মহাসিন আলী: মেহেরপুরে তৈরি হচ্ছে সোলার কম্পোস্ট ফার্টিলাইজার (জৈব সার)। একবার এ জৈব সার জমিতে প্রয়োগ করলে দ্বিতীয়বার ফসলের জন্য জমিতে আর কোনো সার দেয়া লাগে না। এ সার জমিতে দেয়া হলে ফলন বৃদ্ধি ও উৎকৃষ্ট মানের হয়। ফসলে কীটপতঙ্গের উপদ্রবও কম হয়। যে কারণে দিন দিন মেহেরপুরে এ সারের চাহিদা ও উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কীট-পতঙ্গের অত্যাচার কম এবং ফলন বৃদ্ধি ও উৎকৃষ্ট মানের হওয়ায় ইতোমধ্যে এ সার তৈরিতে বিভিন্ন দপ্তরের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও চাষিদের পুরস্কৃত করা হয়েছে।
মেহেরপুর জেলা শহরের স্টেডিয়ামপাড়ার বাসিন্দা মো. আব্দুল্লাহেল বাকি সোলার কম্পোস্ট ফার্টিলাইজারের উদ্ভাবক। দেশের কৃষির উন্নয়নে ব্রিটিশ-আমেরিকা ট্যোবাকোতে চাকরির অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি এ সার তৈরিতে মনোনিবেশ করেন। আব্দুল্লাহেল বাকির তত্ত্বাবধানে মেহেরপুর শহরের উপকণ্ঠ খন্দকারপাড়ার চাষি মো. আব্দুল্লাহ তার বাড়িতে সোলার কম্পোস্ট ফার্টিলাইজার তৈরি করছেন। তিনি নিজের ফসলি জমিতে এ সার প্রয়োগ ও সার বিক্রি করে ব্যাপক লাভবান হচ্ছেন। চাষিরাও এ সার ব্যবহার করে সুফল পাচ্ছেন।
সরেজমিনে খন্দকারপাড়ার আব্দুল্লাহর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় সোলার কম্পোস্ট ফার্টিলাইজার তৈরির কারখানা। এ সময় মেহেরপুর সদর উপজেলা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা খোদাজ্জেল হোসেন সাথে ছিলেন। আব্দুল্লাহ এ সার তৈরির ওপর ধারণা দিতে গিয়ে দেখান- ৭ ফুট লম্বা, ৫ ফুট প্রস্থ ও ৩ ফুট গভীরতার একটি কম্পোস্ট পিট অর্থাৎ মাটির গর্ত। সারের উপাদানের কথায় তিনি জানান, পরিমাণ মতো গবর, খৈল, হাড়ের গুঁড়া, হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা, বাদুরের বিষ্ঠা (সম্ভব হলে), সবুজ লতা-পাতা (যেমন- ধনচে, ইপিল-ইপিল পাতা, কপির পাতা ইত্যাদি), নিমপাতা, আখের পাতা, কচুরিপনা, তামাকের ডাটা চূর্ণ, বিচুলি চূর্ণ, নিমপাতা, কলাই ও লালশাকের ভূষিসহ প্রায় ১৫টি দ্রব্য পানিতে মেশাতে হবে। এরপর মাটির গর্তের মধ্যে পলিথিনের ওপর রেখে পালিথিন দিয়ে সমস্ত মিশ্রিত উপাদান ঢেকে দিতে হবে। তার ওপর ভিজা চটের বস্তা দিয়ে ঢেকে দিতে হয়। পঁচনের গতি বৃদ্ধির জন্য মিশ্রণে ৫ কেজি করে ড্যাব ও ইউরিয়া সার দেয়া যেতে পারে। ৩০ দিনের মাথায় এ পলিথিনে ঢাকা মিশ্রন উল্টে দিয়ে পুনরায় মাটির গর্তে রাখতে হবে। এরপর ৩০ দিন পরে মাটির গর্ত হতে তৈরি সোলার কম্পোস্ট ফার্টিলাইজার (জৈব সার) তুলে জমিতে ব্যবহার করা যাবে। এভাবে বছরে ৪ থেকে ৫ বার একই গর্তে এ সার তৈরি সম্ভব। প্রতিবার প্রায় দু টন করে সোলার কম্পোস্ট ফার্টিলাইজার উৎপাদন করাও সম্ভব।
মেহেরপুর সদর উপজেলার শ্যামপুর গ্রামের চাষি হান্নান মিয়া ও ভিকু মিয়া বলেছেন, তারা ৮ বিঘা জমিতে রাসায়নিক সার ব্যবহার করায় পোকা-মাকড় ও ভাইরাসে ফসল আক্রান্ত হন। যে কারণে ভালো ফসল পাননি। কিন্তু ওই জমির পাশে ৪ বিঘা জমিতে সোলার কম্পোস্ট ফার্টিলাইজার ব্যবহার করে রোগমুক্ত দ্বিগুণ ফসল পেয়েছেন। দফরপুর গ্রামের প্রকৌশলী হাজি নূর ইসলাম জানান, তিনি পরীক্ষামূলকভাবে এক বিঘা জমিতে এই সার ব্যবহার করে পাট চাষ করেছিলেন। এতে তিনি আশাতীত ফলন পেয়েছেন। এরপর ওই জমিতে আর সার ব্যবহার না করেই কলাই চাষ করেন। এতেও তিনি খুব ভালো ফলন পেয়েছেন। সফলতা পাওয়ায় তিনি এ সার ব্যবহার করে চলতি রবি মরসুমে অন্য জমিতে সরিষার আবাদ করেছেন। এতেও তিনি ব্যাপক লাভবান হবেন বলে আশাবাদী। খন্দকারপাড়ার আব্দুল্লাহ জানান, তিনি এক বিঘা জমিতে এ সার ব্যবহার করে পাটচাষ করেছিলেন। পাট ১৬ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়েছিলো এবং প্রতি বিঘায় ১৬ মণ করে পাট পেয়েছেন। যদিও এ বছর আবহাওয়া বৈরি ছিলো। টেংগার মাঠে ইয়াকুব আলী জৈব সার ব্যবহার করে গোল আলুচাষ করেছিলেন। তিনি প্রতি বিঘায় ১৭০ মণ থেকে ১৮০ মণ ফলন পেয়েছেন।
সোলার কম্পোস্ট ফার্টিলাইজারের উদ্ভাবক আব্দুল্লাহেল বাকি বলেন, এ সার ব্যবহারের ফলে মাটিতে কেঁচো, ব্যাকটেরিয়া, অণুজীব জীবিত থাকে এবং গাছের খাদ্য গ্রহণে সহযোগিতা করে। মাটিতে অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, ক্যালসিয়ামসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় উপাদান বৃদ্ধিতে সহযোগিতা করে। ক্ষতিকারক হিসেবে বেশি বেশি রাসায়নিক সার ব্যবহার না করার জন্য তিনি চাষিদের অনুরোধ করেন।
মেহেরপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক শ্রী চৈতন্য কুমার দাস এ সার ব্যবহারে কৃষক সফলতা পাচ্ছেন জেনে তিনি সন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি জমিতে বেশি বেশি জৈব সার ব্যবহারে জন্য চাষিদের পরামর্শ দেন। ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড মেহেরপুর শাখার ব্যবস্থাপক এএইচএম মোস্তফা কামাল এ সার ব্যবহারকারীদের সাথে সম্প্রতি খন্দকারপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মতবিনিময় করেন এবং ফলস দেখে খুশি হয়ে চাষিদের পুরস্কৃত করেন। তিনি চাষিদের সহজ শর্তে ঋণ দিতেও আগ্রহী হন।