বাড়ির পাশে বাঁশবাগানে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের লাশ

 

মুন্সিগঞ্জ প্রতিনিধি: তখনও সকাল হতে কিছুটা বাকি। অন্ধকার সবে কাটতে শুরু করেছে। ঘুম থেকে উঠে চোখ ডলতে ডলতে পানভাঙার কাজে বের হন হতদরিদ্র দিনমজুর টগর আলী। বাড়ির পাশেই বাঁশঝাড়। কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। মানুষ নাকি অন্য কিছু? সন্দেহ কাটাতে দ্রুত স্ত্রী নাসিমাকে ডাকলেন তিনি। দুজন ভয়ে ভয়ে পা টিপে এগিয়ে গিয়েই দেখলেন ঝুলছে লাশ। তাও আবার নিজেদেরই সন্তান। চিৎকার দিয়েই সংজ্ঞা হারিয়ে পড়ে গেলেন মা নাসিমা। পিতা টগর আলীর চিৎকারে প্রতিবেশীরা ছুটে এলেন।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলো দিনমজুর টগরের ছেলে সমাজ। যে সমাজকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মতো মানুষ করার জন্য ভিটের জমিটাও বন্দক দেয়া, সেই ছেলের মৃতদেহ? পিতা-মাতাসহ নিকটাত্মীয়স্বজনের আহাজারিতে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি কেউ। ঘটনাটি ঘটেছে চুয়াডাঙ্গা আলমডাঙ্গার পূর্ব কমলাপুরে। পুলিশ গতকালই সকাল ৯টার দিকে লাশ উদ্ধার করে। চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালমর্গে দুপুরে ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। বিকেলে নিজ গ্রামে দাফন কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। ঢাকা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয়বর্ষের ছাত্র ছিলেন সমাজ। কী এমন হলো যে, তাকে অকালেই ঝরে যেতে হলো? পরিবারের সদস্যদের অবশ্য দাবি, ৪ দিন আগে ১২শ টাকা নিয়ে ঢাকায় যাওয়ার পর আরো টাকার কথা জানিয়েছিলো সে। পরশু রাতে সে ঢাকা থেকে টাকা নেয়ার জন্য বাড়িতে ফিরছে বলেও জানায়। টাকা দেবো কোত্থেকে? এ কথা শোনার পরও পরশু রাতে সে টাকার জন্যই বাড়ির উদ্দেশে রওনা হয়। বাড়িতে পৌছুনোর আগেই বাড়ির পাশের বাঁশঝাড়ে পরনের বেল্ট দিয়ে গলায় ফাঁস লাগানো ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার হয়।

কেউ মেরে ফেলেছে? নাকি লেখাপড়ার টাকা না পেয়ে অভিমানে আত্মহত্যা? যে ব্যক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের ছাত্র সে আত্মঘাতী হতে পারে? এসব প্রশ্নের মধ্যেই ঘুরপাক খেয়েছে মেধাবী ছাত্র সমাজের মৃত্যুরহস্য। রহস্য উন্মোচনে পুলিশ অবশ্য গড়িমসি করেনি। সংবাদ পেয়ে সকাল ১১টার দিকে আলমডাঙ্গা থানার ওসি (তদন্ত) নাজমুল হুদা. এসআই মকবুল লাশের সুরতহাল রিপোর্ট প্রণয়ন করেন। ময়নাতদন্তের জন্য চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালমর্গে নেয়া হয় লাশ।

এ ব্যাপারে সমাজের পরিবারের লোকজন জানান, ছেলে সমাজ ছিলো মেধাবী। লেখাপড়া শিখে ভালো চাকরি নিয়ে অভাব ঘোচানোর স্বপ্ন ছিলো যেন অদম্য। পিতা-মাতাও তাকে লেখাপড়ার খরচ জোগাতে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটিয়েছেন। পৈত্রিকভাবে পাওয়া দেড় বিঘা জমির মধ্যে এক বিঘা আগেই বিক্রি করতে হয়েছে। বাড়ির ভিটের জমিটা দেখিয়েও কর্জ করেছেন টাকা। একপর্যায়ে লেখাপড়ার খরচ জোগানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। পিতা টগর আলী তা জোগাতে অপরাগতা প্রকাশ করেন। গত ৪ দিন আগে বাড়ি থেকে ১২শ টাকা নিয়ে ট্রেনযোগে ঢাকা যাওয়ার নাম করে বাড়ি থেকে বের হয়। গতপরশু গভীর রাতে বাড়ির পাশের বাঁশবাগানে নিজের প্যান্টের বেল্ট দিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে সে। পিতা দরিদ্র। তিনি পানবরজের পানভাঙার কাজ করেন। দিন হাজিরাই তার সংসার চলে। গতকাল ভোরে পানভাঙার কাজে বের হন। বাড়ির পাশের বাঁশঝাড়ে মানুষের মতো কিছু একটা দেখে স্ত্রীকে ডাকেন। দুজনে গিয়ে দেখেন নিজেদেরই সন্তান ঝুলছে। সন্তান হারিয়ে কোথাও সান্ত্বনা খুঁজে পাচ্ছেন না তারা। গতকাল সন্ধ্যায় গ্রামের কবরস্থানে দাফন কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে।

গ্রামবাসী জানায়, মেধাবী ছাত্র সমাজের পিতা-মাতা পূর্বকমলাপুর ব্রিজ মোড়ের অদূরে মাঠের মধ্যে একটি ঝুঁপরি ঘরের মধ্যে বসবাস করেন। সমাজ ছিলো বড় ছেলে। ছোট ছেলে শিশু। বাড়ির জমির একাংশ বিক্রি করে ঢাকা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করায়। ছেলে বাড়িতে এসে টাকা চায়। এতো টাকা কোথায় পাবে দরিদ্র পিতা-মাতা। ছেলে ঢাকায় যাওয়ার জন্য বারবার তাগিদ দিতে থাকে। টাকা না পেয়েই কি সে আত্মহত্যা করলো? নাকি ঘটনার আড়ালে আরো অনেক ঘটনা লুকিয়ে? এ প্রশ্নের জবাব খুঁজছে পুলিশসহ স্থানীয় সচেতনমহল।