আন্দুলবাগিয়ার হাসান বীজ ভাণ্ডারের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই : ফুঁসে উঠেছে কৃষকরা

 

থানায় হাসানের নামে পুলিশের মামলা : চাষিদের ক্ষতিপূরণ দাবি

আন্দুলবাড়িয়া প্রতিনিধি: চুয়াডাঙ্গার জীবননগরের আন্দুলবাড়িয়া বাজারের হাসান বীজ ভাণ্ডারের মালিক হাসানুজ্জামান ওরফে হাসানের বিরুদ্ধে অবৈধ নকল বীজ প্যাকেটিং, সরবরাহ ও বাজারজাত করার অভিযোগ এনে সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে। গতকাল সোমবার জীবননগর থানার এসআই আবুল হাশেম বাদী হয়ে এ ডায়েরি দায়েরের পর অভিযোগটি আমলে নিয়ে এজাহার হিসেবে নিয়মিত মামলা রুজু করা হয়।

অভিযোগসূত্রে জানা গেছে, জীবননগর উপজেলার বাঁকা ইউনিয়নের মোক্তারপুর গ্রামের রুহুল হোসেনের ছেলে হাসানুজ্জামান হাসান। তিনি আন্দুলবাড়িয়া বাজারের মিস্ত্রিপাড়া মোড়ে হাসান বীজ ভাণ্ডার নাম দিয়ে বীজ ব্যবসা পরিচালনা করে আসছেন। ঘরজামাই থাকেন আন্দুলবাড়িয়া খালপাড়ার শ্বশুর আমজাদ হোসেনের বাড়িতে। গত রোববার দুপুরে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জীবননগর থানার এসআই আবুল হাশেম সঙ্গীয় ফোর্সসহ অভিযান পরিচালনা করেন ৯নং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পশ্চিম দিকে হাসানের শ্বশুর আমজাদ হোসেনের বাড়িতে। এসআই আবুল হাশেম বলেছেন, সেখান থেকে বিভিন্ন নামিদামি কোম্পানির প্রায় ১০ হাজার খালি প্যাকেটের মধ্যে নমুনা স্বরুপ প্রায় ১ হাজার প্যাকেট ও প্যাকেটজাত করা মেশিন আটক করা হয়। বীজব্যবসায়ী হাসান আগেই টের পেয়ে সটকে পড়েন।

সূত্র জানায়, প্যাকেট ও মেশিন আটক করার পর দিনভর ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী কয়েকজন থানা চত্বরে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন। তারা দেড় লাখ টাকার মিশন নিয়ে পুলিশের সাথে দেনদরবার মত্ত হন। ঘটনাটি এলাকায় ব্যাপক আলোচিত হয়ে উঠলে এলাকার কয়েকজন ব্যক্তি ঘটনা তুলে ধরে পুলিশ সুপারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। পুলিশ সুপারের নির্দেশে রাত সাড়ে ১১টার দিকে জীবননগর থানার এসআই রঞ্জিত কুমার দাস ও এসআই আবুল হাশেম সঙ্গীয় ফোর্সসহ ২য় দফা অভিয়ান চালায় আমজাদ হোসেনের বাড়িতে। অভিযানকালে দেড় বস্তা ভেন্ডি, দু বস্তা লাউ ও এক বস্তা লাল শাকের বীজ উদ্ধার করে জব্দ করা হয়। দুপুরে রেখে যাওয়া বাকি ৯ হাজার খালি প্যাকেট উদ্ধার করতে পুলিশ কর্মকর্তাদ্বয় ব্যর্থ হলে জিজ্ঞাসাবাদে হাসানের স্ত্রী শ্যামলী খাতুন পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে বলে দাবি করেন। জব্দ তালিকায় উদ্ধার দেখানো হয়েছে, হাসান বীজ ভাণ্ডার, রফিকুল বীজ ভাণ্ডার নরসিন্দি, পেঁপে বীজ রেড মাস্টার, এফআই হাইব্রিড শশা, চায়না সিড, রকমারী মিষ্টি কুমড়ো, মোহনের মোটা ডগা পুইশাক, ধন্দল, হাইব্রিড চাল কুমড়া ও ঝিঙের প্রায় ১ হাজার খালি প্যাকেট, প্যাকেটজাত মেশিন, ভেন্ডি, লাউ ও লাল শাকের বীজ।

সূত্র আরও জানায়, এসব বিভিন্ন নামিদামি কোম্পানির খালি প্যাকেট ভারত থেকে এনে এলাকায় সরবরাহ করেন জীবননগরের জনৈক বীজব্যবসায়ী। শুধু আন্দুলবাড়িয়া বাজারের হাসান বীজ ভাণ্ডারের বিরুদ্ধে নকল বীজ প্যাকেটিং, সরবরাহ ও বাজারজাত করার অভিযোগ নয় আরো কয়েকটি বীজ ভাণ্ডারের বিরুদ্ধে নকল বীজ প্যাকেটিং, সরবরাহ ও বাজারজাত করার জনশ্রুতি উঠেছে। ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা আন্দুলবাড়িয়া বাজারের বীজ ভাণ্ডার রয়েছে ১৩টি। বীজ ভাণ্ডারগুলো হলো আব্দুল খালেক ভাই ভাই বীজ ভাণ্ডার, আশকার আলীর রূপসী বীজ ভাণ্ডার, আব্দুল আলীমের সংগ্রাম বীজ ভাণ্ডার, শহিদুল ইসলামের সৌখিন বীজ ভাণ্ডার, মোল্লা মনির হোসেনের মনির বীজ ভাণ্ডার, শহিদুর রহমান ইয়া তুহিন বীজ ভাণ্ডার, বজলুর রহমান, আবু বাক্কার আল্লার দান বীজ ভাণ্ডার, হাসানুজ্জামান হাসানের হাসান বীজ ভাণ্ডার, ডাবলু রহমানের বিশ্বাস বীজ ভাণ্ডার, মইনুর রহমানের বিশ্বাস বীজ ভাণ্ডার, ওমর আলীর কনিকা বীজ ভাণ্ডার, সেলিম হোসেনের সেলিম বীজ ভাণ্ডার।

তথ্য অনুসন্ধান নিয়ে জানা গেছে, এ সব বীজ ভাণ্ডারের মধ্যে ভাই ভাই বীজ ভাণ্ডার, রূপসী বীজ ভাণ্ডার, সংগ্রাম বীজ ভাণ্ডার, সৌখিন বীজ ভাণ্ডার, মনির বীজ ভাণ্ডার, তুহিন বীজ ভাণ্ডার, বজলুর রহমানও হাসান বীজ ভাণ্ডারের বীজ বিক্রি করার সরকারি অনুমতি পত্র রয়েছে। অনুমতি পত্রে বলা হয়েছে, সংশিষ্ট বীজ ব্যবসায়ীদের বীজ আইন ও জাতীয় বীজ নীতির সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধান মেনে চলতে হবে। বিধান অনুযায়ী বীজ (সংশোধনী) আইন ২০০৫ ইং অধ্যাদেশ নং- ১১১১৯৯৭। প্রাপ্ত অনুমতি পত্রে সরকার অনুমোদিত প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির বীজ বিক্রি করা যাবে। নিজস্ব নামে বা বেনামে বীজ প্যাকেটিং করে সরবরাহ ও বাজারজাত করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ ও অনুমতিপত্র বাতিল করা হবে।

সূত্র জানায়, এসব নাম সর্বস্ব সাইন বোর্ডের আড়ালে কয়েকটি বীজ ভাণ্ডারের মালিক আদেশ নির্দেশ উপেক্ষা করে দেদারছে নিম্নমানের নকল ভেজাল বীজ সরবরাহ ও কৃষকদের মাঝে বিক্রি করার অভিযোগ রয়েছে। ইতোঃপূর্বে কয়েকজন অসাধু বীজ ব্যবসায়ী নকল বীজ, খালি প্যাকেট ও প্যাকেট জাককরা মেশিনসহ পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে। নামিদামি কোম্পানির নামে খালি প্যাকেট ক্রয় করে বাড়িতে নিয়ে বীজ প্যাকেটজাত করে সুযোগ বুঝে কয়েকজন অসাধু বীজ ব্যবসায়ী সাইন বোর্ডের আড়ালে এলাকার সরলসোজা কৃষকদের নিকট নকল বীজ বিক্রি করে আসছে। উচ্চ ফলনশীল বলে কৃষকদের মাঝে বিভিন্ন প্রজাতির বীজ বিক্রি করা হলেও বীজতলায় চারা গজায়নি। অনেকে নিম্ন ফলনশীল হওয়ার অভিযোগ তুলে স্থানীয় ইউপির গ্রামসালিস আদালতে ক্ষতিগ্রস্ত কয়েকজন কৃষক ক্ষতিপূরণ দাবি করে নালিশি অভিযোগ দায়ের করেন। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক আন্দুলবাড়িয়া ইউনিয়ন লোকমোর্চার সাধারণ সম্পাদক শেখ আব্দুল ওয়াদুদ, আন্দুলবাড়িয়া মীরপাড়ার মৃত হারান মণ্ডলের ছেলে প্রান্তিক চাষি আব্দুল মজিদের অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, তারা উভয়ে আন্দুলবাড়িয়া বাজারের ভাই ভাই বীজ ভাণ্ডার থেকে উচ্চ ফলনশীল ভুট্টাবীজ ক্রয় করে নিজস্ব জমিতে বপন করেন। ভুট্টাগাছে কোনো মোচ হয়নি। রোগাক্রান্ত হয়ে শুকিয়ে গেছে। সমূহ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তারা সমুদয় ক্ষতিপূরণ দাবি করে ভাই ভাই বীজ ভাণ্ডারের মালিক আব্দুল খালেকের বিরুদ্ধে গ্রাম সালিস আদালতে নালিশি অভিযোগ দায়ের করেন।

আদালতসূত্রে জানা গেছে, অভিযোগটি কয়েক সপ্তাহ শুনানি শেষে বাদী-বিবাদী আপস-মীমাংসা পত্র দাখিল করেন। অপর অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, আন্দুলবাড়িয়া মীরপাড়ার শেখ কেরামত আলীর ছেলে প্রান্তিকচাষি শেখ শাহাবুদ্দিন সম্প্রতি আন্দুলবাড়িয়া বাজারের তুহিন বীজ ভাণ্ডার থেকে ২ বিঘা জমিতে চাষ করার জন্য ১১ কেজি কৃষিবিদ ধনে বীজ ক্রয় করেন। চাষ দিয়ে বীজ বপন করার পর চারা গজায়নি। এমন অভিযোগ তুলে ৪৬ হাজার টাকা চাষাবাদের খরচসহ প্রায় ২ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করে তিনি আন্দুলবাড়িয়া বাজার কমিটির নিকট তুহিন বীজ ভাণ্ডারের মালিক শহিদুর রহমান ইয়ার বিরুদ্ধে নালিশি অভিযোগ দায়ের করেছেন। বাজার কমিটির নেতৃবৃন্দ অভিযোগটি আমলে নিয়ে প্রাথমিক শুনানি শেষে ৭ সদস্যর বোর্ড গঠন করেছে। বোর্ডের সদস্যগণ সরেজমিনে ক্ষেত পরিদর্শন করে গতকাল সোমবার রিপোর্ট প্রদান করেন।

এদিকে তুহিন বীজ ভাণ্ডারের মালিক শহিদুর রহমান ইয়া দাবি করেছেন, তার নিকট বীজ না থাকায় তিনি আন্দুলবাড়িয়া বাজারের কনিকা বীজ ভাণ্ডারের মালিক ওমর আলীর নিকট থেকে ওই বীজ নিয়ে শাহাবুদ্দিনকে দেন। তার বিরুদ্ধে প্রান্তিক কৃষক শাহাবুদ্দিন বাজার কমিটির দফতরে নালিশি অভিযোগ করায় তিনি ওমর আলীর বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ তুলে বাজার কমিটি দফতরে দাখিল করেছেন। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বাজার কমিটির দফতরে উভয়পক্ষের দাখিলি অভিযোগের শুনানি চলছিলো।