শেখ হাসিনাকে হত্যার ষড়যন্ত্র হুজির

 

স্টাফ রিপোর্টার: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিলো হরকাতুল জিহাদ (হুজি)। পরিকল্পনা অনুযায়ী গত আগস্ট মাসে তাকে হত্যা করার কথা ছিলো। জঙ্গিরা হামলার পর সীমান্ত দিয়ে কীভাবে পালিয়ে যাবে সে পথও ঠিক করে রেখেছিলো। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরাপত্তা জোরদার এবং দেশব্যাপি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর তত্পরতার কারণে তাদের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে যায়। এরপরও জঙ্গিরা তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এখনো তত্পর রয়েছে বলে জানা গেছে।

শুধু শেখ হাসিনাই নয়, জঙ্গিদের হিটলিস্টে রয়েছে আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতা এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কয়েকজন বুদ্ধিজীবী। রাজধানী ও জেলা শহরের গুরুত্বপূর্ণ ভবনেও বোমা হামলা চালিয়ে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পরিকল্পনা করে নিষিদ্ধ সংগঠনটি। হুজির প্রথম সারির নেতা মাওলানা রফিক আহমেদ ওরফে সাজিদ এবং বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ ওমর ওরফে ফয়জুল ওরফে রবিসহ চারজন মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কাছে জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য জানান। গতকাল রবিবার হুজির এ চার নেতাকর্মীকে ছয় দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়।

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় গ্রেফতার হুজি নেতা মাওলানা আবু জাফর ওরফে আবু সাঈদ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বসেই এসব পরিকল্পনা করেন বলে জানিয়েছে গ্রেফতারকৃতরা। হামলার ডেডলাইন নির্ধারণ করা হয় গত আগস্ট মাস। মাওলানা রফিক গত জুন মাসে মাওলানা আবু জাফর ওরফে আবু সাঈদের সাথে কারাগারে দেখা করতে যান। তখন তিনি তার পরিকল্পনার কথা জানান রফিককে। কীভাবে কি করতে হবে তার ছক এঁকে দেন মাওলানা সাঈদ। সে নির্দেশ অনুযায়ী পাকিস্তানি জঙ্গিদের কায়দায় রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলা শহরে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ক্ষতির প্রস্তুতি নেয় মাওলানা রফিক ও তার সহযোগীরা। মাওলানা আবু সাঈদ বলে দিয়েছিলেন এগুলো করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে হবে। হামলা চালাতে হবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তার দলের জ্যেষ্ঠ নেতা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বুদ্ধিজীবীদের ওপর।

গত বৃহস্পতিবার ডিসি ডিবি (পূর্ব) জাহাঙ্গীর হোসেন মাতুব্বর ও এডিসি মো. ছানোয়ার হোসেনের সার্বিক তত্ত্বাবধানে নারায়ণগঞ্জ, ফতুল্লা, টিকাটুলি ও উত্তরা এলাকায় অভিযান চালিয়ে মাওলানা রফিক, বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ রবি, নাদিম আহমেদ সুমন ও সালাহউদ্দিন আহমেদকে গ্রেফতার করে। তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ উচ্চমাত্রার বিস্ফোরক, ডেটনেটর, বোমা তৈরির সরঞ্জামাদি এবং পাকিস্তানের তৈরি একটি সাবমেশিন গান উদ্ধার করে ডিবি। বোমা তৈরি কাজে ব্যবহৃত দুটি ল্যাবরেটরির সন্ধান পান গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।

জিজ্ঞাসাবাদে হুজি নেতা মাওলানা রফিক জানান, তাদের নেতা মাওলানা আবু সাঈদ জেলখানায় বসেই তাদের কাজের জন্য যে টাকার প্রয়োজন সেগুলো ম্যানেজ করতেন। দেশের কিছু শিল্পপতি ও রাজনৈতিক নেতা হুজির কার্যক্রম পরিচালনায় অর্থের জোগান দিতেন। এছাড়া জঙ্গি কার্যক্রম চালাতে পাকিস্তান থেকেও নিয়মিত টাকা আসে। তিনি জানান, তাদের বেশির ভাগ টাকা আসতো বিদেশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে।

গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, জঙ্গি নেতাদের ফাঁসি কিংবা তারা গ্রেফতার হলেও তাদের সংগঠন পরিচালনায় কোনো সমস্যা হয় না। একজন নেতা গ্রেফতার হলে বা মারা গেলে তৈরি হয় নতুন নেতা। পুরাতন ভুলগুলো শুধরে তারা নতুন নতুন কৌশল ঠিক করে। জেএমবি প্রধান শায়খ আব্দুর রহমান ও শফিকুল ইসলাম বাংলা ভাইসহ প্রথম সারির ছয় নেতার ফাঁসি হলেও তাদের সংগঠন এখন আবারো সক্রিয় হয়ে উঠেছে। সবচেয়ে বেশি তত্পর হুজির নেতাকর্মীরা। সবগুলো জঙ্গি সংগঠন এখন সমন্বয় করে অপতত্পরতার পরিকল্পনা করে।

যেভাবে রবি হুজি বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ হলেন: গ্রেফতারকৃত রবি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র। তার বাবা বিমানবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। তিনি এখন প্যারালাইজড। রবি যখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে তখন থেকেই সে হুজির সাথে জড়িয়ে পড়ে। হুজির নেতারা নানা কৌশলে তাকে দলে টানে। বলে তাদের সাথে থাকলে, কথা মেনে মরলেও বেহেস্ত যাওয়া যাবে। দুনিয়াতে টাকা-পয়সাসহ কোনো ধরনের সমস্যা হবে না। সেই থেকে তার দেখভাল ও পড়ার খরচ হুজির নেতারা দেয়া শুরু করেন। হুজি তার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার খরচও দিচ্ছিলো। হুজির পরিকল্পনা ছিলো রবিকে এশিয়ার একজন প্রথম শ্রেণির বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ হিসেবে তৈরি করা। তাই তাকে হুজি নেতৃত্বই বলে দিয়েছিলো রসায়ন বিষয়ে পড়াশুনা করতো। রবি দুটি ল্যাবরেটরির দায়িত্বে ছিলো। তার তৈরি বোমা দিয়ে মুহূর্তে ২৫ থেকে ৩০ জনকে মেরে ফেলা সম্ভব।

হুজি নেতা মাওলানা রফিক ফতুল্লা বক্তাবলি ফয়জুল উলুম মাদরাসার শিক্ষক ও স্থানীয় একটি মসজিদের ইমাম। তিনি গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের জানান যে, প্রতিটি জেলায় তাদের সংগঠনের কার্যক্রম থাকলেও দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে তাদের শক্তিশালী ঘাঁটি রয়েছে। কিন্তু তারা কখনো গোয়েন্দা জালে ধরা পড়েনি। দেশে জঙ্গি তত্পরতা গোপনে ফের শক্তিশালী হয়ে উঠছে। যদিও ৫টি গোয়েন্দা সংস্থা নিয়মিত বৈঠক করে জঙ্গি কার্যক্রমের বিরুদ্ধে একপ্রকার যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। এরই অংশ হিসাবে উদ্ধার হচ্ছে বিস্ফোরক ও অস্ত্র। গ্রেফতার হচ্ছে জঙ্গিরা। কিন্তু তারপরও জঙ্গিরা কৌশল পরিবর্তন করে শক্তিশালী হয়ে উঠছে।

ডিবির যুগ্ম পুলিশ কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, গোয়েন্দা পুলিশ অন্যান্য সংস্থার সাথে সমন্বয় করে জঙ্গি তত্পরতা প্রতিরোধ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। যেকোনো ধরনের জঙ্গি তত্পরতা প্রতিরোধে তারা সক্রিয় আছে বলে জানান।

ৱ্যাবের মহাপরিচালক মো. মোখলেসুর রহমান বলেন, কোথাও কোথাও জঙ্গি তত্পরতা কিছুটা রয়েছে। গ্রেফতারের পর জামিনে বের হয়ে জঙ্গি নেতারা তত্পরতা শুরু করে। কেউ কেউ জেলখানা বসেও তত্পরতা চালায়। জঙ্গি তত্পরতা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ৱ্যাবের পক্ষ থেকে বিষয়টি মনিটরিং করা হচ্ছে বলে তিনি জানান। পুলিশের আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেন, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তত্পরতা রয়েছে বলে জঙ্গিরা গ্রেফতার হচ্ছে। জঙ্গি তত্পরতা একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে তা বলা যাবে না। তাদের তত্পরতা প্রতিরোধে পুলিশ নিরলসভাবে কাজ করছে। যার কারণে তারা কোনো পরিকল্পনা করলেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ছে। তিনি দাবি করেন, জঙ্গি তত্পরতা রোধে রাজধানীসহ সারাদেশে গোয়েন্দাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তত্পরতা অনেক জোরদার করা হয়েছে