নানা সমস্যায় মেহেরপুরের রঘুনাথপুর আশ্রয়ন প্রকল্পবাসীরা

মহাসিন আলী: শিক্ষা, কর্মসংস্থান, বাসস্থান সংকট, সুপেয় পানির অভাবসহ নানা সমস্যায় ভুগছেন মেহেরপুর সদর উপজেলার আমঝুপি ইউনিয়নের রঘুনাথপুর আশ্রয়ন প্রকল্পের অধিবাসীরা। দু বেলা খাবার জোগাড় করতে হিমসিম খাচ্ছে তারা। একটি স্কুলের অভাবে অনাদরে অশিক্ষায় বেড়ে উঠছে তাদের আদরের সন্তানেরা। বিদ্যুত সংযোগ থাকার পরও ঘনঘন লোডশেডিঙের কারণে প্রতিটি রাত কাটে চরম আতঙ্কের মধ্যে। নানা সমস্যায় ঘর বরাদ্দ পেয়েও অনেক পরিবার ব্যারাক ছেড়ে চলে গেছেন।

শেখ হাসিনার অগ্রায়ন প্রকল্পের আওতায় ২০০০ সালে ৫৫ ব্যাটালিয়নের মেজর ইলিয়াস কাঞ্চনের নেতৃত্বে মেহেরপুর সদর উপজেলার আমঝুপি ইউনিয়নের রঘুনাথপুর মাঠের ভেতর ১৬টি ব্যারাকে ১০টি করে মোট ১৬০টি ভূমিহীন পরিবারের বসবাসের জন্য গড়ে তোলা হয় আশ্রয়ন প্রকল্প। টিনশেড দিয়ে নির্মিত এক একটি ব্যারাকে বাস করে ১০টি পরিবার। একটি পরিবারের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে একটি করে কক্ষ। প্রতিটি পরিবারকে খাসজমি দেয়া হয়েছে ৪ কাঠা (৬ শতাংশ) করে।

সরজমিনে মেহেরপুর সদর উপজেলার আমঝুপি ইউনিয়নের রঘুনাথপুর আশ্রয়ন প্রকল্পের অভাবী মানুষের মাঝে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানকার অধিবাসীদের সমস্যার শেষ নেই। সেখানে স্কুল নেই, নেই কর্মসংস্থানের কোনো ব্যবস্থা। অভাবের তাড়নায় কাজের সন্ধানে অনেকেই চলে গেছে আশ্রয়ন প্রকল্পের ব্যারাক ছেড়ে। কোনো কর্মসংস্থান না থাকায় অভাবের তাড়নায় মুক্তিযুদ্ধের ৮ নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা আবু তাহের ও মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালামসহ ৮০টি পরিবার ব্যারাক ছেড়ে চলে গেছে অন্য জায়গায়। তাদের নামে বরাদ্দকৃত ঘরগুলো পড়ে আছে অরক্ষিত অবস্থায়। ৩০ ফুট দৈর্ঘের ও ৯ ফুট প্রস্থের একটি করে বরাদ্দকৃত কক্ষে চরম মানবেতর অবস্থায় ছেলে-মেয়ে, ঝি-জামাই ও স্বজনদের নিয়ে বসবাস করছেন প্রকল্পের অধিবাসীরা। ৬ নং ব্যারাকের টিন ঝড়ে উল্টে গেছে। আশ্রয়ন প্রকল্পের বাসিন্দাদের জন্য মোট ১৬টি টিউবওয়েল মধ্যে ১০টিতে মাত্রারিক্ত আর্সেনিক পাওয়া গেছে। আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করে অনেকে আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়েছেন। প্রতিটি ব্যারাকের জন্য ৪টি করে বাথরুম ও ২টি করে গোসলখানা ব্যবস্থা করা হলেও তার অধিকাংশ নষ্ট হয়ে গেছে। এছাড়া প্রায় প্রতিটি ঘরের টিনে মরিচা পড়ে ছিদ্র হয়ে গেছে। উপর থেকে পানিও পড়ে ঘরের মধ্যে। প্রকল্পের মধ্যে অবস্থিত এক বিঘা জমির ওপরে শুকিয়ে যাওয়া পুকুরটি খনন করা প্রয়োজন। আর্সেনিক মুক্ত একটি গভীর নলকূপ স্থাপন করা হলেও তা নষ্ট হয়ে গেছে।

বর্তমানে ব্যারাকে ৫ শতাধিক লোক বাস করেন। যার মধ্যে ৩৫২ জন ভোটার রয়েছেন। কাজের অভাবে তাদের জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে তিন বেলা খাবার জোগাড় করা। রঘুনাথপুর অশ্রয়ন প্রকল্পের বাসিন্দা কাউছার আলী জানালেন, ২ ছেলে ও ২ মেয়ে সংসারে তার। ২ ছেলের বিয়ে দিয়েছেন। একটি ঘরে থাকা হয়না। তাই যারা ঘর ছেড়ে চলে গেছে তাদের ঘর দখল নিয়ে বাস করছেন। কিন্তু ঘর তাদের নামে বরাদ্ধ দেয়া হয়নি। মুক্তিযোদ্ধা আজের আলী জানান, তার ৩ ছেলে ও ৩ মেয়ে। তাদের থাকার জায়গা হয়না। তাই তিনি পার্শ্ববর্তী আমঝুপি গ্রামের একটি খাস জমিতে বসবাসের জাগয়া করে নিয়েছেন। তবে সে জমিও তিনি লিজ পাননি।

আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দারা জানান, তাদের ব্যবসা বাণিজ্য করে খাওয়ার জন্য ব্যক্তি বিশেষ ৪ হাজার, ৭ হাজার ও ১০ হাজার করে ব্যাংক ঋণ দিয়েছিলো। কিন্তু অনেকে তা পরিশোধ করতে না পারায় এখন আর কাউকে ব্যাংক ঋণ দেয়া হয় না।

অধিবাসীরা আরো জানালেন, আশ্রয়ন প্রকল্পে কোনো মসজিদ ছিলো। তারা নিজেদের প্রচেষ্টায় একটি মসজিদ করেছেন। কিন্তু ছাদ ঢালাই দিতে পারেননি। মসজিদে নেই বিদ্যুত ব্যবস্থা। সরকার কমিউনিটি সেন্টার করে দিয়েছিলেন। স্থায়ী স্কুল ঘর নেই ব্যারাকে। টিনের ছাউনি ও চাটাইয়ের বেড়া বিশিষ্ট একটি অস্থায়ী স্কুল ছিলো। প্রতিবছর তা ঝড়ে উড়ে যায়। তাই বর্তমানে যেমন-তেমনভাবে স্কুলটি চলে কমিউনিটি সেন্টারে। সেখানে রয়েছেন আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৭০ জন শিক্ষার্থী এবং দুজন মহিলাসহ মোট ৪ জন শিক্ষক। কিন্তু বেতন না পাওয়ায় তাদেরও পাঠদানে অনীহা এসে গেছে।

এদিকে কোনো সুযোগ সুবিধা না থাকায় একমাত্র স্কুলটিতে ভালো লেখা-পড়া হয়না হওয়ার ফলে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে ছেলে-মেয়েরা। খালি গায়ে সারাদিন মনের আনন্দে খেলে বেড়ায় তারা। পড়ালেখার সুযোগ না থাকায় অবহেলার মাঝে বেড়ে উঠছে এসব শিশু। তাদের কচি মনের আনন্দ একদিন কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়াবে এমনটি উপলব্ধি করতে পারছেন বাবা-মা। কিন্তু করার কিছু নেই। নিরাপত্তার অভাবে মাঠের ভিতরের রাস্তা দিয়ে দূরের স্কুলেও ছেলে-মেয়েদের পাঠাতে চাননা অভিভাবকেরা। অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দায়মুক্ত হচ্ছেন বাবা-মা। কেউ কেউ ঘরে বসে শিশুদের অক্ষর জ্ঞান দেয়ার চেষ্টা করে। বিদ্যুত চলে গেলে ফাঁকা মাঠের ভেতর থাকতে হয় অন্ধকারে। ফলে রাতের আঁধারে আতঙ্ক বিরাজ করে প্রকল্পের অধিবাসীদের মাঝে। চুরি-ডাকাতির ঘটনাও ঘটেছে কয়েকবার। তাদের আরো অভিযোগ ব্যারাকের লোকজন ব্যারাক পাহারা করলে দুষ্কৃতীকারীরা বোমা ছুঁটে মারে। সন্ত্রাসীরা অনেক সময় ভয়-ভীতি দেখিয়ে প্রকল্পের অধিবাসীদের কাছ থেকে বিভিন্ন সুবিধা নিয়ে থাকে। নানা সমস্যার মাঝেও আশ্রয়ন প্রকল্পের অধিবাসীরা স্বপ্ন দেখছে, এখানে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হলে তাদের ভবিষ্যত প্রজন্মরা সমাজের বোঝা না হয়ে পড়ালেখা করে মানুষ হবে এবং দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে। এ মুহূর্তে প্রকল্পবাসীরা মনে করেন আশ্রয়ন প্রকল্পে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণ, পুকুরটি পুনঃ সংস্কার, মসজিদের ছাদ নির্মান ও বিদ্যুত সংযোগ এবং কবরস্থান ঘেরা জরুরি।

এ ব্যাপারে মেহেরপুর সদর উপজেলার আমঝুপি ইউপি চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম বলেন, রঘুনাথপুর আশ্রয়ন প্রকল্পের সমস্যা অনেক। এগুলো সরকারিভাবে ছাড়া সমাধান করা সম্ভব না। এ ব্যাপারে আশ্রয়ন প্রকল্পের সভাপতি সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও সদস্য সচিব সহকারি কমিশনার ভূমির সাথে কথা বলা হবে।

রঘুনাথপুর আশ্রয়ন প্রকল্পের সভাপতি নবাগত সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার কানিজ ফাতেমা তানিয়া জানান, তিনি প্রকল্পটি দেখেছেন ও প্রকল্পের বাসীন্দাদের সাথে কথা বলেছেন। মতভেদ থাকায় সমস্যার কথা তুলে ধরার জন্য তাদেরকে তিনি অফিসে আসতে বলেছেন। তিনি আরো বলেন, যেসব পরিবার প্রয়োজনে একাধিক ঘর দখল রেখেছেন। আমরা চেষ্টা করছি পূর্বের বরাদ্দ বাতিল করে নতুন করে বরাদ্ধ দেয়া যায় কি-না? এছাড়া তাদের কথা শুনে তাদের অভাব-অভিযোগ সরকারিভাবে মিটানোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।

Leave a comment