হাড়োকান্দি মাদরাসার কথিত জিন হাজিরকারী শিক্ষক-ছাত্রের গাঢাকা : জেলা লোকমোর্চার ঘটনাস্থল পরিদর্শন
হাড়োকান্দি থেকে ফিরে আলম আশরাফ: আলমডাঙ্গার হাড়োকান্দি গ্রামের শিশু ভুন্দির লাশ তুলে ময়নাতদন্তের দাবি উঠেছে। হত্যার জট খুলে দেয়ায় প্রত্যক্ষদর্শী মদন কুমার সাধু খা পড়েছেন বিপাকে। একদিকে পুলিশের শাসানি অন্যদিকে সত্যের পক্ষে অবস্থান মদনকে সংকটে ফেলে দিয়েছে। কথিত জিন হাজিরকারী মসজিদের মোয়াজ্জিন হাবিবুর রহমান গাঢাকা দিয়েছেন। বিশেষ সুবিধা নিয়ে লাশের ময়নাতদন্ত করতে চাইছে না পুলিশ। জেলা প্রশাসক বলেছেন, ওসি ছাড়া একজন এসআই লাশ দাফনের অনুমতি দিতে পারেন না। এদিকে গতকাল হাড়োকান্দি সরেজমিন পরিদর্শন করেছে চুয়াডাঙ্গা জেলা লোকমোর্চা।
গ্রামসূত্রে জানা গেছে, চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার আইলহাস ইউনিয়নের হাড়োকান্দি গ্রামের কৃষক আবুল কাশেমের মেয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া জান্নাতুল আরা ওরফে ভুন্দি হাড়োকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রী (১০)। গ্রামের অনেকেই বলেছেন, ভুন্দি ক্লাস ফোরে পড়ে। তার বয়স বারো বছর হবে। ভুন্দি গত ৩১ আগস্ট ভোর ৬টার দিকে গাঁয়ের পাশের নুড়িতলার মাঠে তাল কুড়োতে যায়। এরপর সে আর ফিরে না আসায় পরিবারের লোকজন খোঁজাখুঁজি শুরু করে। এ সময় বাড়ির পার্শ্ববর্তী হাড়োকান্দি কওমি মাদরাসা ও লিল্লাহ বোর্ডিঙের শিক্ষকের কাছে যান ভুন্দির পরিবারের সদস্যরা। মাদরাসা শিক্ষক কুষ্টিয়া মিরপুরের হাবিবুর রহমান জিন-ভূতের কল্পকাহিনি শুরু করেন। তিনি নাকি মাদরাসার ছাত্র বুড়োপাড়া গ্রামের আব্দুর রহমানের গায়ে জিন ভর করিয়ে বলেন, ‘জিনরা ভুন্দিকে জিনদের মিশর রাষ্ট্রে নিয়ে গেছে লালনপালন করার জন্য। সেখানে তাকে জিনদের পোশাক পরিয়ে রাখা হয়েছে। কোনো চিন্তা কোরো না।’ এসব কথা প্রচার করেন হাড়োকান্দি মসজিদের ইমাম হরিণাকুণ্ডু উপজেলার পোলতাডাঙ্গার দেলোয়ার হোসেন। পরবর্তীতে বিকেলে আবারও হাড়োকান্দির শিপলুর মেয়ে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রীর গায়ে নাকি জিন ভর করানো হয়। মাঝরাতে ফের নাকি আরেকজনের গায়ে জিন লাগানো হয়। জিনদের দোহাই দিয়ে কেন ভুন্দির মৃত্যুরহস্য ধামাচাপা দেয়ার পাঁয়তারা করছেন মাদরাসার কতিপয় শিক্ষক তা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। অবশ্য কথিত জিন হাজির করানো শিক্ষক হাবিবুর রহমান ও মাদরাসাছাত্র আব্দুর রহমান গাঢাকা দিয়েছেন। গতকাল হাড়োকান্দি গ্রামে সরেজমিন চুয়াডাঙ্গা জেলা লোকমোর্চার নেতৃবৃন্দ গেলে মাদরাসা থেকে বলা হয়, তারা ছুটিতে আছেন। বিষয়টি রহস্যজনক বলে মনে হচ্ছে গ্রামবাসীর কাছে।
ভুন্দি নিখোঁজ হওয়ার পরদিন গত ১ সেপ্টেম্বর সকালে নুড়িতলার মাঠের একটি পুকুর থেকে তার লাশ উদ্ধার হয়। সেসময় মাদরাসার শিক্ষকদের কথামতো পরিবারের সদস্যরা প্রচার করতে থাকে ভুন্দিকে জিনে হত্যা করেছে। আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে জিনে হত্যা করেছে বলে প্রচার করা হলে পুলিশও তা মেনে নেয় এবং ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ দাফনের অনুমতি দেয়। সুরতহাল রিপোর্ট করতে যাওয়া আলমডাঙ্গা থানার এসআই জিয়াউল হক জিয়া বলেন, ভুন্দি মানসিক প্রতিবন্ধী ছিলো এবং তার পিতা-মাতার কারো প্রতি কোনো অভিযোগ না থাকায় লাশ দাফনের অনুমতি দেয়া হয়েছিলো।
গতকাল বুধবার বেলা দেড়টার দিকে চুয়াডাঙ্গা জেলা লোকমোর্চার একটি টিম সরেজমিনে যায় হাড়োকান্দি গ্রামে। তাদের সাথে কথা বলেন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হাড়োকান্দির মৃত সন্ন্যাসী কুমার সাধু খার ছেলে ভ্যানচালক মদন কুমার সাধু খা। তিনি বলেন, রোববার (৩১ আগস্ট-২০১৪) সকাল সাড়ে ৬টার দিকে ভুন্দির চাচাতো ভাই কলেজছাত্র জাকির হোসেন ওরফে জান্নাত এবং ভুন্দি দুজন নুড়িতলার মাঠে তালতলায় ছিলো। আমি গিয়ে ওদের দেখার পর তাল কুড়োতে না গিয়ে চলে আসি। এরপর থেকেই ভুন্দিকে আর পাওয়া যায়নি।
মদনের কথা অস্বীকার করেছে অভিযুক্ত জাকির। সে বলেছে, ওইদিন সে তালতলায় যায়নি। এ কথায় সন্দেহ ঘনীভূত হয়। এ ছাড়া জাকিরের কথায় নানা রকম অসঙ্গতি ধরা পড়ে লোকমোর্চার নেতৃবৃন্দের কাছে। এ সময় উপস্থিত ছিলেন জেলা লোকমোর্চার সাধারণ সম্পাদক শাহ আলম সনি, সাংগঠনিক সম্পাদক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান কোহিনুর বেগম, জীবননগর উপজেলা লোকমোর্চার সভাপতি আবুল কালাম আজাদ, জেলা লোকমোর্চার নির্বাহী সদস্য জুলহাস মিল্টু, লিটু বিশ্বাস, মানিক আকবর, আলমডাঙ্গার জেহালা ইউনিয়ন লোকমোর্চার সাধারণ সম্পাদক দেবেন্দ্র নাথ দোবে বাবুলাল, জেলা লোকমোর্চার সচিব শাহনাজ পারভীন শান্তি প্রমুখ।
গ্রামবাসীরা লোকমোর্চার নেতৃবৃন্দের কাছে অভিযোগ করে বলেন, ভুন্দির মৃত্যুরহস্য উদঘাটন করা প্রয়োজন। এটি একটি হত্যাকাণ্ড। এর সাথে যে বা যারাই জড়িত থাক না কেন এ রহস্য উন্মোচন করা দরকার। কিন্তু পুলিশ এ ব্যাপারে ম্যানেজ হয়ে গেছে বলে আমাদের মনে হচ্ছে। ভুন্দির লাশ ময়নাতদন্ত করলেই আসল রহস্য উন্মোচিত হবে বলে আমাদের বিশ্বাস। এ জন্য অভিযুক্ত জাকিরের পাশাপাশি মাদরাসা শিক্ষকদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করা দরকার।
ভুন্দির লাশ ময়নাতদন্ত প্রসঙ্গে চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক মো. দেলোয়ার হোসাইন বলেন, একজন এসআই লাশ দাফনের অনুমতি দিতে পারেন না। যদি কোনো অভিযোগ আপত্তি না থাকে সেক্ষেত্রে থানার ওসি লাশ দাফনের অনুমতি দিতে পারেন। অভিযোগ থাকলে অবশ্যই জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করতে হবে লাশ দাফনের জন্য।