স্টাফ রিপোর্টার: যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চে ত্রিমুখী সংঘর্ষ হয়েছে। এতে গণজাগরণ মঞ্চের একাংশের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকারসহ অন্তত ১৬ জন আহত হয়েছে। গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরের সামনে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে আয়োজিত সমাবেশে এ ঘটনা ঘটে। গণজাগরণ মঞ্চ ভেঙে তিনটি গ্রুপ তৈরি হয়েছে। শুক্রবার তারা নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে।
এ সংঘর্ষের আগে ইমরান এইচ সরকার বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে শাহবাগের মূল চত্বরের দিকে যেতে চাইলে পুলিশ বাধা দেয়। এ সময় পুলিশের সাথে তাদের ধস্তাধস্তির ঘটনা ঘটে। কামাল পাশার নেতৃত্বে এক গ্রুপ, ইমরান এইচ সরকারের নেতৃত্বে এক গ্রুপ এবং বাপ্পাদিত্য বসুর নেতৃত্বে একটি গ্রুপ। এই তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে গণজাগরণ মঞ্চ।
শুক্রবারের ত্রিমুখী সংঘর্ষে কামাল পাশা গ্রুপের আহতরা হলেন- মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ডের সভাপতি মেহেদী হাসান, রেদোয়ান, হাবিবুল্লাহ মেজবাহ, এসএম শাহিন, নয়ন ও মুক্তিযোদ্ধা বিচ্ছু জালাল। এর মধ্যে রেদোয়ানের অবস্থা গুরুতর। ইমরান এইচ সরকারসহ তার গ্রুপের আহতরা হলেন- মামুন, সানজিদ, শিমুল, শাহাদাৎ রাসেল, অমিত রায় শাস্ত, হিমেল, আদনান, তানভীর ও নাইমুল। তারা সবাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন।
দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির দাবিতে শুক্রবার বিকালে শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে পৃথকভাবে সমাবেশ শুরু করে ত্রিধাবিভক্ত গণজাগরণ মঞ্চ। এ সময় ইমরানপন্থিরা লাইব্রেরি সংলগ্ন জাদুঘরের দক্ষিণ পাশে, কামাল পাশাপন্থিরা জাদুঘরের উত্তর পাশে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ সমাবেশ করে। দু গ্রুপের মধ্যে অবস্থান নেয় বাপ্পাদিত্য বসুর নেতৃত্বাধীন শাহবাগ আন্দোলন। সমাবেশে একে অপরকে কটূক্তি ও উস্কানিমূলক করে বক্তব্য দিতে থাকে। এতে শুরু থেকেই ইমরানপন্থী ও কামাল পাশা গ্রুপের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। ইমরানবিরোধী বক্তব্য দেয় বাপ্পাদিত্য বসুর গ্রুপও। সন্ধ্যা ছয়টার পর ইমরান সমাবেশে বক্তব্য শেষে ৭ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এরপর বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে শাহবাগ থানার সামনে থেকে মূল চত্বরের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করেন। ১৫-২০ গজ এগোতেই পুলিশ তাদের বাধা দেয়। এ সময় ইমরান গ্রুপের সঙ্গে পুলিশের ধস্তাধস্তি শুরু হয়। পুলিশকে লক্ষ্য করে পানির বোতল ছুড়ে মারা হয় মিছিল থেকে। একপর্যায়ে পুলিশ তাদের ধাক্কাতে ধাক্কাতে জাদুঘরের সামনে থাক মঞ্চের মিডিয়া সেলের কাছে নিয়ে আসে। এ সময় ইমরান সরকার আকস্মিকভাবে অসুস্থ হয়ে মিডিয়া সেলের টেবিলের ওপরে শুয়ে অচেতন হয়ে পড়েন। এরপর ইমরান গ্রুপের লোকজন মিছিল নিয়ে কামাল পাশার নেতৃত্বে চলতে থাকা সমাবেশের দিকে এগিয়ে যায় এবং হামলা করে। সমাবেশস্থলের চেয়ার কামাল পাশার বিক্ষোভ মঞ্চের দিকে ছুড়ে মারেন তারা। কামাল পাশার লোকজনও ইমরান সরকারের লোকজনের ওপর হামলা চালায়। উভয় পক্ষের মধ্যে লাঠি ও বাঁশ নিয়ে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ সময় কামাল পাশার বিক্ষুব্ধ লোকজন ইমরানের মঞ্চ তৈরির ট্রাকটি ভাঙচুর করেন। এ দু গ্রুপের হামলার মধ্যস্থলে থাকায় সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন বাপ্পা গ্রুপও। সংঘর্ষের সময় পুলিশকে নীরব ভূমিকায় দেখা যায়।
হামলার পর কামাল পাশা ন্যক্কারজনক হামলার প্রতিবাদ ও দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির দাবিতে আজ বিকাল পাঁচটায় বিক্ষোভ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেন।
অপরদিকে ইমরান এইচ সরকার সংঘর্ষের আগে সমাবেশ থেকে ৭ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। কর্মসূচিগুলো হলো- প্রতিদিন বিকাল চারটা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত শাহবাগে অবস্থান কর্মসূচি চলবে। শনিবার সন্ধ্যায় মশাল মিছিল, রোববার বিকালে প্রতিবাদী সঙ্গীত, সোমবার বিকালে মুক্ত সংলাপ, মঙ্গলবার বিকালে মুক্তকথা, বুধবার প্রতিবাদী গান ও কবিতা পাঠ, বৃহস্পতিবার মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক চলচ্চিত্র প্রদর্শন এবং শুক্রবার প্রতিবাদী গণসমাবেশ।
এ সময় ইমরান এইচ সরকার বলেন, আমরা কোনো রাজনৈতিক দল করি না। সরকারকে ক্ষমতা থেকে নামাতে কিংবা কোনো দলকে ক্ষমতায় বসাতে আমরা এখানে আসিনি। আমরা মাঠে নেমেছি একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের প্রকৃত শাস্তির দাবিতে। যতোদিন না এ দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ না হবে, ততোদিন আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। কিন্তু আমাদের এ আন্দোলন নস্যাৎ করতে এবং জামায়াত-শিবিরকে পুনর্বাসন করার জন্য একটি চক্র উঠেপড়ে লেগেছে। ওই চক্র জানে আমরা মাঠে থাকলে তারা জামায়াতের কাছ থেকে টাকা নিয়ে জাতীয় সঙ্গীত গাইতে পারবে না। এসব কারণেই তারা আমাদের বিরুদ্ধে লেগেছে। গণজাগরণ মঞ্চকে বিতর্কিত করে তুলছে। তিনি ওই চক্রকে হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, আপনারা সাবধান হয়ে যান। কারও কাছে বিক্রি হয়ে রাতের অন্ধকারে যুদ্ধাপরাধীদের রায় বিক্রি বন্ধ করেন।
গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম সংগঠক কামাল পাশা চৌধুরী বলেন, আমরা বিকাল থেকে শান্তিপূর্ণভাবে জাদুঘরের সামনে যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির দাবিতে সমাবেশ করছিলাম। সমাবেশে বক্তব্য ও সঙ্গীত চলছিলো। সন্ধ্যার পরপরই বিএনপির দালাল ইমরান এইচ সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে চলমান আন্দোলন নস্যাৎ করতেই হামলা চালায়। এতে আমাদের অন্তত পাঁচ কর্মী আহত হয়েছেন। বিএনপি-জামায়াতের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে ইমরান এইচ সরকার মাঠে নেমেছেন। আন্দোলনের নামে শাহবাগ দখল করে রাতদিন প্যাকেট প্যাকেট বিরিয়ানি খেয়ে মজামস্তি করছে। দেশের সাধারণ মানুষের আবেগকে কাজে লাগিয়ে মঞ্চ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে প্রকৃত আন্দোলনকারীরা সাধারণ মানুষের আবেগে আঘাত মেনে নেবেন না।
তিনি বলেন, আমাদের সমাবেশ চলছিল এমন সময়ে ইমরান এইচ সরকারের ক্যাডাররা সমাবেশের পেছন থেকে চেয়ার ছুড়ে মারে। সেই সঙ্গে পানির বোতল, লাঠি ও ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আন্দোলনের মূল লক্ষ্য থেকে সরে গেছে ইমরান এইচ সরকার। কিন্তু আমরা আন্দোলনের মূল লক্ষ্য থেকে একবিন্দুও সরব না। যুদ্ধাপরাধীর বিচার যতদিন পর্যন্ত সম্পন্ন না হবে ততদিন পর্যন্ত রাজপথে সহযোদ্ধাদের নিয়ে আন্দোলন করে যাব। বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রীর সভাপতি ও শাহবাগ আন্দোলনের সমন্বয়ক বাপ্পাদিত্য বসু বলেন, আমরা শান্তিপূর্ণভাবে জাদুঘরের সামনে সমাবেশ করছিলাম। এমন সময়ে শান্তিপূর্ণ সমাবেশকে অস্থিতিশীল করতে ইমরান এইচ সরকার ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের ক্যাডারদের নিয়ে সাধারণ আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায়। এতে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ভেঙে যায়।
তিনি বলেন, এনজিওর দালালি করতেই আন্দোলনের নামে নষ্টামি করছে দালাল ইমরান। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে প্রকৃতার্থে যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতেই মরিয়া হয়ে উঠেছে। অপরদিকে আন্দোলনের কথা বলে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। এভাবে গণজাগরণ মঞ্চকে সে এখন নিজের আয়-উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছে। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চ নিয়ে শুরু হওয়া নগ্ন খেলা আমরা কখনোই মেনে নেব না।
এ সময় শাহবাগ আন্দোলনের অন্যতম নেতা জাসদ ছাত্রলীগের সভাপতি শামসুল ইসলাম সুমন বলেন, হামলা চালিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করা যাবে না। ইমরান সরকারের চরিত্র এবং উদ্দেশ্য এখন আর কারও বুঝতে বাকি নেই। একের পর এক অঘটনের জন্ম দিয়ে গণজাগরণ মঞ্চের উদ্দেশ্যকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছেন তিনি। শাহবাগ থানার ওসি (তদন্ত) হাবিল হোসেন বলেন, একই জায়গায় কয়েকটি ব্যানারে সমাবেশ করায় যে কোনো ধরনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি ঘটতে পারে এ আশংকায় তাদের মিছিল করতে দেয়া হয়নি। ঘটনার আগ থেকেই পুলিশের ব্যাপক প্রস্তুতি ছিল।