আর একজনের গায়ে হাত দিয়ে দেখুক : শেখ হাসিনা

 

স্টাফ রিপোর্টার: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপির প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, আন্দোলনের নামে আবারো দেশে হত্যা-অরাজকতা চালালে সরকার কঠোর অবস্থানে যাবে। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার সাম্প্রতিক আন্দোলনের হুমকির জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি দেশে যখন নৈরাজ্য ও অরাজকতা সৃষ্টি করেছিল তখন ট্রানজিট গভর্নমেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় ছিলাম। তখন অনেক কিছুই করতে পারিনি। কিন্তু এখন আমাদের সরকার নির্বাচিত। আন্দোলনের নামে আর একজনের গায়ে হাত দিয়ে দেখুক। তার পরিণতি কি হয় তা দেখবে। তিনি বলেন, এখন জনগণের কিছুই হবে না এটা আশ্বস্ত করতে চাই। দেশের জনগণের জীবন ও সম্পদ রক্ষা করা নির্বাচিত সরকারের দায়িত্ব।

গতকাল বৃহস্পতিবার বিকালে গণভবনে এক জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক ইতালি সফরের অর্জন ও সফলতা তুলে ধরতে এই সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সফর নিয়ে লিখিত বক্তব্যের পর প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন।

বিএনপির সাথে সরকারের সংলাপ সম্ভাবনা নিয়ে সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, বারবার খুনিদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে এত তাগিদ কেন? কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেন কেন? যারা রাজনীতির আস্তাকুঁড়ে চলে গেছে তাদের সঙ্গে কিসের আলোচনা? একদিকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাইবেন, অন্যদিকে তাদের সহযোগীদের সঙ্গে আলোচনা করতে বলবেন এটা তো হতে পারে না। যারা খুনি, খুনিদের সঙ্গে হাত মেলায় তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসার জন্য এতো আকুলি বিকুলি কেন? যারা এদেশে গণতন্ত্র চায় না তাদের সঙ্গে কোনো সমঝোতা নয়।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বর্তমানে সংসদের বিরোধী দল স্থিতিশীলতা বজায় রেখেছে। আর যে দল (বিএনপি) নির্বাচনে আসেনি তাদের নিয়ে কারো কোন মাথা ব্যথা নেই। দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রয়েছে এটা এখন বিদেশে প্রশংসিত হচ্ছে। বিএনপি চেয়ারপারসনের আগাম নির্বাচনের দাবি প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, বিদেশে বিভিন্ন নির্বাচনে জিতে আসছি। উনি কি এটা দেখেন না। সাংবাদিকদের প্রতি পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কেউ যদি আপনাকে খুন করতে গিয়ে ব্যর্থ হয় কিংবা আপনার পরিবারের সদস্যদের খুন করে, তার সাথে কি সমঝোতার জন্য সংলাপে বসবেন? তিনি বলেন, কেউ খুন করলে তার বিচার চাইতে হবে। এখানে আলোচনার কোন সুযোগ নেই। মূলত আন্দোলনের নামে ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড করে বিএনপি রাজনৈতিক ডাস্টবিনে চলে গেছে। তাদের আন্দোলন হলো মানুষ খুন করার আন্দোলন। আন্দোলনের হুমকি তো খালেদা জিয়া অনেকই দিলেন।

শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের পুরস্কৃত করেছে জিয়াউর রহমান। খুনিদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দেয়া হয়। আর খালেদা জিয়া তাদের সংসদে বসিয়েছে। একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলার সঙ্গে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান জড়িত। তারেক সরাসরি এ মামলার আসামি। সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে তিনি আরো বলেন, মাঝে মাঝে বোমা বিস্ফোরণের শব্দ না শুনলে আপনাদের ভাল লাগে না। তাদের আমলে সারাদেশে বোমা হামলা হয়েছে। আপনাদের প্রেসক্লাবেও হয়েছে। জঙ্গিবাদের উত্থান বিএনপি-জামায়াত ঘটিয়েছে। তারপরও দেশ জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে পাঁচ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে বিএনপির সঙ্গে আপোসের চেষ্টা করেছিলাম। দেশ ও জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে এটা করেছিলাম।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখন দেশে স্থিতিশীল পরিবেশ বিরাজ করছে। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এটা অনেকের ভাল লাগে না। যারা মুক্তিযুদ্ধ চায়নি, বাংলাদেশে স্বাধীনতা চায়নি, যারা ইয়াহিয়া খানের প্রেতাত্মা তারাই চায় না বাংলাদেশ এগিয়ে যাক। প্রশ্নকারী সাংবাদিদের প্রতি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে তিনি বলেন, এখন মানুষ শান্তিতে আছে। এগুলো আপনাদের ভাল লাগছে না? তাই তো বলে-সুখে থাকতে ভূতে কিলায়। এ সময় দেশের উন্নয়নের স্বার্থে যেকোন ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদ অব্যাহত রাখতে দেশের মানুষের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

দুর্নীতির মামলায় খালেদা জিয়ার আদালতে হাজিরার দিন হরতাল দেয়া প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, চোরের মন পুলিশ পুলিশ। উনি চুরি করেছেন বলেই আদালতে ভয় পান। উনি এতিমদের টাকা মেরে খেয়েছেন। হরতাল ডাকা হয় যাতে আদালতে হাজিরা না দিতে হয়। আদালতে হাজিরা দিতে উনার এত ভয় কিসের জন্য? নির্দোষ হলে আদালতে আসেন। আমি তো আদালতে হাজিরা দিতে ভয় পাইনি। মামলার তারিখ আসলেই উনি হুমকি-ধমকি দেন। পলায়নপর মনোবৃত্তি পরিহার করতে খালেদা জিয়ার প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, দুর্নীতি না করলে পলায়নপর মনোবৃত্তি কেন? পলায়নপর মনোবৃত্তি থাকলে দেশের উন্নতি করতে পারবেন না।

আগামী ২৬ অক্টোরের হরতালের যৌক্তিকতা নেই উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেইনি, এটা ঠিক না। যখন ঘটনা ঘটে তখন আমি প্লেনে। কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিয়েছি। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ায় লতিফ সিদ্দিকীকে মন্ত্রিসভা থেকে অপসারণ করা হয়েছে। দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। প্রাথমিক সদস্য পদ বাতিল করতে কারণ দর্শানোর নোটিস দেয়া হয়েছে। লতিফ সিদ্দিকী নোটিসের জবাব দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এ জবাব নিয়ে কাল (আজ শুক্রবার) আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। কাজেই এ বিষয় নিয়ে হরতালের কোন অবকাশ নেই। লতিফ সিদ্দিকীর গ্রেফতার প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, উনি এখন দেশে নেই। যারা গ্রেফতারের দাবি করছে তারা ধরিয়ে দিক। গ্রেফতারের জন্য তো সরকার প্রস্তুত। দেশে না থাকলে গ্রেফতার করবে কিভাবে?

আসেম সম্মেলনে উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা প্রসঙ্গে একজন সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, এ সম্মেলনে মানসম্মত শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কানেক্টিভিটির বিষয়গুলো গুরুত্ব পেয়েছে। বিশেষ করে এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধির বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এতে করে যেন প্রতিটি দেশ লাভবান হতে পারে। মূলত এই এজেন্ডা ছিল জাতিসংঘের। এছাড়া জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের বিষয়ও গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। শেখ হাসিনা বলেন, সন্ত্রাসী ও জঙ্গিদের কাছে অস্ত্র বিক্রি না করতে আমি উন্নত দেশগুলোর প্রতি প্রস্তাব দিয়েছি। তিনি বলেন, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদে জড়িতদের কোনো ধর্ম নেই। জঙ্গি জঙ্গিই, তাদের কোনো বর্ডার (সীমানা) নেই। তবে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস দমনে বর্তমান সরকার সক্ষম হয়েছে।

আসেম শীর্ষ সম্মেলনের সময় কয়েকজন ইউরোপীয় নেতার সঙ্গে বৈঠকের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, তাদের কেউ ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের ব্যাপারে প্রশ্ন তোলেননি। বরং তারা তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করায় আমাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন এবং নির্বাচন পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রশংসা করেন। তারা মনে করেন, নির্বাচনের পর বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে।

ইন্টার-পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন (আইপিইউ) ও কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশনে (সিপিএ) বাংলাদেশের বিজয় নিয়ে প্রশ্ন না করায় সাংবাদিকদের কৃপণ বলে টিপ্পনি কাটেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘আইপিইউ ও সিপিএতে জয়ী হলাম। কোনো সাংবাদিক একটু অভিনন্দনও জানাল না। সাংবাদিকরা এতো কৃপণ, আগে জানতাম না। আইপিইউ ও সিপিএ-তে বাংলাদেশের জয় প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, ওখানে কারচুপির কোনো সুযোগ ছিল না। মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে পৃথিবীর কোনো দেশ আইপিইউ ও সিপিএ এর মতো দুটো প্রতিষ্ঠানে একসঙ্গে বিজয়ী হয়নি। যারা ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের সমালোচনা করেছেন তাদের যে দূরদর্শিতার অভাব, সেটা প্রমাণ হয়েছে। বিদেশি রাষ্ট্রদূতরাও বিভিন্ন কথা বলছেন। কিন্তু তাদের রাষ্ট্রপ্রধানরা একটা প্রশ্নও তোলেননি। প্রত্যেকে আমাদের অভিনন্দন জানিয়েছেন। তারপরও ওই নির্বাচনে কেন আনকনটেস্টেড (১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত) এটা নিয়ে অনেক উকিল মামলা করতে যায়। আর যে উকিল এটা নিয়ে ওকালতি করতে গেছেন তিনি নিজেই অতীতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ যে আর্থিক উন্নয়নে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখছে, সেটা প্রমাণ হয়েছে। যারা এখনো বর্তমান সরকারের সমালোচনা করে যাচ্ছে তারা হয়তো কূপমন্ডূকতায় ভুগছে, নয়তো বিশেষ উদ্দেশ্যে বলছে। বাংলাদেশ যে পারে সেটা প্রমাণ করেছি। প্রধানমন্ত্রী তার সরকারের সফলতা তুলে ধরে বলেন, আমরা সাক্ষরতার হার বাড়াই তারা কমায়।

এর আগে লিখিত বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী তার চার দিনের ইতালি সফরের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে বলেন, এ সফর অত্যন্ত সফর ও ফলপ্রসূ হয়েছে। এই সফরের মাধ্যমে ইতালিসহ আসেমভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক নতুন মাত্রায় উন্নীত হয়েছে। আমাদের অর্থনীতিকে সুসংহত রাখা এবং বিশ্বের সব অর্থনৈতিক শক্তির সঙ্গে সম্পর্ক আরও দৃঢ় ও স্থায়ী করাই সরকারের লক্ষ্য। এ লক্ষ্য অর্জনে আমরা যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন অনেক বেশি সচেষ্ট। ২০১২ সালে বাংলাদেশের আসেমের সদস্য পদ পাওয়াকে আওয়ামী লীগ সরকারের কূটনৈতিক সফলতা হিসেবে আখ্যায়িত করেন তিনি। গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে বিদেশি মহলে কোনো কথা হয়নি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ নির্বাচনের পর বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন হয়েছে। বাংলাদেশের গণমাধ্যম স্বাধীন এ মন্তব্য করে তিনি আরো বলেন, জঙ্গি দমনে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদের কোনো স্থান নেই। নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী জনগণের কল্যাণে কাজ করে যেতে চাই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সকলকে সাথে নিয়ে ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করা হবে। আর ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে একটি উন্নত, সমৃদ্ধ দেশ।

সাংবাদিক সম্মেলনে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী, প্রধানমন্ত্রীর তথ্য বিষয়ক উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী, আওয়ামী লীগ নেতা ডা. দীপু মনি, ফারুক খান, ড. আব্দুর রাজ্জাক, এবি তাজুল ইসলাম প্রমুখ।

Leave a comment