চুয়াডাঙ্গায় খেলার মাঠ আছে : খেলাধুলা নেই

হারিয়ে যাচ্ছে চুয়াডাঙ্গা ক্রীড়াঙ্গনের সোনালি অতীত! পূর্ণর উদ্ধার প্রয়োজন

 

আলম আশরাফ: সেই চল্লিশের দশকের কথা। পশ্চিমবাংলা ও কোলকাতার বিভিন্ন ফুটবল মাঠে আতঙ্কের নাম ছিলেন চুয়াডাঙ্গার ফুটবলাররা। অবিভক্ত বাংলার মাঠে-ময়দানে ফুটবল দিয়ে চষে বেড়িয়েছেন চুয়াডাঙ্গা ফুটবলের এক সময়ের ধারক-বাহক আব্দুল ওয়াদুদ ও শাফায়েতুল ইসলাম। এরপর এদের সাথে জুটি বাঁধেন পঞ্চাশের দশকের আশরাফ জোয়ার্দ্দার সাবু, মোমিন জোয়ার্দ্দার ও মিঠু জোয়ার্দ্দার। ষাটের দশক পর্যন্ত চুয়াডাঙ্গার এসব ফুটবলার কলকতার এরিয়েন্স, মোহামেডান স্পোর্টিং, মোহনবাগান ইত্যাদি টিমের হয়ে বাজিমাত করেছেন। এদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে সরোয়ার হোসেন মধু, সন্টু ও ডডির পর মাহমুদুল হক লিটন, মামুন জোয়ার্দ্দার, গিয়াস উদ্দিন পিনা আর মানিক কাঁপিয়েছেন বাংলাদেশের বিভিন্ন ফুটবল মাঠ। নব্বই দশকের গোড়ার দিকে বিদেশের মাটিতে ডানোকাপ, ডামফা কাপ ও গোথিয়া ফুটবলের শিরোপা জেতার পেছনে চুয়াডাঙ্গার কৃতী ফুটবলার মামুন জোয়ার্দ্দারের অগ্রণী ভূমিকার কারণে চুয়াডাঙ্গার জয়জয়কার পড়ে যায়। দেশের ফুটবলপ্রেমীদের মুখে মুখে চলে আসে মামুন জোয়ার্দ্দারের নাম। একেই না বলে যোগ্য উত্তরসূরীদের যোগ্যতর অনুজ।

নব্বই দশকের শেষ দিক থেকে চুয়াডাঙ্গা ফুটবলের গৌরব ও সোনালি অতীত ফিঁকে হতে থাকে। জাতীয় ফুটবলে চুয়াডাঙ্গা জেলার অবস্থান হতাশাজনক হয়ে ওঠে। ভালো মানের কোনো ফুটবলারই যেন তৈরি হচ্ছে না চুয়াডাঙ্গার মাটিতে। এর কারণ হিসেবে চুয়াডাঙ্গার প্রবীণ ফুটবলাররা শুধু নুতুন প্রজন্মকে নয়, চুয়াডাঙ্গার ক্রীড়াঙ্গনের কর্তাব্যক্তিদেরও দায়ী করেন। আব্দুল ওয়াদুদ শাহ বলেন, চুয়াডাঙ্গায় এখন মাঠের অভাব নেই। কিন্তু সেখানে খোলা মন নিয়ে খেলার মতো ফুটবলার নেই। আবার নতুন যারা আসেন কর্তাব্যক্তিদের উৎসাহ ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাবে খেলতে পারেন না।

এবার আশা যাক ক্রিকেটে। নব্বই দশকের শেষ দিকে বাংলাদেশে ক্রিকেট খেলা জনপ্রিয় হতে থাকে। ১৯৯৭ সালে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরের কিলাব ক্লাব মাঠে কেনিয়াকে ১ রানে হারিয়ে আইসিসি ট্রফিতে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মধ্যদিয়ে বাংলাদেশে ক্রিকেট গণজাগরণ সৃষ্টির মাধ্যমে দেশব্যাপি ক্রিকেট জোয়ার বইতে থাকে। সে জোয়ারের ঢেউ চুয়াডাঙ্গার মাটিকেও আন্দোলিত করে। তবে জাতীয় ক্রিকেট দলে চুয়াডাঙ্গার ক্রিকেটাররা এ যাবত জায়গা করে নিতে পারেনি।

তবে চুয়াডাঙ্গার ফুটবল ও ক্রিকেটকে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা যে একেবারে নেই তা নয়। স্থানীয় বিত্তবান, দাতা, ক্রীড়ানুরাগী ও ক্রীড়াসংগঠকরা এগিয়ে এলে চুয়াডাঙ্গার ক্রীড়াঙ্গন ফিরে পেতে পারে তার হারানো গৌরব। বিষয়টি মাথায় রেখে ২০১২ সাল থেকে ক্রীড়া শিক্ষক সাংবাদিক ইসলাম রকিবের হাত ধরে অব্যাহতভাবে কাজ করে চলেছে চুয়াডাঙ্গা নাইটিঙ্গেল ক্রিকেট একাডেমী। এ একাডেমী থেকে ২০১৩ সালে অনুর্ধ্ব-১৬ ও ১৪ ক্রিকেটে ১০ জন এবং এ বছর অর্থাৎ ২০১৪ সালে অনুর্ধ্ব-১৪, ১৬ ও ১৮ এইজে সর্বমোট ৩০ জন ক্রিকেটার জেলা দল বাছাইয়ে নির্বাচিত হয়। এ একাডেমীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এসেছিলেন সাবেক বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট অধিনায়ক হাবিবুল বাশার সুমন, সাবেক জাতীয় দলের ক্রিকেটার প্রয়াত শেখ সালাউদ্দীন, মেহেরাব হোসেন অপি ও রানিং ক্রিকেটার ইমরুল কায়েস। এ একাডেমীকে গতিশীল ও কার্যকর করার জন্য নেপথ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে চলেছেন জাতীয় ক্রীড়া সংগঠক চুয়াডাঙ্গা পৌর মেয়র রিয়াজুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার টোটন, শেখ রাসেল ক্রীড়াচক্রের সভাপতি তরুণ ক্রীড়া সংগঠক নইম হাসান জোয়ার্দ্দার ও চুয়াডাঙ্গা সমবায় নিউমার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি চুয়াডাঙ্গা ওয়ালটন এক্রক্লুসিভ ডিলার মাহফুজুর রহমান জোয়ার্দ্দার মিজাইল।

এছাড়া চলতি বছরের আগস্ট থেকে চুয়াডাঙ্গার ফুটবলকে এগিয়ে নিতে সাবেক কৃতী ফুটবলার এএফসির সাবেক কোচ সরোয়ার হোসেন মধু ও শহিদুল কদর জোয়ার্দ্দার ফুটবল একাডেমীর কার্যক্রম শুরু করেছেন। যা চুয়াডাঙ্গার ফুটবলের জন্য কল্যাণকর হবে বলে মনে করেন ক্রীড়াবিদরা।

চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের এমপি বর্তমান জাতীয় সংসদের হুইপ বীরমুক্তিযাদ্ধা সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দারের প্রচেষ্টায় চুয়াডাঙ্গায় ১২ দশমিক ৩৬ একর জমির ওপর ১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে জাতীয় মানের একটি স্টেডিয়াম। যা প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের প্রতীক্ষায় রয়েছে। এছাড়া রেলস্টেশন সংলগ্ন পুরনো স্টেডিয়াম, শহরের প্রাণকেন্দ্রে রয়েছে টাউন ক্লাব ফুটবল মাঠ, রয়েছে কলেজ মাঠ ও চাঁদমারি মাঠ। এতোসব মাঠ থেকেই বা কী! প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম, উৎসাহ ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এসব মাঠে নিয়মিত খেলাধুলা ও অনুশীলন হয় না। অনেক প্রাক্তন কৃতী খেলোয়াড় বলেন, চুয়াডাঙ্গায় মাঠ আছে কিন্তু মাঠের প্রাণ খেলোয়াড়দের নিয়মিত দেখা যায় না। তাই কেবল হাতছানি দেয় চুয়াডাঙ্গা ক্রীড়াঙ্গনের সেই সোনালি অতীত।

জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম জানান, চুয়াডাঙ্গার সোনালী অতীতে গৌরবময় ইতিহাস ছিলো শুধু ফুটবলকে ঘিরে। ক্রীড়াঙ্গনের অন্য শাখায় তেমন পদচারণা ছিলো না। চুয়াডাঙ্গা জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাবেক সাধারন সম্পাদক মতিয়ার রহমান বলেন, চুয়াডাঙ্গার নবনির্মিত চুয়াডাঙ্গা স্টেডিয়ামটি চুয়াডাঙ্গা ক্রীড়াঙ্গনের জন্য একটি আর্শিবাদ স্বরূপ। স্টেডিয়ামটি উদ্বোধন হলে চুয়াডাঙ্গার ক্রীড়াঙ্গন আবার সরব হয়ে উঠবে। তবে খেলাধুলার জন্য শুধু স্টেডিয়াম থাকলেই হবেনা খেলাধুলার উন্নয়নের জন্য সৎ, যোগ্য ও খোলামনের মানুষদের ওপর দায়িত্ব অর্পণ করতে হবে। অতীতে শুধু চুয়াডাঙ্গার ফুটবলই গৌরবময় ছিলো না। হকি ও অ্যাথলেটিসেও চুয়াডাঙ্গা নাম করা ছিলো। এ দুটি বিভাগে সন্টু ও সাইদুর রহমান মালিকের কৃতিত্বের কথা করোরই অজানা নয়। এছাড়া চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের সংসদ সদস্য সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুন হকি খেলার পাশাপাশি একজন ভালোমানের হকি সংগঠক ছিলেন। চুয়াডাঙ্গা পৌর মেয়র বাংলাদেশ জাতীয় হকি দলের টিম ম্যানেজার হিসেবে সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে কৃতিত্বের সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। চুয়াডাঙ্গা জেলা ক্রীড়া সংস্থার অন্যতম সদস্য ক্রীড়াবিদ ওবাইদুল হক জোয়ার্দ্দার বলেন, সাংগঠনিক দুর্বলতা ও সঠিক পরিকল্পনার অভাবে চুয়াডাঙ্গার ক্রীড়াঙ্গনের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। রুট লেবেল থেকে দল-মতের ঊর্ধ্বে থেকে প্রতিভা সম্পন্ন খেলোয়াড় বাছাই না করা হলে চুয়াডাঙ্গা ক্রীড়াঙ্গনের অতীত গৌরব ফিরিয়ে আনা অসম্ভব হবে।

তবে চুয়াডাঙ্গার অতীত যতো গৌরবময় বা গৌরবান্বিত হোক না কেন! বর্তমানে চুয়াডাঙ্গায় যে ক্রীড়াক্ষেত্র বিরাজমান এর যথোপযুক্ত ব্যবহার, ক্রীড়া সংগঠক ও ক্রীড়াব্যক্তিত্বদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এবং সদিচ্ছায় পারে গতিশীল ক্রীড়াঙ্গন উপহার দিতে। ফিরে পেতে পারে চুয়াডাঙ্গা ক্রীড়াঙ্গন তার অতীত গৌরব। যা উদ্ধার খুবই প্রয়োজন।

Leave a comment