দালাল চক্ররা হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা : অনেকেই যাচ্ছে না ফেরার দেশে!

ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে পানিপথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমাতে গিয়ে অনেকেই হচ্ছে সর্বশান্ত

 

নজরুল ইসলাম: বেকার জীবনের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে সিদ্ধান্ত নেয় পানিপথে পাড়ি জমাবো মালয়েশিয়ায়। যে কথা সেই কাজ। ২ জুলাই বাড়ির কাউকে না জানিয়ে গেলাম কক্সবাজারে। সেখানে গিয়ে পরিচয় হলো দালালের সাথে। একটিও টাকা লাগবে না। কি আশ্চর্য! বিনা পয়সায় মালয়েশিয়ায়। রাত ১১টায় একটি ট্রলারে উঠে বসলাম। কাছে টাকা বলতে ৩৬২ টাকা। পরের দিন কুলকিনারে নেই এমন একটি সাগরের মাঝখানে। দালাল এলো। বাড়ির মোবাইল নম্বর চান। প্রশ্ন করতেই চোখ রাঙানি। ভয়ে ভয়ে বাড়ির প্রতিবেশীর একটি নম্বর দিলাম। নম্বরে যোগাযোগ করলো দালালরা। দু লাখ ৩০ হাজার টাকা না দিলে সাগরে ফেলে দেয়া হবে। কি আর করার। বাড়ির লোকজন টাকা ম্যানেজ করতে মরিয়া। ১ লাখ টাকা কোনো মতে ম্যানেজ করে দালালদের গডফাদারের ঠিকানায় বিকাশ করা হলো। ১ লাখ টাকা পেয়ে টলারটি নিয়ে ভিড়ালো একটি জাহাজের কাছে। তার মানে ট্রলার থেকে জাহাজে তোলা হবে না। এখন আমাকেসহ সাথে থাকা বাকিদের ভরা হবে ড্রামের মধ্যে। তারপর ওই ড্রামটি জাহাজের নিচে হুকের সাহায্যে বেধে দেয়া হবে। ড্রামের মধ্যে অক্সিজেন দেয়া আছে। ড্রামের মধ্যে ডুকতে না চাইলে শারীরিক নির্যাতন। অনেকটা ঠেলায় পড়ে বাঘে ঘাস খাওয়ার মতো। আমাদের ভরা হলো ড্রামের মধ্যে। জাহাজের নিচে হুকে বাঁধিয়ে দেয়া হলো। জাহাজটি নাকি থাইল্যান্ডের উদ্দেশে রওনা দেবে। সামনে ৫/৬ কিলো রাস্তা চেকিং হবে। যদি চেকিং হতে দেরি হয় তাহলে মৃত্যু নিশ্চিত। কারণ ড্রামের মধ্যে যে পরিমাণ অক্সিজেন আছে তাতে খুব জোর ৬/৭ ঘণ্টা বেঁচে থাকা যেতে পারে। ভাগ্য ভালো হলে চেকিং এরিয়া অতিক্রম হওয়ার পর থাইল্যান্ডের দালালরা ট্রলার নিয়ে অপেক্ষা করছে। ড্রামের মধ্য থেকে বেরিয়ে উঠলাম ট্রলারে। এভাবে টলার আর জাহাজে কেটে গেলো ১১ দিন। ১২ দিনে মাথায় দেখা মিললো একটি জঙ্গলের। এ জঙ্গলে আমাদের কে থাকতে হবে। মালয়েশিয়ার একেবারে সীমান্ত ঘেঁষা জঙ্গলে।

এবার শুরু হলো বাকি টাকা আদায়ের পালা। বাকি টাকা পরিশোধ হলেই থাইল্যান্ডের দালালরা ঠেলে পাঠিয়ে দেবে মালয়েশিয়ার ভূ-খণ্ডের মধ্যে। সেখানে শেয়াল যেমন দিনের বেলায় আহার করতে বাইরে বের হয় না। রাত হলে বের হয়। ঠিক তেমনি অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় প্রবেশকারীরা পুলিশি গ্রেফতার এড়াতে শেয়ালের মতো চুরি করে দিনহাজিরায় কাজ করে থাকে। সারাদিন কাজ শেষে সন্ধ্যার আগে আগে রাতের খাবার খেয়ে খুঁজতে থাকে পাহাড়ের গুহা। যেখানে রাতযাপন করতে হবে। বনের জীবজন্তু আর মশার কামড় মোকাবেলা করে রাত কাটাতে হয় তাদের। প্রতিদিন এভাবেই চলে জীবন। এভাবেই মালয়েশিয়ায় যাওয়ার বর্ণনা দিলেন চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার ছোটশলুয়া গ্রামের নিজাম।

আর যদি মালিক খারাপ হয় তাহলে বিপদের শেষে নেই। কাজ করলেও টাকা দেবেন না। আবার অন্য কোনো জায়গায় কাজ নেবেন তা হতে দেবে না। পুলিশ দিয়ে ধরিয়ে দেয়ার ভয় দেখাবে। তাই বাধ্য হয়ে দাস-দাসীদের মতো মানসিক আর শারীরিক নির্যাতনে মধ্যদিয়ে জীবনযাপন করতে হয়। টাকা-পয়সা খরচ করে বিদেশে পাড়ি জমিয়ে ধার-দেনা শোধ করার জন্য সব কিছু সহ্য করতে হয়। কারণ বাড়িতে ফেরার কোনো রাস্তায় তখন আর খোলা থাকে না। প্রতিদিনই টেলিভিশন এবং খবরের পাতায় সংবাদ আকারে আসছে পানিপথে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার করুণ দৃশ্য। তারপরও স্থানীয় দালাল চক্রের প্রতারণার শিকার হয়ে সংসারের সচ্ছলতা ফেরাতে অনেকই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাড়ি জমাচ্ছেন বিদেশের মাটিতে। যাওয়ার পরে বুঝতে পারছে মানুষের জীবনের কোনো মূল্য নেই। তা না হলে এক মানুষ আর এক মানুষের সাথে এ ধরনের প্রতারণা আর নির্যাতন করতে পারে। এতো কিছুর পরও থেমে নেই দালালচক্ররা। হতদরিদ্র পরিবারের লোকজনের কাছে বাহারি গল্প আর ধনী হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে বিভোর করছে এক শ্রেণির মানুষকে। এরই মাঝে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার তিতুদহ ইউনিয়নের বেশ কিছু মানুষ দালারের খপ্পরে পড়ে পাড়ি জমিয়েছে মালয়েশিয়ায়। আবর মৃত্যুর খবরও এসছে খাড়াগোদা গ্রামের শাহাদতের বাড়িতে আর সড়াবাড়িয়া গ্রামের হারুনের বাড়িতে। সময়মতো টাকা পরিশোধ করতে না পারায় নির্যাতন শেষে তাদেরকে হত্যা করে ফেলে দেয়া হয়েছে সাগরে, এমনি অভিযোগ ছিলো পরিবারের লোকজনের। এসবের পরেও বহাল তবিয়তে আছে দালালচক্ররা। এদেরকে আইনের আওতায় আনা না হলে অনেক পিতাকে হারাতে হবে তার ছেলেকে। অনেকেই হবেন বিধবা। আবার কোনো শিশু হয়তো কোনো দিনই দেখতে পাবে না তার পিতার মুখখানি। বিষয়টির প্রতি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এখনই ব্যবস্থা নেয়া দরকার বলে মনে করছে সচেতনমহল।