কূটনীতিক সম্মেলনে ৯ দফা ঘোষণা : গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও অধিকার রক্ষার আহ্বান

স্টাফ রিপোর্টার: উভয় দেশে ‘গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও অধিকার সংরক্ষণ’-এর আহ্বানসহ ৯ দফা ঢাকা ঘোষণার মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে দু’দিনের বাংলাদেশ-ভারত কূটনীতিক সম্মেলন। গতকাল দুপুরে ফাস্ট ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ হাইকমিশনার’স সামিটে অংশ নেয়া কূটনীতিকদের উপস্থিতিতে সংবাদ সম্মেলনে এর সফল সমাপ্তি ঘটে। এর আগে আয়োজনের দ্বিতীয় ও শেষদিনে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কয়েক দফা রুদ্ধদ্বার আলোচনায় যোগ দেন দু’দেশের কূটনীতিকরা।

সেখানে প্রস্তাবিত ঢাকা ঘোষণাও চূড়ান্ত হয়। সংবাদ সম্মেলনে এক পৃষ্ঠার লিখিত ওই ঘোষণা পাঠ করেন আয়োজনের সমন্বয়কারী ও সঞ্চালক প্রফেসর ড. ইমতিয়াজ আহমেদ। পরে তিনি ও উপস্থিত সাবেক হাইকমিশনাররা সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। শুক্রবার দিনভর তিনটি ওয়ার্কিং সেশনের আলোচনা গণমাধ্যমের জন্য উন্মুক্ত থাকলেও গতকালের পুরো আয়োজন ছিল রুদ্ধদ্বার। সেখানে দীর্ঘ সময় ‘বিশেষ’ কি আলোচনা হয়েছে জানতে চান সাংবাদিকরা। জবাবে ড. ইমতিয়াজ জানান, নতুন কিছু নয়, উদ্বোধনী দিনে যে বিস্তৃত আলোচনা হয়েছে গতকাল তার সারসংক্ষেপ তৈরি করা হয়েছে মাত্র। যে সব ইস্যুতে দু’দেশের কূটনীতিকরা ঐকমত্যে পৌঁছেছেন কেবল তা দিয়েই ঢাকা ঘোষণা সাজানো হয়েছে বলেও দাবি করা হয়।
ঘোষণায় যা আছে: ঘোষণায় বলা হয়, এই প্রথম দু’দেশের সাবেক হাইকমিশনাররা একসঙ্গে মিলিত হলেন। সেখানে দু’দেশ তো বটেই, তারা দক্ষিণ এশিয়ার অভিন্ন ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও দর্শনের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনায় এনেছেন। বাংলাদেশ ও ভারতের বিদ্যমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করার যে আকাঙক্ষা সেটিও তুলেছেন। দু’পক্ষই স্বীকার করেছে পরস্পরের প্রতি আস্থা, সদ্ভাব ও অংশীদারিত্ব-ই দীর্ঘদিনের ওই বন্ধুত্বের ভিত্তি হওয়া উচিত। উভয় দেশের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও অধিকার সংরক্ষণের আহ্বান জানিয়ে তারা বলেছেন, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের যে কোন কাজের লক্ষ্য যেন হয় দেশ দু’টির জনগণের সর্বোচ্চ কল্যাণ নিশ্চিত করা। সাম্য-সমতা-স্থিতিশীলতা-সামাজিক ন্যায়বিচার ও বৈচিত্র্যগত ভিন্নতার প্রতিও সম্মান প্রদর্শনের কথা বলা হয়েছে ওই ঘোষণায়। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নে দুই সরকারের নেয়া বহুমুখী উদ্যোগের বিষয়টি নোটে নেয়া হয়েছে বলেও ঘোষণায় উল্লেখ করা হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে উল্লিখিত বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করেন প্রফেসর ড. ইমতিয়াজ। বলেন, দু’পক্ষই মনে করে, এ সবের চর্চা যত বেশি হবে, সম্পর্ক তত বেশি উন্নত হবে।

ঘোষণার শুরুতে আনুষ্ঠানিকভাবে আয়োজকদের ধন্যবাদ জানানো হয়। দ্বিতীয়ত, দু’দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট অমীমাংসিত ইস্যু ও বিরাজমান সমস্যাগুলোর সমাধানের তাগিদ দেয়া হয়। তৃতীয়ত, জনগণ পর্যায়ে যোগাযোগ বৃদ্ধি এবং সচেতনতা ও পারস্পরিক আস্থা বাড়াতে ছাত্র, শিক্ষাবিদ, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া, করপোরেট সেক্টর, পরিবেশবিদ এবং অন্য স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে তথ্য ও যোগাযোগ বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। চতুর্থ, দ্বিপক্ষীয় ব্যবসা-বাণিজ্য উদারীকরণ এবং পণ্যের আদান-প্রদানের পথ উন্মুক্ত করার তাগিদ দেয়া হয়। পঞ্চম, নিরাপত্তা সহযোগিতা জোরদারে দুই সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। ষষ্ঠ, প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযথ উত্তোলন ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে দু’দেশের পরস্পরের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়াদি বজায় রেখে সহযোগিতার ক্ষেত্র তৈরি করার জন্য অনুরোধ জানানো হয়। সপ্তম, সার্ক ও বিমসকের চেতনায় উপ-আঞ্চলিক ও আঞ্চলিক পর্যায়ে সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং বিনিয়োগ ও আর্থিক সেবাসহ পণ্য ও সেবার অবাধপ্রবাহসহ দু’দেশের মধ্যে ব্যাপকভিত্তিক অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততা বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। আষ্টম, বাংলাদেশ ও ভারতের হাইকমিশনারদের একটি এলামনাই বডি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। কমিটি নিয়মিতভাবে নিজেদের ও অন্য স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে অভিজ্ঞতা বিনিময় করবে। দ্বি-বার্ষিক সম্মেলন করার মধ্য দিয়ে তাদের অভিজ্ঞতা বিনিময় করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সর্বশেষ ৯ নম্বর দফায় সাবেক কূটনীতিকরা তাদের পরবর্তী সামিট আগামী ২০১৬ সালে ভারতে আয়োজনের বিষয়ে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সেটি তুলে ধরা হয়েছে। ঢাকা ঘোষণাকালে ভারতের সাবেক হাইকমিশনার মচকুন্দ দুবে, আইএস চাডা, দেব মুখার্জি, বীণা সিক্রি এবং পিনাক রঞ্জন এবং ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক হাইকমিশনার তারিক করিম, ফারুক সোবহান, হারুন-উর-রশিদ, মোস্তফা ফারুক মোহাম্মদ ও হুমায়ুন কবির উপস্থিত ছিলেন।

কূটনীতিকদের মতামত, মূল্যায়ন ও প্রতিক্রিয়া: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে দু’দিনব্যাপী হাই কমিশনার সম্মেলনে নির্ধারিত আলোচনার বাইরে সাইড লাইনে গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলেন তারকা কূটনীতিকরা। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক, তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষর এবং স্থল সীমান্ত চুক্তির বাস্তবায়ন ঝুলে যাওয়া, ৫ই জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনে ভারতের সমর্থন ও দেশটির ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হওয়াসহ নানা বিষয়ে তারা তাদের মূল্যায়ন, মতামত ও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। সমাপনীতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ওই ইস্যুগুলো সম্পর্কে প্রশ্নও আসে। কূটনীতিকরা তার জবাব দেন। ভারত ও বাংলাদেশে যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও অধিকার রযেছে তা যথাযথভাবে সংরক্ষণের জোর তাগিদ দিয়েছেন ঢাকা ও দিল্লির কূটনীতিকরা। তাদের দু’দিনের আলোচনার ফল নিয়ে যে ‘ঢাকা ঘোষণা’ তৈরি করেছেন সেখানে এটি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও অধিকার সংরক্ষণের বিষয়টি কেন এত গুরুত্ব পেলো? জানতে চাইলে বাংলাদেশী কূটনীতিক হুমায়ুন কবীর বলেন, ভারত একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। বাংলাদেশ তার ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী। এখানেও গণতন্ত্র বজায় থাকুক, গণতান্ত্রিক যে মূল্যবোধ ও অধিকার রয়েছে তা সংরক্ষণ হোক এটা সবার চাওয়া। ভারতীয় কূটনীতিকরা এ পয়েন্টে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন বলে জানান কলকাতায় দায়িত্ব পালনকারী ওই কূটনীতিক। ৫ই জানুয়ারি নির্বাচনে ভারতের সমর্থনের জন্য দেশটির ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বলে মনে করেন ওই কূটনীতিক। উদ্বোধনী দিনেই এ নিয়ে ভারতীয় কূটনীতিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বক্তৃতাও করেন তিনি। উন্মুক্ত সেশন হওয়ায় ভারতীয় কূটনীতিকরা প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু সম্মেলনের সাইড লাইনে যত আলোচনা বা কথাবার্তা হয়েছে সেখানে নির্বাচন প্রসঙ্গটিই মুখ্য ছিল। ভারতীয় কূটনীতিক পিনাক রঞ্জন অবশ্য শুরুর দিনেই এ নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন। গতকাল এক প্রশ্নের জবাবে বীণা সিক্রি বলেন, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতায় নির্বাচনটি হয়েছে। এখানে যে সরকার রয়েছে ভারত তার সঙ্গে কাজ করছে। ঢাকায় দায়িত্ব পালনকারী আই এস চাডার কাছে সাংবাদিকরা জানতে চেয়েছিলেন একতরফা ওই নির্বাচনে ভারতের সমর্থন দেয়ায় দেশটির ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে মর্মে যে কথা এসেছে এ ব্যাপারে তার প্রতিক্রিয়া কি? জবাবে তিনি বলেন, ভারত একটি সাইড নিয়েছিল। এখানে আওয়ামী লীগের সঙ্গে কংগ্রেসের একটি সখ্য ছিল। এ জন্য এটি হয়েছে। বাংলাদেশে যে সরকারই আসুক তার সঙ্গে দিল্লি কাজ করবে বলে মনে করেন তিনি। পরস্পরকে বুঝতে এবং দু’দেশের সম্পর্ক এগিয়ে নিতে দেশ দু’টির জনগণের সুবিধা-অসুবিধা ও চাওয়া-পাওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নেয়ার তাগিদ দেন হুমায়ুন কবীর। তার মতে কেবল সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের জনগণ কি ভাবছে ভারতকে তা বুঝতে হবে। দেশের মানুষের বিরুদ্ধে গিয়ে সম্পর্ক এগিয়ে নেয়া যাবে না বলেও উল্লেখ করেন তিনি। সম্মেলনে আলোচনার বিষয়টি দুই সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায়ে কিভাবে নিয়ে যাওয়া হবে? এমন প্রশ্নও আসে সংবাদ সম্মেলনে। জবাবে প্রফেসর ইমতিয়াজ বলেন, ঢাকা ঘোষণার একটি কপি দুই সরকারের নীতিনির্ধারকদের কাছে দেয়া হবে। যা আলোচনা হয়েছে, আগামীতে যা আলোচনা হবে-সবই সরকারি পর্যায়ে পৌঁছানো হবে। এটি তাদের কাজে লাগবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। তবে ইমতিয়াজ বলেন, যা আলোচনা করছি তা হয়তো কাল বা আগামী পরশু বাস্তবায়ন হবে না। আমাদের বিশ্বাস নীতিনির্ধারকদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে এটি সহায়ক হবে।

তিস্তা ও স্থল সীমান্ত চুক্তির বাস্তবায়ন: চুক্তি না হওয়া বা চুক্তি হওয়ার পরও বাস্তবায়ন না হওয়া সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করে বলে মনে করেন ভারতীয় কূটনীতিক দেব মুখার্জি। তবে তিনি আশাবাদী দেশটির প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সফরের মধ্য দিয়ে এটি বাস্তবায়নের দরজা খুলছে। বিভিন্ন ইস্যুতে জয়েন্ট স্টেটমেন্ট হয়েছে। সেখানকার সব বিষয় সফলভাবে মাঠে গড়ায়নি এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন, তিস্তা ও স্থল সীমান্ত বাস্তবায়নে ভারত প্রতিশ্রুতবদ্ধ। তিস্তায় পশ্চিমবঙ্গের আপত্তি এবং অন্য ইস্যুতে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ভিন্নমত দায়ী বলে মনে করেন তিনি। আই এস চাডা-ও একই মত দেন। তবে বিদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে এর চেয়ে বেশি কোন কিছু বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন তিনি।