তাছির আহমেদ: ‘নবীর শিক্ষা করো না ভিক্ষা মেহনত কর সবে।’ গ্রামের মসজিদের ইমামের কাছে নবীর এ বাণী শোনার পর প্রতিবন্ধী আব্দুর রাজ্জাক বাদামের ঝুঁড়ি গলায় ঝুলিয়ে পথে পথে বাদাম বিক্রি করে জীবন সংগ্রামের যুদ্ধ করে টিকে আছেন। দামুড়হুদা পোড়াপাড়া গ্রামের প্রতিবন্ধী আব্দুর রাজ্জাক, প্রতিদিন সকাল থেকে দুপুর কোনো কোনো দিন গড়ায় বিকেল, এ অবধি সময়ে বাদামভাজা বিক্রি করে যা আয় হয়, তা দিয়েই তিনি তার স্ত্রী ও দু কন্যাসন্তানকে নিয়ে পেয়েছেন বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা। বাদাম বিক্রির ফলে এলাকার অনেকেই তাকে সমাদর করেন, আর বলেন প্রতিবন্ধী হয়েও তুই ভিক্ষার ঝুলি হাতে নিসনি। এলাকার মানুষের এ সমাদরে এ প্রতিন্ধীর বুকখানি ভরে ওঠে। তিনি দামুড়হুদা উপজেলার পোড়াপাড়া গ্রামের মৃত মহাম্মদ আলীর ছেলে প্রতিবন্ধী আব্দুর রাজ্জাক (৪০)।
প্রতিবন্ধী রাজ্জাক জানান, বয়স যখন ১৩/১৪ তখন খেতাম পরিবারের লাথি-ঝাঁটা। কী হবে আমার এ পঙ্গু জীবন, কী নিয়ে বাঁচবো, আর কী খাবো, এ চিন্তায় আমি ছিলাম বিভোর। গ্রামের চায়ের দোকানে বড় আশা নিয়ে বসে আছি, কেউ একটা বিস্কুট দিলে সেটি খাবো। আমাকে দেখে মুরব্বিরা আলোচনা করতেন ভিক্ষা করা পাপ। আমার একটি হাত ও একটি পা ভালো হওয়ার কারণে আমি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতে পারি। আলোচনা থেকে এক মুরব্বি চাচা পরামর্শ দিলেন, বাদামভাজা বিক্রি করতে। বাদামের ঝুঁড়ি আর ডালা, দাড়িপাল্লা-বাটখারা আর ১ কেজি বাদাম কিনে তিনি পুঁজি করে দিলেন। গ্রামের মসজিদের ইমাম ওইদিন বলেছিলেন ‘নবীর শিক্ষা করো না ভিক্ষা মেহনত কর সবে’। তুমি ভিক্ষা না করে এ কর্মটির পেছনে যদি নিষ্ঠার সাথে পরিশ্রম করো, অসীম দয়ালু সৃষ্টিকর্তা তোমাকে দেখবে আর মিলিয়ে দেবে তোমার রুজি।
আরো মনে পড়ে, ১৯৮৮ সালে বাদামভাজার ঝুঁড়ি, দাড়িপাল্লা আর বাটখারা গলায় ঝুলিয়ে বাদাম বিক্রির জন্য পথে নামলাম। বাদামভাজার ঝুঁড়ি গলায় ঝুলিয়ে বাদাম-বাদাম বলতে বলতে দামুড়হুদার বাজারে যাই। সৃষ্টিকর্তার কৃপায় প্রথম দিনই আমার সব বাদাম বিক্রি হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু কৌশল না জানার কারণে খুবই সামান্য লাভ হয়েছিলো। আজ থেকে ২৬ বছর আগে এভাবেই ছিলো আমার বাদাম বিক্রির পথ চলা। এখনো প্রতিদিন নিজ বাড়িতে বাদাম ভেজে ঝুঁড়িতে করে গলায় ঝুলিয়ে নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সকাল ৯টার মধ্যে দামুড়হুদায় আসি। বিভিন্ন স্কুলের সামনে ও হাট-বাজারের পথে পথে বাদাম বিক্রি করে। যা লাভ হয় তা দিয়ে সংসারের জন্য চাল-ডাল আর আগামীকালের জন্য কাঁচা বাদাম কিনে বেলা তিনটা/চারটার মধ্যে বাড়ি ফিরি।
বাদামভাজা বিক্রি করে উপার্জনের অর্থ দিয়ে স্ত্রী ও দুটি কন্যাসন্তান নিয়ে বেঁচে আছি। বড় মেয়েটি দামুড়হুদা উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে। আর ছোট মেয়েটি গ্রামের স্কুলের ২য় শ্রেণিতে। নিজের কোনো জমাজমি নেই। বাম হাত ও বাম পা বিকলাঙ্গ থাকার কারণে নানা ধরনের অসুবিধা মধ্যেও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে মনের জোর বুকের বল দিয়েই চলাচল করছে। সরকার তার প্রতিবন্ধী ভাতা দেন, এটাই নাকি তার বড় পাওয়া। এই ভাতা পাওয়ার জন্য যারা তাকে সহযোগিতা করেছেন, তাদের জানিয়েছেন কৃতজ্ঞতা। এ প্রতিবন্ধীকে যারা সার্বিক সহয়োগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে বেঁচে থাকার প্রেরণা জুগিয়েছেন তাদেরকে জানিয়েছেন সালাম আর তার প্রাণের ভালোবাসা।