ওরা কাঁদলেনঅন্যদের কাঁদালেন

স্টাফ রিপোর্টার: আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গুম-খুন হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা একত্রেমিলিত হয়েছিলেন জাতীয় প্রেসক্লাবে। মৌলিক অধিকার সুরক্ষা কমিটি আয়োজিতস্বজনদের ব্যথা : গুম, খুন, নির্যাতন আর নাশীর্ষক সম্মেলনে তারা নিজেরাকান্নায় ভেঙে পড়েন; অন্যদেরও কাঁদান। স্বজন হারানো এসব পরিবারের সদস্যরাএকজোট হয়ে বিচার চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে। দেশের আর কেউ যেনএভাবে তাদের প্রিয়জনকে হারাতে না হয় সে আকুতিও ছিলো তাদের কণ্ঠে।

গতকাল শনিবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে শুরু হয় সম্মেলনটি। এতে গুম-খুন হওয়া শতাধিকব্যক্তির স্বজনরা যোগ দেন। তারা তাদের প্রিয়জনদের হারানো কথা তুলে ধরেন। এসময় কেউ কেউ কান্নায় ভেঙে পড়েন; সাথে কাঁদতে দেখা যায় মঞ্চে উপবিষ্টবিশিষ্টজনসহ উপস্থিত সবাইকে।

প্রিয়জন হারানো এই স্বজনরা প্রায় সবাই সম্মেলনস্থলে হাজির হয়েছেন স্বজনেরছবি বুকে টাঙিয়ে। প্রত্যেকেই বলেছেন, তারা র‌্যাব, ডিবি, থানারকর্মকর্তাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। কোনো সুরাহা হয়নি। কেউ তাদের খোঁজ নেননা।
অনুষ্ঠানে লাকসামের সাবেক সংসদ সদস্য সাইফুল ইসলামের মেয়ে মাশরুফা ইসলামবলেন, আমরা কেউই দেশে স্বাধীনভাবে ঘুরতে পারছি না। নিজের দেশেই নাগরিকরাগুম হচ্ছেন তাহলে কী লাভ হলো স্বাধীন হয়ে? গত বছরের নভেম্বরে সাইফুল ইসলামসহ তিনজনকে র‌্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়াহয়। এর মধ্যে একজনকে ফেরত পাওয়া গেলেও সাইফুল ইসলাম ও হুমায়ুন কবিরের কোনোখোঁজ এখনো মেলেনি।

মাশরুফা বলেন, আমার বাবাকে কী করা হয়েছে, আমরা জানি না। তিনি জীবিত, নাতাকে মেরে ফেলা হয়েছে তাও জানি না। এ ঘটনায় মামলা করা হলেও কোনো অগ্রগতিনেই। এর পরও নানা রকমেরচাপ রয়েছে মামলা না চালানোর জন্য। আমরা এখনোনিরাপত্তাহীন।

লক্ষ্মীপুরে র‌্যাবের হাতে নিহত চিকিৎসক ফয়েজ আহমেদের মেয়ে উজমা কাওয়ারবলেন, আমার বাবা একজন চিকিৎসক ছিলেন। যুদ্ধক্ষেত্রেও চিকিৎসকরা বিশেষসুবিধা পান। কিন্তু আমার বাবাকে হাত-পা বেঁধে ছাদ থেকে ফেলে দিয়ে ঠাণ্ডামাথায় গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এটা তো কোনো যুদ্ধক্ষেত্র ছিলো না। তারপরওকেন এ ঘটনা ঘটলো।গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর লক্ষ্মীপুরে র‌্যাবের হাতে ফয়েজ আহমেদ নিহত হন।

উজমা কাওসার বলেন, আমরা জানি না আমার বাবার অপরাধ কী ছিলো।তিনি জানান, তারা এখনো লক্ষ্মীপুরে থাকতে পারছেন না, নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। বাবারমরদেহ পাওয়ার বিষয়টিকে সৌভাগ্য হিসেবে মন্তব্য করে উজমা বলেন,এখনোঅনেকেই জানেন না, তাদের স্বজনরা কী অবস্থায় আছেন, কোথায় আছেন। সে হিসেবেআমরা ভাগ্যবান।
পুত্র হারানো বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার বাসিন্দা রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন, আমার ছেলে কী অপরাধ করেছিলো যে গায়েব হয়ে গেলো?প্রথমে র‌্যাবের কাছে গেলাম।তারপর ডিবির কাছে গেলাম। থানায় গেলাম। কোথাও নেই আমার ছেলেটা। প্রশাসনতুলে নেয়ার কথা অস্বীকার করে। তাহলে আমার সামনে দিয়ে আমার ছেলেকে তুলেনেয়ার যে ঘটনা ঘটল সেটা কী?আমার ছেলে কী অপরাধ করেছিলো যে গায়েব হয়ে গেলো? নয় মাস ধরে নিখোঁজ রুহুল আমিনের ছেলে আদনান। যে রাতে ছেলে আদনানকে বাড়িথেকে নিয়ে যাওয়া হয় সে রাতের কথা বলতে গিয়ে রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন, রাততখন ২টা বাজে। হঠাৎ দরজায় একসাথে অনেক লোক ধাক্কা দিতে শুরু করেছে। আমিতখন বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছি। এমনভাবে দরজা ধাক্কাচ্ছে কারা?আমি উঠে গিয়ে দরজাখুললাম। খুব কর্কশ গলায় জিজ্ঞেস করলো, এটা কি আদনানদের বাসা?বললাম, হ্যাঁ। মুখের কথা শেষ হতে না হতেই ওরা চোর-ডাকাতের মতো ঘরে কি যেন খুঁজতেলাগলো। শোয়ারঘর, বসারঘর, পাকঘর, বাথরুম কিছুই বাদ দিলো না। একপর্যায়ে ওরাআদনানের ঘরে ঢুকে ওকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গেলো। আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলোঘরের এক কোণায়। যাওয়ার সময় বলে গেলো ওরা র‌্যাব থেকে এসেছে। আদনানের সাথেকথা বলে ছেড়ে দেবে।

র‌্যাবের এই কথা শুনে আশ্বস্ত হয়েছিলেন রুহুল আমিন। তিনি বলেন, র‌্যাবেরকথা আমি বিশ্বাস করতাম। পাঁচ মিনিটের জায়গায় রাত শেষে ভোর হয়ে গেলো। আমিবেরিয়ে পড়লাম ঘর থেকে।কিন্তু র‌্যাব-২, গোয়েন্দা পুলিশ, থানা কোথাওআদনানের খোঁজ পাননি তিনি। ছেলের খোঁজ না পেয়ে অসহায় বাবা তাই প্রশ্ন করলেন, আমার ছেলে কী অপরাধ করেছিলো যে গায়েব হয়ে গেলো?

বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে তুলে নেয়া সাজেদুল ইসলামের বোন সানজিদা ইসলামশোনান ভাই নিখোঁজের কথা। বলেন, আমার ভাইয়ের একটাই দোষ, বিএনপি করতো।পারিবারিকভাবেই আমরা রাজনীতির সাথে যুক্ত। গত ৪ ডিসেম্বর অস্ত্রশস্ত্রেসজ্জিত তিনটি গাড়িতে করে র‌্যাব-১ আমার ভাইসহ কয়েকজনকে তুলে নিয়ে যায়। আমরাদেরি করিনি। আধাঘণ্টার মধ্যে মা-বাবা-বোন নিয়ে র‌্যাব-১-এ যাই। নয় মাস ধরেওরা মিথ্যা বলছে। বলছে, ওরা কিছু জানে না। ওরা যদি তুলে নিয়ে না-ও যায়, ওরা খুঁজে দিক।

সানজিদা বলেন, আমার বৃদ্ধ মা প্রতি সপ্তায় একবার র‌্যাবের ডিজি, এডিজি, সিইওর দরজায় দাঁড়িয়ে থাকেন। চিৎকার করে কাঁদেন। আমার ভাইয়ের মেয়েরাঅপেক্ষায় থাকে। এ দৃশ্য অসহনীয়। আমার ট্যাক্সের টাকায় প্রতিরক্ষা বাহিনীচলে। ওরা কেন উত্তর দেবে না?একটাই দাবি, হয় ফেরত দিন, নয় উদ্ধার করে দিন।ফেরত আপনাদের দিতেই হবে। উত্তর দিতেই হবে। আমাকে জানতেই হবে, ওরা কোথায়?