ইরাকে দুঃস্বপ্নের বেড়াজালে বন্দী মেহেরপুর জেলার অর্ধশত অধিবাসী

কাতারের কথা বলে দেড় শতাধিক বাংলাদেশিকে ইরাকে নিয়ে ফেলা হয়েছে ভয়াবহ নির্যাতনের মাঝে

 

মাজেদুল হক মানিক: ইরাকের নাজাব শহরে বন্দী রয়েছেন দেড় শতাধিক বাংলাদেশি। এদের মধ্যে মেহেরপুর জেলার ৪২ জনকে কাতার পাঠানোর কথা বলে ইরাকে পাঠিয়েছে দালালচক্র। সেখানে পাচারকারীচক্রের হাতে এখন নির্মম নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন তারা। নির্যাতনের শিকার ইরাক প্রবাসীদের নিকটজনেরা এসব তথ্য জানিয়ে তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার আকুতি জানিয়েছেন।

সংসারের সুখ আর স্বচ্ছলতা আনার স্বপ্নে বিদেশে গমন করেছিলেন মেহেরপুরের ৪২ যুবক। কাতারে মোটা অঙ্কের বেতনে চাকরির শর্তে তারা স্থানীয় দালালদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন ৪ লাখ করে টাকা। তবে প্রতারক দালালচক্রের সদস্যরা তাদেরকে পাঠিয়েছে ইরাকের পাচারচক্রের কাছে। চাকরির পরিবর্তে ঠাঁই হয়েছে নাজাব শহরের একটি বন্দিশালায়। টেলিফোনে এমন অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা।

মেহেরপুর সদর উপজেলার টেঙ্গার মাঠ, গাংনী উপজেলার কাজিপুর, সাহেব নগরসহ কয়েকটি গ্রামে এখন কেবলই কান্নার রোল। সাত মাস আগে কাতার নেয়ার কথা তাদেরকে ইরাকের নাজাব শহরে নিয়ে বিক্রি করে দেয়া হয়। সেখানে ধূ ধূ মরুভূমিতে একটি ঘরে বন্দি অবস্থায় নির্মম নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন হতভাগ্য বাংলাদেশিরা। মোবাইলফোনে দূর থেকে পরিবার ও স্বজনদের কাছে ভেসে আসছে দুঃস্বপ্নের গল্পগুলো।

নাজাব শহরের বন্দিশালা থেকে মোবাইলফোনে গাংনী উপজেলার কাজিপুর গ্রামের সুজন ও কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলা শহরের আব্দুল লতিফ জানান, সেখানে মেহেরপুর জেলারসহ বিভিন্ন জেলার অন্তত দেড় শতাধিক যুবককে আটকে রাখা হয়েছে। কেড়ে নেয়া হয়েছে পাসপোর্ট-ভিসা। এদের মধ্যে কয়েকজন গোপনে মোবাইলফোনে বাড়ির লোকজনের সাথে কথা বলে তাদের কষ্টের কথা জানিয়েছেন। দেশে ফিরতে চাইলে তাদের ওপর চালানো হচ্ছে অমানবিক নির্যাতন এবং হত্যার হুমকি অব্যাহত রয়েছে। গোপনে তারা ইরাকে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসে যোগাযোগও করে। দূতাবাস তাদেরকে দেশে ফেরতের আশ্বাস দিলেও তা কার্যকর হযনি। তাই আটকে পড়া লোকজনকে দেশে ফেরাতে জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেছেন ভুক্তভোগী প্রবাসীদের পরিবারের সদস্যরা। তারা আরো জানান, ইরাকের স্থানীয় কয়েকজন দালাল তাদের আটকে রেখেছেন। দিনে মাত্র একটি রুটি দেয়া হয়। গত কয়েক দিন ধরে তারা অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছেন।

আর্থিক স্বচ্ছলতার জন্য ভিটে মাটি বিক্রি এবং ঋণ নিয়ে সাত মাস আগে বিদেশে গেছেন তারা। এজন্য তারা মাথাপিছু দালালদের ৪ লাখ টাকা দিয়েছেন। ঢাকার গুলশান-২ এ অবস্থিত ক্যারিয়ার ওভারসিজ কনসাল্টেন্ট লিমিটেডের মাধ্যমে তাদেরকে কাতারে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু কাতারে না নিয়ে ইরাকের নাজাব শহরের আবু তোরাব হাউজিং কোম্পানিতে কাজের কথা বলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ওই কোম্পানির কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাননি ভুক্তভোগীরা। অন্যদিকে ঋণ ও ভিটেমাটি বিক্রি করায় অসহায় হয়ে পড়েছেন পরিবারের সদস্যরা। ইরাকে অবস্থানরত স্বজনদের মতোই তারা অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছেন। অন্যদিকে স্বজনের বিপদ সঙ্কেত তাদের ব্যাকুল করে তুলেছে। চরম দৈন্যদশা বিরাজ করছে তাদের পরিবারে।

এলাকায় খোঁজ নিয়ে সাক্ষাৎ হয় সাহেবনগর গ্রামের আদমব্যবসায়ী মাহিরুল ইসলামের সাথে। ইরাকে বন্দী কাজিপুরের সুজনসহ চারজনকে তিনি পাঠিয়েছেন। তবে প্রবাসীদের নির্যাতনের কথা অস্বীকার করলেন তিনি। বললেন তাদেরকে অন্য কোম্পানিতে চাকরির ব্যবস্থা করা হয়েছে।

এদিকে আটকে পড়া লোকজনকে দেশে ফিরিয়ে আনতে ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ১৬ জন মেহেরপুর জেলা প্রশাসকের কাছে দালালদের বিরুদ্ধে অভিযোগসহ আবেদন করেছেন। আবেদন প্রাপ্তি স্বীকার করে জেলা প্রশাসক মাহমুদ হোসেন দৈনিক মাথাভাঙ্গাকে জানান, বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে। সত্যতা মিললে স্বরাষ্ট ও পররাষ্টমন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগের পাশাপাশি অভিযুক্ত দালালদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।