গুলি করে গদি রক্ষা হবে না : খালেদা

স্টাফ রিপোর্টার: আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে হটাতে রাজপথে নামার ঘোষণা দিয়ে তার সাথে সবাইকে যোগ দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। আওয়ামী লীগ বন্দুকের জোরে ক্ষমতা ধরে রেখেছে দাবি করে গতকাল শনিবার কুমিল্লায় ২০ দলীয় জোটের জনসভায় বক্তব্যে তিনি আহ্বান জানান। খুব শিগগিরই সরকারের পতন ঘটবে বলে দলীয় নেতা-কর্মীদের কর্মসূচির জন্য প্রস্তুতি নেয়ার পরামর্শও দিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন। নির্দলীয় সরকারের অধীনে আগাম নির্বাচনের দাবিতে কর্মসূচি ঘোষণার আগে জনসংযোগের অংশ হিসেবে কুমিল্লা টাউন হল মাঠে জনসভা করেন খালেদা। এটি ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর ঢাকার বাইরে তার নবম জনসভা। ২০০৮ সালের ২২ ডিসেম্বর নির্বাচনী প্রচারাভিযানের সময় বিএনপি চেয়ারপারসন এই টাউন হল মাঠে জনসভায় সর্বশেষ বক্তব্য দিয়েছিলেন। নির্দলীয় সরকারের দাবিতে সরকারের সাড়া না মেলায় এখন আন্দোলনের বিকল্প নেই বলে জনগণকে জানান বিএনপি চেয়ারপারসন। ভালো কিছু পেতে হলে কিছু কষ্ট করতে হয়। আন্দোলনে আমি আপনাদের সাথে থাকবো। এক কাতারে চলি, দেখি কিভাবে পুলিশ গুলি করে। এবার গুলি করে গদি রক্ষা হবে না। সরকার ভেবেছে, বিএনপি  ও ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মীদের বন্দি করে তারা ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে পারবে। তাদের ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়, খুব শিগগিরই তাদের পতন হবে। যখনই ডাক দেয়া হবে, তখনই আন্দোলনে নেমে পড়তে সবার প্রতি আহ্বান জানান বিএনপি চেয়ারপারসন। প্রায় ঘণ্টাব্যাপি বক্তব্যে সরকারের দুর্নীতি-অপশাসন, বিরোধী দল দমন, আগামী আন্দোলন, মিথ্যা মামলা, দলীয়করণসহ নানা বিষয়ে তুলে ধরেন তিনি। জাতীয় পার্টি ও জাসদের সাথে আওয়ামী লীগের সখ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, হাসিনা এখন খুনিদের দ্বারা বেষ্টিত। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে দাবি করে তিনি বলেন, তারা জানে যে জনগণ তাদের পিষে ফেলবে, সেজন্য তারা খুনিদের ছাড়তে চায় না। শেখ হাসিনা সরকার ৱ্যাব-পুলিশকে বিরোধিতা দমনের কাজে ব্যবহার করছে বলেও দাবি করেন বিএনপি চেয়ারপারসন।
শিক্ষাঙ্গনসহ সর্বক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী সংগঠনগুলোর দখলদারিত্ব চলছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি। বিডিআর বিদ্রোহ এবং হত্যাকাণ্ডের সাথে আওয়ামী লীগের যোগসাজশ ছিলো বলেও দাবি করেন তিনি। গণভবনে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় শেখ হাসিনার দেয়া বক্তব্যের প্রতি ইঙ্গিত করে খালেদা জিয়া বলেন, ১/১১ সময়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নামে ৮ হাজার মামলা একে একে সরকার তুলে নিয়েছে। হাসিনার নামে ১৫টি মামলা ছিলো, তাও তুলে নেয়া হয়েছে। তিনি অভিযোগ করেন, হাসিনার নামে ওইসব মামলার মধ্যে জোড়াতালি দেয়া মিগ-২৯ জালিয়াতি মামলা ও পুরনো ফ্রিগেড কেনার মামলা রয়েছে। ওইসব মামলার বিচার হলে হাসিনার সাজা হতো। এসব মামলা কেন প্রত্যাহার করা হলো সে প্রশ্ন রেখে খালেদা বলেন, আমি হাসিনার কাছে জানতে চাই, ওই সব মামলা কেন উঠিয়ে নিলেন। আপনি নিরপেক্ষ আদালতের মাধ্যমে ফেস করতেন, দেখতাম, কতো সাহস। সেজন্যই তো মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দিনের পায়ে ধরেছিলেন। তারা আমার কাছেও এসেছিলো, আমি তাদের ডাকে সাড়া দেইনি। বক্তব্যে বর্তমান সরকারকে দুর্নীতিবাজ হিসাবে আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, এরা দেশের অর্থনীতিকে স্থবির করে ফেলেছে। যদু-মধুদের নিয়ে ব্যাংকের পরিচালনা পর্যদ গঠন করে ব্যাংকগুলোকে ফোকলা করে দিয়েছে। অর্থমন্ত্রী এসব ব্যর্থতার কথা অসহায়ত্বের মতো স্বীকার করেছেন। আওয়ামী লীগকে বর্জনের আহ্বানও জানান তিনি। আমি বলতে চাই, আওয়ামী লীগ বর্জন করুন। নতুন করে পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে। এই পরিবর্তন হবে যুব-যুবতীদের কর্মসংস্থান, দেশের সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের।
প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচটি ইমামের সাম্প্রতিক বক্তব্যের প্রতি ইঙ্গিত করে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, এইচটি ইমাম ছিলো ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রধান সমন্বকারী। কীভাবে নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে, তিনি সব ফাঁস করে দিয়েছে। এই ইমামই (এইচটি ইমাম) হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখতে যতো রকমের কুবুদ্ধি দিয়ে থাকেন। খালেদা বলেন, আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধ এবং গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না। গত কয়েকটি সমাবেশের মতো কুমিল্লার সমাবেশেও ৱ্যাবকে বিলুপ্তির দাবি করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী, যার সরকারের সময়ে ৱ্যাব গঠন করা হয়েছিলো। খালেদা বলেন, ৱ্যাব এখন মানুষ খুনের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। বিদেশিদের বলবো, যারা আপনাদের দেয়া গুলি-টিয়ারশেল, রাবার বুলেট নিরীহ জনগণের ওপর ব্যবহার করে, তা ৱ্যাব-পুলিশকে দেয়া বন্ধ করুন। তাদের বিদেশে প্রশিক্ষণ ও জাতিসংঘ মিশনে না নেয়ারও আহ্বান জানাচ্ছি। একই সাথে ৱ্যাবের উপমহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসানকে গুম-খুনের নেপথ্য ব্যক্তি আখ্যায়িত করে অবিলম্বে তার চাকরিচ্যুত ও গ্রেফতারের দাবি জানান তিনি। গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে খালেদা বলেন, তারা কন্ট্রাক কিলিং করছে। টাকা দিলে ছেড়ে দেয়, না দিলে খুন হয়। রাস্তা-ঘাটে, খালে-বিলে কেন এতো লাশ পাওয়া যাচ্ছে? জঙ্গিবাদ প্রসঙ্গে খালেদা বলেন, বিদেশিদের আকৃষ্ট করতে সরকার জঙ্গি সাজিয়ে নাটক করছে। দাঁড়ি-টুপি দেখলে তাদের জঙ্গি হিসেবে চিহ্নিত করে নাজেহাল করছে। কিন্তু ওইসব দাঁড়ি-টুপি মানুষজন ধর্মের কথা বলে, ইসলাম-ঈমানের কথা প্রচার করে। তারা কোনোভাবে জঙ্গি নয়। শায়খ আবদুর রহমানের গ্রেফতারের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের আমলে ৱ্যাবের কর্নেল গুলজারের নেতৃত্বে তাকে গ্রেফতার হয়েছিলো বলেই গুলজারকে বিডিআরে পোস্টিং দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এভাবে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার দেড় মাসের মাথায় পিলখানায় ৫৭ জন চৌকস অফিসারকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনা জানতেন বলেই সূধা সদন থেকে ঘটনার কিছু দিন আগে হেয়ার রোডের বাসায় ওঠেন হাসিনা। টাউন হল মাঠের এ জনসভায় সভাপতিত্ব করেন জেলা বিএনপির আহ্বায়ক রাবেয়া চৌধুরী।
জামায়াতে ইসলামীসহ ২০ দলীয় জোটের নেতারাও বক্তৃতা করেন জনসভায়। জনসভায় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ, এমকে আনোয়ার, রফিকুল ইসলাম মিয়া, মির্জা আব্বাস, নজরুল ইসলাম খান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা শওকত মাহমুদ, যুগ্ম মহাসচিব আমান উল্লাহ আমান প্রমুখ। স্থানীয় বিএনপির নেতাদের মধ্যে জেলা দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক আমিন-উর রশীদ ইয়াছিন, সিটির মেয়র মনিরুল হক সাক্কু, উত্তরের সভাপতি মো. খোরশেদ আলম, জেলা নেতা মোস্তাক মিয়া, সাবেক সাংসদ আনোয়ারুল আজীম, জাকারিয়া তাহের সুমন, আবুল কালাম আজাদ, আবদুল গফুর ভুঁইয়া, ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ছেলে ব্যারিস্টার খন্দকার মারুফ হোসেনও বক্তব্য রাখেন। এছাড়া জোট নেতাদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন এলডিপির অলি আহমেদ, রেদোয়ান আহমেদ, বিজেপির আন্দালিব রহমান পার্থ, জামায়াতে ইসলামীর অধ্যাপক মজিবুর রহমান, ইসলামী ঐক্যজোটের আবদুল লতিফ নেজামী, খেলাফত মজলিশের মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক, জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) মোস্তফা জামাল হায়দার, কল্যাণ পার্টির সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম প্রমুখ।
এর আগে কুমিল্লার ১৬টি উপজেলার পাশাপাশি ফেনী, নোয়াখালী, চাঁদপুর থেকে ২০ দলের নেতাকর্মীরা এ জনসভায় যোগ দেন। জনসভামুখি বিভিন্ন মিছিলে অনেকের হাতে ছিলো ধানের শীষ প্রতীক; জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বড় প্রতিকৃতি ছিলো অনেকের হাতে। অনেক মিছিলে ছিলো বাদক দলও। জনসভাস্থল টাউন হল মাঠে উড়ানো হয় ছোট-বড় অন্তত ২০টি বেলুন। জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া, তারেক রহমানের ছবি খচিত বেলুনের পাশাপাশি জামায়াত নেতা যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামী ও দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ছবি সম্বলিত বেলুনও ছিলো এর মধ্যে। জনসভা শেষে বিএনপি চেয়ারপারসন কিছুক্ষণ সার্কিট হাউজে অবস্থান করে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন।