে জুডিশিয়াল এনার্কি। জয়নুল আবেদীন আরও বলেন, বিচারক ইচ্ছা করলেই এ অবস্থা থেকে রক্ষা করতে পারতেন। কোর্ট ম্যানেজমেন্ট বলতে একটা কথা আছে। কিন্তু সেটা তিনি করেননি। এ আদালতের প্রতি আমাদের কোন আস্থা নেই। অন্যদিকে দুদকের আইনজীবী মোশারফ হোসেন কাজল বলেন, মামলার সাক্ষ্য গ্রহণের কার্যক্রম চলছে। প্রতিটি ধার্য তারিখেই খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা নতুন নতুন ইস্যু হাজির করে মামলার কার্যক্রম বিলম্বিত করতে চান। কিন্তু এ মামলা স্থগিত করার জন্য কোন আদেশ তারা উচ্চ আদালত থেকে আনতে পারেননি। কাজল বলেন, মামলার বাদী ও প্রথম সাক্ষী হারুনুর রশিদ তার বক্তব্য আদালতে পেশ করেছেন। আদালত তার বক্তব্য শুনে গ্রহণ করেছেন বলেও উল্লেখ করেন তিনি। দুদকের আইনজীবী আরও বলেন, খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা তাদের জুনিয়র আইনজীবীদের দিয়ে আদালতে বিশৃঙ্খলা করিয়েছেন। তারা আদালতের সঙ্গে অশোভন আচরণ করেছেন।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের নামে দুর্নীতির অভিযোগে ২০০৮ সালের ৩রা জুলাই রমনা থানায় একটি মামলা করেন দুদকের তখনকার সহকারী পরিচালক (বর্তমানে উপ-পরিচারক) মো. হারুনুর রশিদ। এতিমদের সহায়তা করার উদ্দেশ্যে একটি বিদেশী ব্যাংক থেকে আসা ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ এনে এ মামলা করা হয়। মামলার বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ছাড়াও দলটির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ মোট ছয়জনকে অভিযুক্ত করে ২০০৯ সালের ৫ই আগস্ট আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়। খালেদা ও তারেক রহমান ছাড়া জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার অপর ৪ আসামি হচ্ছেন মাগুরার বিএনপিদলীয় সাবেক এমপি কাজী সালিমুল হক কামাল ওরফে ইকোনো কামাল, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ, জিয়াউল ইসলাম মুন্না ও মনিরুল ইসলাম খান। তাদের মধ্যে কাজী সালিমুল হক কামাল এবং শরফুদ্দিন আহমেদ জামিনে আছেন। তবে গতকাল সাক্ষ্য গ্রহণের সময় কাজী সালিমুল হক ও জিয়াউল ইসলাম মুন্না ছাড়া আদালতে আর কেউ উপস্থিত ছিলেন না।