বন্ধ হয়ে যেতে বসেছে চুয়াডাঙ্গার নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো

ছরের পর বছর এমপিওভুক্তির প্রতীক্ষা : অভুক্ত শিক্ষকদের মানবেতর জীবনযাপন

 

আলম আশরাফ: বছরের পর বছর এমপিওভুক্ত না হতে পেরে বন্ধ হয়ে যেতে বসেছে চুয়াডাঙ্গার অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বেতনভাতা না পাওয়া আর অবমূল্যায়নের কারণে শিক্ষক-কর্মচারীরা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ায় এ দশার সৃষ্টি হয়েছে। সরকার তড়িৎ ব্যবস্থা না নিলে এক দু বছরের মধ্যে জেলার অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন শিক্ষক নেতারা। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, কারিগরিসহ প্রায় অর্ধশত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঁচ শতাধিক শিক্ষক-কর্মচারী বেতন-ভাতা না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

চুয়াডাঙ্গার বৃহত্তর উপজেলা আলমডাঙ্গা। এ উপজেলার বকসিপুর দাখিল মাদরাসাটি এ বছর বন্ধ হয়ে গেছে। এক যুগ চলার পরও এমপিওভুক্ত (সরকারি বেতন-ভাতা) হতে না পেরে নিরাশ শিক্ষক-কর্মচারীরা বন্ধ করে দিয়েছেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি। ২০০৩ খ্রিস্টাব্দে শুরু হওয়ার দু’ বছর পরই বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড, ঢাকা থেকে স্বীকৃতি পায় বকসিপুর মাদ্রাসা। প্রায় চার বিঘা জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসাটি গত বছর পর্যন্ত চললেও এ বছর কোনো ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি হয়নি। ফলে মাদ্রাসাটি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে। মাদ্রাসার আঙিনায় করা হয়েছে ধানের আবাদ। বন্ধ হয়ে যাওয়া মাদ্রাসার সুপার শরিয়ত উল্লাহ বলেন, এক যুগ ধরে ১৭ জন শিক্ষক-কর্মচারী নিয়ে বিনা বেতনে প্রতিষ্ঠানটি চালিয়ে এসেছি। তার পরেও এমপিওভুক্তির ব্যাপারে সরকারের নীতিগত কোনো সিদ্ধান্ত না দেখে আমরা হতাশ হয়ে পড়েছি। শিক্ষকরা মাদরাসায় আসতে চান না। তাই প্রতিষ্ঠানে এখন তালা ঝুলছে।

এ উপজেলার সৃজনী মডেল মাধ্যমিক বিদ্যাপীঠের বয়স ১৭ বছর। ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়ে বিদ্যালয়টি বরাবরই ভালো ফলাফল করছে। কিন্তু বিদ্যালয়ের ১৬ জন শিক্ষক-কর্মচারীও হতাশ। তারা প্রতীক্ষায় আছেন হয়তো একদিন বিদ্যালয়টি এমপিওভুক্ত হবে। এ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক আতিকুল হক জানান ‘বিনা বেতনে চাকরি করে বয়স শেষের দিকে। হয়তো সরকারি বেতন-ভাতা না পেয়েই অবসরে যেতে হবে। তাছাড়া এ অবস্থা চলতে থাকলে আমাদের প্রতিষ্ঠানটিও বেশিদিন চালু রাখা সম্ভব হবে না।’

আলমডাঙ্গা উপজেলার গোকুলখালী এলাকায় ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে স্বীকৃতি পাওয়া ডা. আফছার উদ্দিন কলেজের অধ্যক্ষ মহাবুল ইসলাম সেলিমের কণ্ঠেও একই হতাশা। তিনি বলেন ‘বেতন-ভাতা না পাওয়ায় আমাদের সামাজিক মর্যাদা নেই। সংসারে অভাব। সন্তানের মন রক্ষা করতে পারি না। সরকারের কাছে মিনতি জানাই আমাদের কথা যেন তারা ভাবেন।

সর্বশেষ ২০১০ খ্রিস্টাব্দে সারাদেশে এক হাজার ৬২৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করে সরকার। সে সময় চুয়াডাঙ্গা জেলায় মাত্র সাতটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হয়। দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত ও উপেক্ষিত শিক্ষক-কর্মচারীর অনেকেই সংসার চালানোর তাগিদে মাঠে জনপাটও খাটেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সহকারী শিক্ষক জানান, সরকার বেতন দেয় না; কিন্তু পেটতো আর থেমে নেই। বাড়িতে তিন মেয়ে। সংসার চালানোর তাগিদে ছুটির দিন বা অবসরে পরের পানবরজে কাজ করি। আর জমি ভাগেবর্গা নিয়ে কোনো রকম চলে যায়।

লাখ লাখ টাকা অনুদান দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছেন অধিকাংশ শিক্ষক। যুগ যুগ ধরে বেতন-ভাতা পাওয়া যাবে না এমনটি ভাবেননি তারা। বাংলাদেশ ভোকশনাল সমিতি চুয়াডাঙ্গা জেলা শাখার সভাপতি আব্দুল আজিজ বলেন- আমরা আর পারছি না। শিক্ষকদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে। সরকার আমাদের নিয়ে কিছুই ভাবে না, এটা খুবই দুঃখজনক। কারণ প্রতিষ্ঠানের অনুমতি স্বীকৃতি তো সরকারই দিয়েছে। এখন বেতন-ভাতা চালু করছে না কেন? আমরা সরকারের কাছে এমপিওভুক্তির দাবি জানাই। এটা আমাদের ন্যায্য অধিকার। চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার হাজরাহাটি তালতলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাইদুর রহমান জানালেন আমরাতো সরকারের উন্নয়নের সহযোগী। তবে আমরা কেন এতো অবহেলিত?

বিগত পাঁচ বছর সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তিকরণ বন্ধ রেখেছে। শিক্ষক-কর্মচারীরা এমপিওভুক্তির দাবিতে আন্দোলনও করে আসছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোটের ব্যানারে চুয়াডাঙ্গাতেও কয়েক বছর ধরে আন্দোলন করছেন তারা। ওই শিক্ষক সংগঠনের চুয়াডাঙ্গা সভাপতি নুরুজ্জামান জানান, নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা খুবই নাজুক অবস্থায় গিয়ে ঠেকেছে। ধুঁকে ধুঁকে মরছেন অভুক্ত কয়েক শ’ শিক্ষক। অনেকেই প্রতিষ্ঠানে আসা বন্ধ করে দিয়েছেন। কেউ মাঝেমধ্যে আসেন। ফলে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান অব্যাহত রাখাই কঠিন হয়ে পড়েছে। আর কিছুদিন এ ভাবে বিনা বেতনে চলতে থাকলে একে একে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই বন্ধ হয়ে যাবে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চুয়াডাঙ্গা জেলার চার উপজেলায় প্রায় অর্ধশত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হয়নি। এর মধ্যে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের একাংশ এমপিওভুক্ত। অন্য অংশের শিক্ষক-কর্মচারীরা বেতন পান না। আবার কিছু প্রতিষ্ঠান পুরোপুরি নন-এমপিও। দামুড়হুদার উম্বাদ বিশ্বাস মাধ্যমিক বিদ্যালয়টি নিম্ন মাধ্যমিক পর্যন্ত এমপিওভুক্ত হলেও মাধ্যমিক পর্যায় নন-এমপিও। ফলে অর্ধেক শিক্ষক বেতন পান না। এ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ইব্রাহিম হোসেন বললেন তার কষ্টের কথা। তিনি বলেন ‘যখন বেতন বিল তুলি, নন-এমপিও শিক্ষকদের চোখ ছলছল করে। এ দৃশ্য দেখে খুব কষ্ট হয়; কিন্তু কিছুই করার থাকে না। এই অভিশপ্ত আচরণ থেকে আমরা মুক্তি চাই।’ একই উপজেলার মোক্তারপুর নিম্নমাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. বখতিয়ার উদ্দীনও জানালেন, একই ক্ষোভ ও কষ্টের কথা।

জীবননগর উপজেলার কাশেম আলি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নুরুজ্জামান অভিযোগ করে বললেন, ‘প্রতি বছরই জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করছে আমার বিদ্যালয়। ২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত জেএসসি পরীক্ষার ফলাফলে উপজেলার দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে স্কুলটি। তবে আমরা এমপিওভুক্ত না হওয়ায় পুরনো স্কুলগুলোর শিক্ষকরা আমাদেরকে মূল্যায়ন করেন না। এমনকি তারা বিভিন্নভাবে আমাদেরকে পাশ কাটিয়ে যান। শিক্ষা অফিস বা শিক্ষাবোর্ডেও নন-এমপিও শিক্ষকদেরকে আলাদা করে দেখা হয়।’

এ ব্যাপারে চুয়াডাঙ্গা জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা খন্দকার রুহুল আমীন দৈনিক মাথাভাঙ্গাকে জানান, ‘নন-এমপিও এবং এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম সবই এক। শুধু বেতন-ভাতার ক্ষেত্রে বৈষম্য। একইভাবে পাঠদান করে কেউ সরকারের দেয়া বেতন-ভাতাসহ সব সুবিধা পাচ্ছেন। আর কেউ কেউ একটানা বেতন ভাতা না পেয়ে বানবেতর জীবনযাপন করছেন। এটা খুবই কষ্টের। আমরা চাই সব শিক্ষক-কর্মচারীই বেতন-ভাতা সুবিধা পান। এ ব্যাপারে আমাদের কিছুই করার নেই। সরকারের উচ্চ মহলকে এদিকে নজর দেয়ার অনুরোধ জানাই।