ইজারা প্রথার কারণে সংকুচিত হয়েছে মাছ ধরার ক্ষেত্র

বিনষ্ট অভয়ারণ্যগুলোও : বিলুপ্ত মাছের বংশধারা

 

তাছির আহমেদ: আর দু সপ্তা পর প্রকৃতি শরতকে বিদায় দিয়ে হেমন্তকে আনবে। শরৎ চলে যাবে তাই তার বিদায় লক্ষ্যে প্রকৃতি যেন আষাঢ়ের ভাসা পানিকে টান দিচ্ছে। হয়তো এজনই সমস্ত জলাশয়গুলোর পানি ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে। প্রকৃতির এ উৎসবে দামুড়হুদা উপজেলার নদ-নদী ও খাল-বিলাঞ্চলের মৎসজীবীরা মাছ ধরার নেশায় মেতে উঠেছেন। এ সকল মানুষ মাছ ধরার চিরন্তন দৃশ্যগুলো দেখে আরো মনে হয় এখনও ঠিকই আছে। শুধু বিনষ্ট হয়েছে নানামুখি তৎপরতার কারণে মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্রগুলো। আর বিলুপ্তপ্রায় হয়ে পড়ছে অধিকাংশ দেশীয় প্রজাতির মাছের বংশধারা। তাই মাছ ধরতে গিয়ে আগের মতো আর মাছের দেখা না পেয়ে এদের মনে ভর করেছে কিছুটা বেদনা।

তারপরও প্রতিবছর বর্ষার পানি বৃদ্ধির সাথে সাথে এরা দিন গোনে, কবে কমবে পানি, যাবে মাঝ ধরতে। চক্রাকারের এ ঋতুতে ঠিকই একদিন ওদের অপেক্ষার পালা শেষ হয়। তার আগে মাছ ধরার সরঞ্জামগুলো কোথায় আছে খুঁজে বের করে ঠিক করে। খেপলা জাল, ফাঁস জাল, সিটকি জাল, বৃত্তি, পলো, খলুই, দুয়াড়ে, আর পাতিল নিয়ে এরা নামে পানিতে মাছ ধরার আশায়। মাছও পায়- পুঁটি, চিংড়ি, খঁলসে, ঝায়া, মায়া, চ্যালা, পাকাল, তোড়া, গুতেল, শিং, টেংরা, মাগুর, কৈ, ওকোল, চ্যঙ, বেলেসহ আরো কয়েক প্রকার না দেশি মাছ ধরা পড়ে এদের হাতে। তবে এখন পরিমাণে থাকে যৎ সামান্য। তারপরও নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে এরাই বাজারজাত করে। তাই সে হিসেবে বলতে হয়- এসব দেশি তাজা মাছের ঝোলের সুগন্ধ এখনো ছড়ায় মুক্ত বাতাসে। রান্না করা তরকারি পাতে নিয়ে ভাত খাওয়া শেষে অনেকেই তোলেন তৃপ্তির ঢেকুর আয়েশি ভঙ্গিতে।

এ মাছের স্বাদ নিতে আমাদেরও খুব লোভ লাগে। তাই এ মাছ বাজারজাতের আগে একটু কম দামে কেনার আশায় গতকাল সকালে গিয়েছিলাম দামুড়হুদার বাসস্ট্যান্ড সংলগ্নের চামপচা বিলে। এ সময় দেখা হয় বিভিন্ন মৎসজীবীর সাথে। কথা হয় দামুড়হুদা দশমী গ্রামের দিনমুজুর আ. মজিদের (৬০) সাথে। তিনি জানান, দামুড়হুদার বাসস্ট্যান্ডের পূর্বদিকে চামপচা বিলের অবস্থান। তারপরেরটি দোবিল, তারপরে রয়েছে আরো ১টি শলাগাড়ি নামক বিল। বর্ষার সময় এগুলো সব একত্রে দেখলে মনে হয় যেন বিশাল এক জলরাশি। এ অঞ্চলের বেশ কিছু দরিদ্র শ্রেণির মানুষ এখান থেকে প্রায় ১২ মাসই দেশীয় কাটরা মাছ ধরে এবং তা বাজারে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে। আবার কিছু মানুষ আছে এরা মরসুম বুঝে মাছ ধরে। তখন এলাকার অনেক দরিদ্র শ্রেণির মানুষ তারা সারা দিনই এখানেই মগ্ন থাকেন।

বছরভর এ বিল থেকে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করা ফজলুর রহমান (৫০) জানান, দামুড়হুদা বাসস্ট্যান্ডের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থান করছে আরো ১টি বিল। এলাকার মানুষ তাকে চেনে নাউগড়া নামে। এ বিলে প্রতিবছর বর্ষা মরসুমের ভাসা পানি জমে। এ পানি দিনরাত চুইয়ে নেমে এসে এ ব্রিজের নিচ দিয়ে মেলে চামপচার সাথে। তখন চামপচা বিলের ছোট মাছ কিলবিল করে ছুটতে আসে উজোন দিকে। তখন এলাকার বিভিন্ন শ্রেণির মানুষও ছোটে এ মাছ ধরতে। আরেক দিনমুজুর মালেক (৪০) জানান, ধানক্ষেতের আইলে আইলে প্রতিদিন তিনি ৮টি বৃত্তি পাতেন। তাতে প্রায়দিনই প্রায় এক কেজি করে ছোট মাছ ধরা পড়ে। তবে বৃষ্টি হলে মাছের পরিমাণ বাড়ে। এ মাছগুলোর মধ্যে বেশি থাকে- পুঁটি, চিংড়ি, খঁলসে, চ্যালা, ঝায়া, মায়া, পাকাল, তোড়া, গুতেল, চ্যঙ আর ওকোল।

মৎস্যশিকারী চপল, সোহেল, সুজন, নেঙটে ও ফারুক জানান, দামুড়হুদা চামপচা বিলের মাছ খুব স্বাদ। কাটরা জাতীয় ছোট মাছের রান্না করা ঝোল দিয়ে ভাত খেতে খুব ভালো লাগে। তাই প্রতিবছরের এ মরসুমে তারা এখানে বৃত্তি পাতে। গত কয়েক বছর আগেও এখানে মাত্র ৪টি বৃত্তি পেতে এক/দেড় করে কেজি মাছ পেয়েছে। আর ২টি ফাস জালে উঠেছে শিং, মাগুড়, কৈ, তোড়া, চ্যঙ আর পোনা। সব মিলিয়ে হতো প্রায় দেড় থেকে দু কেজি করে। কিন্তু এখন সেই দুটি জালে মাছ দেখা যায় মাত্র দু-তিনটা, আবার কোনোদিন থাকে না। তবে সেই তুলনায় বৃত্তির অবস্থা এখনো কিছুটা ভালো। দিনদিন যে হারে এ জাতের মাছের বংশকে ধ্বংস করা হচ্ছে, তাতে খুব বেশি দেরি নয় মাছে ভাতে বাঙালির মাছের আকাল দেখা দিতে।

দিন দিন দেশীয় মাছের আকাল? কিন্তু কেন? এ প্রতিবেদক এ প্রশ্নের উত্তর জানতে চেয়েছিলেন দামুড়হুদা উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সমীর কুমার সরকারের কাছে। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে এ বিষয়ে তিনি জানান, নানামুখি তৎপরতার কারণে মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্রগুলো দিনদিন বিনষ্ট হয়েছে। বিভিন্ন জলাশয়ে অধিক মাত্রায় কীটনাশক ব্যবহার এবং জলাশয়ের পানি সেচ দিয়ে শুকিয়ে মাছ ধরাসহ পরিবেশ গত দিকগুলোর কারণে স্বাদু পানির মাছ দিন দিন কমে যাচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ পেতে হলে কি করণীয় জিজ্ঞাসায়, তিনি বলেন, বর্ষাকালে এ সকল জলাশয়ে বেশি বেশি পরিমাণে মাছের পোনা ছাড়তে হবে। সেই সাথে কোনো জলাশয় সেচ দিয়ে শুকিয়ে মাছ ধরতে নিষেধ করেন। আর চাষিদের মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারে অধিক সংযত হতে হবে।

ইজারা প্রথার কারণে সংকুচিত হয়ে এসেছে মাছ ধরার ক্ষেত্রগুলো। বিনষ্ট হয়েছে মাছের অভয়ারণ্যগুলোও। বিলুপ্তপ্রায় হয়ে পড়ছে অধিকাংশ দেশীয় প্রজাতির মাছের বংশধারা। এরপরও বাড়ির পাশের খাল-বিলে এখনো দেশি মাছের অভাব নেই। এখনো পানিতে ভেসে বেড়ায় নানা প্রজাতির দেশি মাছ। এখনো শুকিয়ে যাওয়া জলাশয় হাতড়িয়ে মাছশিকার করে শিশু-তরুণসহ কিশোর-কিশোরীরা।