লোভনীয় মুনাফার ফাঁদে অর্থ হাতিয়ে লাপাত্তা হচ্ছে বহু বহুমুখি সমবায় সমিতি

 

স্টাফ রিপোর্টার: সমবায়ের নামে সাধারণ মানুষের ৯ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে প্রতারকচক্র। গত এক বছরে ২১টি সমবায় সমিতির ৯ লাখ সদস্যের এই টাকা নিয়ে ওরা হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার আইনগত দুর্বলতা, অব্যবস্থাপনা, তদারকির অভাবে একাধিক প্রতারকচক্র বহুমুখি সমিতির নামে সারা দেশে সাধারণ মানুষের পুঁজি লুটে নেয়ার সুযোগ পাচ্ছে। এ ধরনের প্রতারণা রোধে সমবায় অধিদফতরের জোরালো তেমন কোনো পদক্ষেপ নেই বলে অভিযোগ করেছেন ক্ষতিগ্রস্তরা।
সঞ্চয়ের টাকা লোপাটের সঙ্গে জড়িত থাকার সন্দেহে ৫ হাজার সমবায় সমিতিকে প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রতারণা রোধে এ পাঁচ হাজার সমিতি ঘিরে বিশেষ নজরদারির ব্যবস্থা করা হয়েছে।
টাকা নিয়ে পালিয়ে গেলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষমতা নেই সমবায় অধিদফতরের। ক্ষতিগ্রস্তদের কেউ থানায় মামলা করলে স্থানীয় প্রশাসন ওই সমিতির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিয়ে থাকে।

পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সচিব এমএ কাদের সরকার বলেন, একটা সময় সমবায়ের নামে অনেক প্রতারণার কথা শোনা গেছে। কিন্তু এখন আর শোনা যায় না। সমবায়ের নামে প্রতারণা কিংবা ব্যাংকিং কার্যক্রম চালানো অথবা একাধিক শাখা রাখার সুযোগ নেই। ২০১১ সালের সংশোধিত আইনে প্রতারণার এ সুযোগ বন্ধ করা হয়েছে। এছাড়া ওই আইন সংশোধনের পর নতুন করে কোনো সমবায় কিংবা বহুমুখি সমবায়ের অনুমোদনও দেয়া হয়নি। আবার যেহেতু একাধিক শাখা খোলার সুযোগ নেই, তাই সমবায়ের নামে প্রতারণার অভিযোগও আগের চেয়ে কমে গেছে। ঢাকায় এ অভিযোগ শূন্যের কোঠায়। প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিচ্ছিন্নভাবে একটি-দুটি ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের নজরে আসার সঙ্গে সঙ্গে ওইসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।

মাঠের বাস্তবতার সাথে সরকারি বক্তব্যের কোনো মিল নেই। দেশের বিভিন্ন স্থানে বহুমুখী সমবায়ের নামে প্রতারণার হার বেড়েই চলেছে। একের পর এক অঘটনেও দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। ফলে দিন দিন বেসামাল হয়ে উঠছে সমবায় খাত। এ সুযোগে ‘বহুমুখী সমবায়’ কার্যক্রমের নামে স্থানীয় ছোট ও মাঝারি সঞ্চয়ীদের পুঁজি লুটের ফাঁদ পেতে বসেছে প্রতারকরা। এতে সরকারি অনুমোদিত সার্টিফিকেটকেই ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। সরকারি তহবিলে ‘মাত্র ৩০০ টাকা’ জামানত ফি দিয়েই যে কেউ নিতে পারেন বহুমুখী সমবায় সমিতি চালুর সনদ। একটি সনদ নিয়ে একাধিক শাখা খুলে বসার নজির রয়েছে। খুব সহজে এ ধরনের সনদ মিলে যাওয়ায় সারা দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো সমবায় সমিতি গড়ে উঠেছে। সম্প্রতি প্রকাশিত টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে গত এক বছরে ৯ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার তথ্য।

অধিদফতরের অতিরিক্ত নিবন্ধক অমিয় কুমার চট্টোপাধ্যায় বলেন, সমবায়ের তদারকি জোরদারে বেশ কিছু উদ্যোগ রয়েছে। বিশেষ করে, ভবিষ্যতে এ ধরনের প্রতারণা ঠেকাতে সন্দেহজনক অন্তত ৫ হাজার সমবায়ী প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বিশেষভাবে তদারক করা হচ্ছে। এর জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক সরকারি কর্মকর্তা প্রেষণে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তাদের আলটিমেটাম দিয়ে বলা হয়েছে, ওইসব প্রতিষ্ঠানে যে কোনো অনিয়মের দায় তাদেরই বহন করতে হবে।

তিনি বলেন, সমিতিগুলোর প্রতারণা, অসঙ্গতি, অনিয়ম তদারকির জন্য জেলা সমবায় কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ওই নির্দেশনা অনুযায়ী জেলা সমবায় কর্মকর্তা প্রতি মাসে তদারকি কর্মকর্তার কাছ থেকে জমা খরচের হিসাব ও প্রতিবেদন নেন। এরপর তিনি এসব রিপোর্ট পর্যালোচনা করেন। সেখানে কোনো ত্র“টি থাকলে আইনগত ব্যবস্থাও নেয়া হয়ে থাকে। এছাড়া প্রতি মাসে কমপক্ষে একটি অসঙ্গতিপূর্ণ সমবায় পরিদর্শনের জন্য জেলা সমবায় কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেয়া আছে। জানা গেছে, এ পর্যন্ত দেশে ১ লাখ ৮৬ হাজার ১৯৯টি সমবায় সমিতির অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রাথমিক সমবায় সমিতির সংখ্যা ১ লাখ ৮৫ হাজার ৬৪। কেন্দ্রীয় সমিতির সংখ্যা ১ হাজার ১১৩ ও জাতীয় সমিতি ২২টি। এসব সমিতির সদস্য সংখ্যা হচ্ছে ৯৩ লাখ ৪৯ হাজার ৫৫৭।

অনুমোদিত সমিতির মধ্যে অসাধু চক্রের নিয়ন্ত্রণাধীন সমিতিগুলো শুরু থেকেই পুঁজি লুটের ফন্দি আঁটতে থাকে। তারা জেলা-উপজেলা পর্যায়ে অফিস নিয়ে লোভনীয় প্রস্তাব দিয়ে সমিতির সদস্য সংগ্রহের কাজে নামে। প্রচার চালায় সমিতির সদস্যের বাইরেও ঋণ দেয়া হবে। সঞ্চয়ের বিপরীতে দেয়া হবে লাভজনক মুনাফা ইত্যাদি। এ ক্ষেত্রে ১ লাখ টাকায় মাসে ১৬শ টাকা মুনাফা দেয়ার প্রস্তাব প্রচার করা হয়। এ হিসাবে বছরে ১৯ হাজার ২০০ টাকা। সমপরিমাণ টাকা ব্যাংকে রাখলে মুনাফা মেলে বছরে ১০ হাজার টাকা। সেখানে ব্যাংকের চাইতেও দ্বিগুণ মুনাফা পাওয়ার মতো প্রলোভন দেয়া হচ্ছে প্রতারকদের প্রতিষ্ঠান থেকে। এলাকা ভেদে একেক সমবায় প্রতিষ্ঠান সদস্য হওয়ার শর্তে দিচ্ছে একেক রকম প্রস্তাব। অনেক প্রতিষ্ঠান সদস্যের বাইরের সঞ্চয়ীদেরও প্রভাবিত করছে। এভাবে লোভ দেখিয়ে গ্রামের সহজ-সরল মানুষকে এ চক্র নানা কায়দায় প্রতারণার জালে জড়াচ্ছে। এদের লোভনীয় প্রস্তাবের ফাঁদে অনেক শিক্ষিত ও সচেতনরাও ধরা দিচ্ছেন। এরপর দিনে দিনে স্থানীয় বিভিন্ন আয়ের মানুষের ঘাম ঝরানো সঞ্চয় কিংবা প্রবাসীদের পাঠানো কষ্টার্জিত টাকা স্রোতের ঘূর্ণির মতোই ঘুরে ঘুরে এসে জমা হচ্ছে প্রতারকদের জালে। লোভে পড়ে অনেকে জমিজমা বিক্রি করেও টাকা দিচ্ছেন।

প্রথমদিকে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনে আকর্ষণীয় মুনাফাও দেয়া হচ্ছে গ্রাহককে। এর ফলে ব্যাংকের পরিবর্তে সেই সমবায়ী প্রতিষ্ঠানে গ্রাহকের সঞ্চয়ী অর্থ আরও বেশি করে রাখার প্রবণতা বাড়ছে। কিন্তু এরপরই ঘটছে ঘটনাটি। ওই সমবায়ের কাছে গ্রাহকের রক্ষিত আমানত লাখ থেকে কোটি কিংবা কোটি থেকে শত কোটি পা রাখতেই প্রতারকদের আসল রূপ ধরা পড়ছে। সবার অজান্তে হঠাৎ করেই একদিন রাতের আঁধারে সাইনবোর্ড গুটিয়ে উধাও হয়ে যাচ্ছে গ্রাহকের সাথে প্রতারণা করা এসব প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা।