রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে গণতন্ত্র নেই

 

স্টাফ রিপোর্টার: রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে নেই কোনো প্রকৃত গণতন্ত্র। এমনকি গণতান্ত্রিক চর্চা নেই জাতীয় সংসদেও। এক্ষেত্রে প্রধান বাধা সংবিধানের সত্তর অনুচ্ছেদ। এ অনুচ্ছেদের কারণেই সংসদ সদস্যরা কোনো ইস্যুতে দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারেন না। কথা বলতে পারেন না মন খুলে। তারা মত প্রয়োগের স্বাধীনতা পেলে, নিজের মতো ভোট দিতে পারলে- ভিন্ন রূপ নিত জাতীয় সংসদের চিত্র। সৃষ্টি হতো গণতান্ত্রিক চর্চায় নতুন আবহ। এতে গতিশীল ও প্রাণবন্ত হতো সংসদ এবং সংসদীয় রাজনীতি।

এসব মন্তব্য করেছেন বিভিন্ন রাজনীতিবিদ, সংসদ সদস্য, সংবিধান বিশেষজ্ঞ, পেশাজীবী সংগঠন ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। তারা সংবিধান থেকে সত্তর অনুচ্ছেদের বিলোপের দাবি জানিয়ে বলেন, স্বাধীনতার পর বিভিন্ন সময়ে সংবিধান কাটাছেঁড়া হয়েছে। বিভিন্ন মহল থেকে এই অনুচ্ছেদ বাতিলের দাবি উঠলেও, সেটি করেনি কোনো সরকারই। সত্তর অনুচ্ছেদ সংসদ সদস্যদের শুধু স্বাধীনতাই খর্ব করেনি, তাদের দল দাস বানিয়ে রেখেছে। দলের বাইরে ভোট দেয়া যাবে না, কথা বলা যাবে না-এমন নজির বিশ্বের কোনো দেশেই নেই বলেও উল্লেখ করেন তারা।

তবে ভিন্ন মত পোষণ করেছেন সরকারদলীয় নেতা ও একই ঘরানার সংবিধান বিশেষজ্ঞরা। সংবিধানের সত্তর অনুচ্ছেদের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে তারা বলেন, বাংলাদেশের মতো একটি দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই অনুচ্ছেদের প্রয়োজন আছে। এতে সরকার স্থিতিশীল হয়, সুসংহত হয় গণতন্ত্র। পাশাপাশি বন্ধ হয়েছে নেতা কেনাবেচার অপসংস্কৃতি।

রাজনৈতিক দল থেকে পদত্যাগের পাশাপাশি দলের বিপক্ষে ভোট দেয়ার কারণে আসন শূন্য হওয়ার কথা বলা হয়েছে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে। এতে বলা হয়েছে, কোন নির্বাচনে কোন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হইয়া কোন ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি-(ক) উক্ত দল হইতে পদত্যাগ করেন, অথবা (খ) সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন, তাহা হইলে সংসদে তাহার আসন শূন্য হইবে, তবে তিনি সেই কারণে পরবর্তী কোন নির্বাচনে সংসদ সদস্য হইবার অযোগ্য হইবেন না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ বিধানের কারণেই সংসদ সদস্যরা দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে পারেন না। কথা বলতে পারেন না প্রাণ খুলে। দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গেলে পদ হারাবেন-এই ভয়ে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা বিসর্জন দিয়ে দলীয় সিদ্ধান্তকেই শিরোধার্য বলে মেনে নেন তারা। সম্প্রতি সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে ফিরিয়ে আনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলের অনেকেই এ উদ্যোগের বিপক্ষে থাকলেও ভয়ে মুখ খুলতে পারেননি।

এমনকি আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতীক নৌকা নিয়ে জয়ী হয়ে সংসদে আসা শরিক দলের অনেক নেতা প্রথমদিকে সরকারের এ উদ্যোগের বিপক্ষে ছিলেন। তারা নিজ নিজ দলের ঘরোয়া আলাপ-আলোচনায় বিচারপতি অপসারণের বিষয়টি একটি মীমাংসিত বিষয় হিসেবে মন্তব্য করেছেন। কিন্তু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যেহেতু এ ইস্যুতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, তাই সদস্য পদ হারানোর ভয়ে এর বিরোধিতা করেননি কেউ। বরং সংশোধনীর পক্ষে ভোট দিতে বাধ্য হয়েছেন।
এর আগের মেয়াদে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধানীর উদ্যোগ নেয় আওয়ামী লীগ। ২০১০ সালের ২১ জুলাই প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনার প্রস্তাব অনুযায়ী সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর জন্য ১৫ সদস্যবিশিষ্ট বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির চেয়ারম্যান করা হয় আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর প্রবীণ সদস্য ও জাতীয় সংসদের তৎকালীন উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে।
ওই সময় সংবিধান সংশোধনের আগে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতা, সংবিধান বিশেষজ্ঞ, অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠন এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের মতামত নেয় এই কমিটি। তখন সংসদ কার্যকর এবং সদস্যদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে অনেকেই সংবিধান থেকে সত্তর অনুচ্ছেদ বাতিলের দাবি জানান। তা সম্ভব না হলে এটি আরও সংশোধন করে শিথিল করার পক্ষে যুক্তি দেন।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত এ দাবি উপেক্ষা করেই ২০১১ সালের ৩০ জুন সংসদে পাস করা হয় সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী। এই সংশোধনীতে জিয়া-এরশাদের ধারাবাহিকতা অনুসরণ করে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এবং বিসমিল্লাহ বহাল রাখায় আপত্তি জানান ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এবং জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুসহ আওয়ামী লীগের শরিক ১৪ দলীয় জোটের সদস্যরা। কিন্তু দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে ভোট দিতে পারেননি তারা সত্তর অনুচ্ছেদের গ্যাড়াকলে পড়ে।

এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেন, মুখে মুখে যে যাই বলুক না কেন রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে গণতন্ত্র নেই। সংসদেও গণতন্ত্র নেই। সবাই জনগণকে গণতন্ত্রের নামে প্রকারান্তরে ধোঁকা দিচ্ছেন। বাস্তবে রাজনৈতিকদলগুলো স্ব স্ব দলের প্রধান নেতার নির্দেশে চলে। সংসদও চলে সংসদ নেতার নির্দেশে। এর বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা কারও নেই। এই যেমন, কিছুদিন আগে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী হলো। প্রধানমন্ত্রী যা চেয়েছেন তার পক্ষেই দলীয় সদস্যরা ভোট দিয়েছেন। বিরোধিতা করার কারও কোনো সুযোগ ছিল না সেখানে। এ জন্য দায়ী সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ। এই অনুচ্ছেদের ফলে সংসদ ও সংসদীয় রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক চর্চার পরিবর্তে স্বৈরগণতান্ত্রিক পদ্ধতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যা দুঃখজনক।

ব্যারিস্টার রফিক-উল হক আরও বলেন, স্বাধীনতার পর যে প্রেক্ষাপটে সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদ সংযোজন করা হয়েছিল। সেই প্রেক্ষাপট এখন আর নেই। আগের মতো সংসদ সদস্যরা কেনাবেচা হন না। তাই গণতন্ত্রের স্বার্থেই এটি বাতিল করা ভালো। আর তা না করা গেলে আরও পরিবর্তন, পরিবর্ধন করে পরিশীলিত করা যেতে পারে। এতে করে সংসদীয় রাজনীতিরই বিকাশ ঘটবে। সংসদ আরও কার্যকর হবে। সংসদ সদস্যরাও স্বাধীনভাবে ভূমিকা পালন করতে পারবেন। ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছায় পরিচালিত হতে তারা বাধ্য হবেন না। প্রকৃত অর্থেই দেশে গণতান্ত্রিক আবহ সৃষ্টি হবে। পৃথিবীর কোনো দেশে এমন আইন থাকার নজির নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

যার হাত ধরে সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদ সেই সংবিধান প্রণেতা বিশিষ্ট আইনজীবী ড. কামাল হোসেনও এখন এই অনুচ্ছেদের পরিবর্তন, পরিমার্জন ও সংশোধন চান। তিনি বলেন, গত ৪০ বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে সংবিধানের অনেক কিছুরই পরিবর্তন, পরিমার্জন ও সংশোধন-সংযোজন প্রয়োজন। হুট করে কিছু না করার চেয়ে ভেবেচিন্তে সংবিধানে হাত দেয়া উচিত। তিনি আরও বলেন, যে প্রেক্ষাপটে সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। সেই প্রেক্ষাপট এখন আর নেই। সংসদীয় গণতন্ত্র বিকাশের স্বার্থে এই অনুচ্ছেদ পরিবর্তন-পরিমার্জন, সংযোজন-বিয়োজন করা যেতে পারে। এমনকি সবাই একমত হলে প্রয়োজনে বাতিলও করা যেতে পারে। ড. কামাল হোসেন বলেন, ঈদের পর একটি জাতীয় সংলাপের আয়োজন করতে যাচ্ছেন তিনি। এতে সংবিধান সংশোধনের একটি রূপরেখা দেয়া হবে।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, পাকিস্তানের তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিলো।

পাকিস্তানে তখন সকালে এক সরকার, বিকেলে আরেক সরকার। লোভ-লালসার বশবর্তী হয়ে তখন সংসদ সদস্যরা বেচা-কেনা হতেন। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে এই অনুচ্ছেদটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, তখনকার প্রেক্ষাপটে অনুচ্ছেদটি ঠিক থাকলেও এটি অনির্দিষ্টকালের জন্য থাকতে পারে না। উন্নত রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিকাশ এবং গণতান্ত্রিক চর্চা সুসংহত করতেই এখন ৭০ অনুচ্ছেদের বিলোপ দরকার। পৃথিবীর কোথাও এমন আইন রয়েছে বলে তার জানা নেই। আর আওয়ামী লীগের জন্য তো এই অনুচ্ছেদের কোনো প্রয়োজনই নেই। তাদের এত সখ্যাগরিষ্ঠতা যে একতরফা অবৈধ সংসদে তাদের দলের সদস্যরা কে কি বললো তাতে কিছু যায় আসে না।

আপনারাও তো ক্ষমতায় ছিলেন, তখন কেন এই অনুচ্ছেদ বাতিলের উদ্যোগ নিলেন না- এ প্রশ্নের জবাবে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, অতীতে কি হয়নি তা নিয়ে আর আলোচনা করে কী লাভ? ভবিষ্যতে ক্ষমতায় গেলে এ অনুচ্ছেদ বাতিলের উদ্যোগ নেবেন কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দলীয় ফোরামে আলোচনা করে তখন এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

বিএনপির আরেক স্থায়ী কমিটির সদস্য এমকে আনোয়ার বলেন, ৭০ অনুচ্ছেদের সবচেয়ে খারাপ দিক হল এখানে কেউ নিজের মত প্রকাশ করতে পারেন না। ভিন্নমত পোষণ করতে পারবেন না। দল যে সিদ্ধান্ত নেবে তাই মেনে নিতে হবে। এর ফলে একজন সংসদ সদস্য যে ইচ্ছা ও আকাক্সক্ষা নিয়ে সংসদে আসেন তা ব্যাহত হয়। তিনি আরও বলেন, সংসদ সদস্যদের কেনাবেচা বন্ধেই মূলত এই অনুচ্ছেদ। ১৯৯৬ সরকারে ছিলো আওয়ামী লীগ, আর বিরোধী দলে ছিলো বিএনপি। তখন বিএনপির দুজন সংসদ সদস্যকে আওয়ামী লীগ তাদের দলে ভিরিয়ে নেয় এবং মন্ত্রী বানায়। বিএনপির ওই দুজন সদস্য ৭০ অনুচ্ছেদ থাকায় তারা তখন সদস্যপদ হারান। তাই এ অর্থে ৭০ অনুচ্ছেদের প্রয়োজনীয়তাও রয়েছে। তবে এটি আরও পরিমার্জন করা যেতে পারে। এমকে আনোয়ার বলেন, পৃথিবীর কোথাও এমন আইন রয়েছে বলে তার জানা নেই।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান বলেন, ৭০ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে সংসদ সদস্যদের হাত-পা বেঁধে রাখা হয়েছে। এর ফলে তারা নিজের বিবেক অনুযায়ী কথা বলতে পারেন না। সংসদে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারেন না। দলের বিপক্ষে গেলে পদ হারাবেন- এই ভয়ে তারা তটস্থ থাকেন। তিনি আরও বলেন, যেহেতু দলের ভেতরেও গণতন্ত্র নেই। তাই সংসদ সদস্যরা সংসদীয় দলের সভায়ও নিজের মতপ্রকাশ করতে পারেন না। দলের প্রধান যা বলেন তাতেই হ্যাঁ বলতে হয় তাদের। এ অবস্থার অবসানে সংবিধান থেকে ৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের দাবি জানিয়ে ড. আকবর আলি খান বলেন, এই অনুচ্ছেদ বাতিল করা হলে সংসদীয় গণতন্ত্রই বেশি লাভবান হবে। সংসদ কার্যকর ও প্রাণবন্ত হবে। সাধারণ মানুষ উপকৃত হবে।