প্রশ্নফাঁসে প্রশ্নবিদ্ধ সব পরীক্ষাই : প্রতিকার মিলছে না

 

প্রশ্নপত্র ফাঁসের রাহু থেকে মুক্ত হতে পারছে না প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষাও। টানা তিন বছর এ পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ও প্রশাসনকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে। শুধু এ পরীক্ষাই নয়, জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসি, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি, বিসিএসসহ বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষাও প্রশ্নপত্র ফাঁসের কবলে পড়েছে। সম্প্রতি পরীক্ষা শুরুর সাথে সাথেই প্রশ্ন ফাঁসের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ মিলছে। যদিও শিক্ষা মন্ত্রণালয় কখনোই বিষয়টি সরাসরি স্বীকার করেনি, করে না। অনেকেরই অভিমত প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টি স্বীকার না করা মানে, দায় এড়ানোরই কৌশল।

সাধারণত পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও বাছাইয়ের পর লটারির মাধ্যমে নির্ধারিত দুই বা ততোধিক সেট প্রশ্ন ছাপানোর জন্য বিজি প্রেসে পাঠানো হয়। বিজি প্রেস থেকে সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর বা বোর্ডের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র নির্দিষ্ট কেন্দ্রে যায়। এ প্রক্রিয়ার যেকোনো পর্যায়েই প্রশ্নপত্র ফাঁস করা সম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রশ্ন ফাঁসের পর জালিয়াতকারীরা পরীক্ষার্থী বা তাদের অভিভাবক কিংবা ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সাথে যোগাযোগ করে। এরপর সমঝোতায় পৌঁছুলে ছাপা অক্ষরে কিংবা সেলফোনে এসএমএসের মাধ্যমে নির্দিষ্ট পরীক্ষার্থীর কাছে প্রশ্ন ফাঁস করে। ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটেও প্রশ্নফাঁস করা হয়। এবার প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় বিভিন্ন নামের ওয়েবসাইটে ‘সাজেশন’ নামে প্রশ্ন ফাঁস করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ধরনের ওয়েবসাইটগুলো অল্প কয়েকদিন আগে চালু করা হয় বলে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। যদিও প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় ফেসবুক ও ইন্টারনেটে প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান বলেছেন, কোথাও প্রশ্ন হুবহু ছাপিয়ে দিচ্ছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কোনো কোনো জায়াগায় ষাট শতাংশ ও সত্তর শতাংশ প্রশ্নপত্র কমন পড়ার খবর পাওয়া গেছে। এটা প্রশ্নপত্র না সাজেশন তা জানি না।

শিক্ষা প্রশাসন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্দিষ্ট পরীক্ষার আগের দিন বা তারও আগে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়। অধিকাংশ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কয়েক দফা সময় বাড়িয়ে নিয়ে তারা প্রতিবেদনও জমা দেয়। অনেক ক্ষেত্রে তদন্ত কমিটি গঠন কিংবা তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়া হয় না। আবার জমা দেয়া প্রতিবেদনের সুপারিশ বাস্তবায়নে আন্তরিক ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনে অনাগ্রহ রয়েছে। এছাড়া ফাঁস হওয়া প্রশ্নেই একাধিক পরীক্ষা গ্রহণের নজিরও রয়েছে। প্রশ্নফাঁস পরিস্থিতিকে ‘মহামারী’ ও ‘উদ্বেগজনক’ আখ্যা দিয়ে শিক্ষাবিদ ও অভিভাবকরা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, সরকার এবং প্রশাসন সংশ্লিষ্টদের প্রশ্নফাঁসের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ কঠোর অবস্থান নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ দাবি বা আহ্বান জাতির স্বার্থেই। প্রশ্নপত্র ফাঁস শিক্ষার্থীদের মনে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। যার খেসারত জাতিকেই দিতে হবে। কালবিলম্বে সর্বনাশ পোষানো অসম্ভব হয়ে পড়বে। এ তাগিত দায়িত্বশীলরা কতোটুকু উপলব্ধি করছে তা স্পষ্ট নয়। ফলে শিক্ষাসচেতন মহলে বাড়ছে দীর্ঘশ্বাস। আইন অনুযায়ী- প্রশ্নপত্র ফাঁস, প্রকাশ বা বিতরণের সঙ্গে জড়িত থাকার শাস্তি ন্যূনতম তিন বছর থেকে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ডসহ অর্থদণ্ড। পাবলিক পরীক্ষাসমূহ (অপরাধ) আইন, ১৯৮০ এবং সংশোধনী ১৯৯২ আইনে শাস্তির এ বিধান রয়েছে। আইনটি প্রণয়নের পর বিসিএসসহ বিভিন্ন পরীক্ষায় অন্তত ৭০টি প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত আইন মোতাবেক দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির কোনো নজির নেই।

দুর্বৃত্ত ও জালিয়াতচক্র নানাভাবে প্রশ্ন ফাঁসের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। এতে ঘটনার মূল উত্স অশনাক্তই থেকে যায়। এ ব্যাপারে এখনই কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করতে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সকল কর্তৃপক্ষের আশু পদক্ষেপ প্রয়োজন। অস্বীকার করে বা কোনো অজুহাতে বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া জাতির জন্য কল্যাণকর হবে না। প্রশ্নপত্র ফাঁসের কারণে লেখাপড়ায় শিক্ষার্থীদের মনোনিবেশ শুধু বিঘ্নিতই হবে না, শিক্ষাজীবনেই দায়িত্বশীলদের প্রতি শিক্ষার্থীদের আস্থাহীনতা সৃষ্টি হবে। জাতির জন্য এটা আত্মঘাতি। শিক্ষার্থীদের নীতিবান করতে হলে সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতা পরিহার অপরিহার্য।