চিকিৎসাসেবাকে বলা হয় মহৎ পেশা। কারণ চিকিৎসকরা আর্তমানবতার সেবায় নিজেদের নিয়োজিত রাখেন। প্রায় সব ধর্মেই মানবতার সেবাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এমনকি শিক্ষাজীবন শেষ করে চিকিৎসকরা যখন পেশাজীবনে প্রবেশ করেন, তখন যে হিপোক্রেটিক শপথ নেন, সেখানেও আর্তমানবতার সেবাকেই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে কী হচ্ছে, বিশেষ করে বাংলাদেশে? নীতি, নৈতিকতা, শপথ- সবকিছু থেকে আমাদের চিকিৎসা পেশা শুধু দূরেই নয়, একেবারে বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছে। একজন মুমূর্ষু রোগী যখন চিকিৎসকের সাহায্যের জন্য তার চেম্বারে যায়, তখন সেবার বদলে তাকে কতোভাবে শোষণ করা যায়, তার সব আয়োজন আগে থেকেই সেখানে তৈরি রাখা হয়। প্রয়োজন হোক না হোক, ডজন খানেক পরীক্ষার একটি ছাপানো স্লিপ রোগীর হাতে ধরিয়ে দেয়া হয়। কারণ প্রতিটি পরীক্ষায় রোগী যে অর্থ ব্যয় করবে তার ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন আকারে চিকিৎসকের পকেটে ফিরে আসবে সময়মতো। সেই সাথে প্রতিবার দর্শনে ‘ভিজিট’ মূল্য তো আছেই। শুধু তা-ই নয়, রোগীদের কোনো ক্লিনিক বা হাসপাতালে পাঠানো হলে সেখান থেকেও নির্দিষ্ট অঙ্কের কমিশন এসে যাবে চিকিৎসকের পকেটে। অভিযোগ আছে, সরকারি হাসপাতালগুলোতে বড় ডাক্তাররা সময় দেন না বললেই চলে। তাদের অধস্তনরা রোগীর স্বজনদের কানে কানে বলে দেন, স্যারকে দেখাতে হলে রোগীকে অমুক হাসপাতালে বা ক্লিনিকে নিয়ে যান। এসবের মধ্যে মানবতার সেবা কোথায়? মহত্ত্ব কোথায়? যা আছে, তার পুরোটাই বাণিজ্য। অন্যায়, অমানবিক বাণিজ্য।
আন্তর্জাতিক উদরাময় রোগ গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) হেলথ ইকোনমিকস অ্যান্ড ফিন্যান্সিং রিসার্চ গ্রুপের গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রায় ২০ শতাংশ মানুষ চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। বিষয়টি আমাদেরও অজানা নয়। গ্রামের কোনো কৃষক পরিবারের আদরের সন্তানটির গুরুতর অসুখে মা-বাবা দিশাহারা হয়ে যান। মফস্বলে পর্যাপ্ত চিকিৎসার সুযোগ না থাকায় ছেলেকে নিয়ে ছুটে আসেন ঢাকার বড় কোনো সরকারি হাসপাতালে। সেখানে গেলেই শুরু হয়ে যায় রোগী নিয়ে টানাহেঁচড়া। পরামর্শের পর পরামর্শ। স্যারকে দেখাতে হলে অমুক জায়গায় স্যারের চেম্বারে যান। স্যার না বললে ভর্তি হবে না ইত্যাদি। সেখান থেকে বলা হবে, সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা হয় নাকি, রোগীকে বাঁচাতে হলে ক্লিনিকে ভর্তি করেন। গ্রামের গরিব কৃষক প্রথমে হালের বলদ,পরে তার অবশিষ্ট সামান্য জমি বিক্রি করে চিকিৎসার খরচ জোগাতে থাকেন। এ চিত্র আজ দেশের সর্বত্র। একে কি ‘আর্তমানবতার সেবা’ বলা যাবে, না ‘মহৎ পেশা’ বলা যাবে! দেশে সরকার আছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আছে, চিকিৎসকদের নানা ধরনের সংগঠন আছে- চিকিৎসা পেশার সুনাম রক্ষার স্বার্থে দ্রুত বিষয়টি নিয়ে তাদের চিন্তাভাবনা করা প্রয়োজন। প্রতিকারের সম্ভাব্য উপায় খোঁজা প্রয়োজন। চিকিৎসকদেরও ন্যূনতম মানবিক মূল্যবোধ ও নৈতিকতা অনুসরণ করা প্রয়োজন। একই সাথে অনৈতিক আচরণগুলোকে কঠোর শাস্তির আওতায় আনাও জরুরি হয়ে উঠেছে।