ঝিনাইদহের বারোবাজারে ট্রেনের ধাক্কায় বরযাত্রী বাস চুর্ণবিচূর্ণ : গুরুতর জখম ১৬ জনের মধ্যে একজনের এখনও জ্ঞান ফেরেনি

 

ফলোআপ: ঝিনাইদহের বারোবাজার ট্রেনের ধাক্কায় বরযাত্রী বাস চুর্ণবিচূর্ণ

 

 

ঝিনাইদহ অফিস: ২৮ দিনেও জ্ঞান ফেরেনি ট্রেন দুর্ঘটনায় আহত মিঠু সাহা’র। আই.সি.ইউতে পড়ে আছেন এই যুবক। প্রতিদিন তার খরচ হচ্ছে ১৫ হাজার টাকা। প্রথম ৬ দিন খরচ হয়েছে ২ লাখ ৪০ হাজার। আর খরচ দিতে না পেরে হাসপাতাল ফেলে বোনের বাড়িতে গিয়ে উঠেছেন মিরা সরকার (৪০)। তার শরীরে পচন ধরেছে। টাকা জোগাড় করে আবার হাসপাতালে যাবেন বলে কাঁদতে কাঁদতে জানান মিরা সরকার।

একইভাবে কুষ্টিয়া অর্থোপেডিক অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন স্বামী পরিত্যক্তা অর্পণা রাণী (৩৮)। স্বামী-সংসার হারিয়ে একমাত্র মেয়ে অনুকে নিয়ে থাকতেন কুষ্টিয়াতে বোন অর্চনা রাণীর বাড়িতে। সেই বোনটিই চিকিৎসা করাচ্ছেন অর্পণা রাণীর। এখন পর্যন্ত দু লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছে। বোনের চিকিৎসা করাতে গিয়ে সবকিছু শেষ করে ফেলেছেন। এখনও অনেক টাকার প্রয়োজন। অর্চণা রাণী কষ্টের সাথে বলেন জানি না এই টাকা কোথা থেকে আসবে।

এরাই শুধু নয় গত ১ আগস্ট ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার বারোবাজার রেল ক্রসিঙে বরযাত্রীবাহী গাড়ির সাথে ট্রেনের ধাক্কায় আহত ১৬ জন বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসার অভাবে কষ্ট পাচ্ছেন। তাদের অনেকের অবস্থা খুবই গুরুতর হওয়ায় অনেক টাকার প্রয়োজন। যা তাদের পরিবারের পক্ষ থেকে জোগাড় করা সম্ভব হচ্ছে না। যে কারণে তাদের ঠিকমতো চিকিৎসা হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন আহতদের পরিবারের লোকজন। এখন পর্যন্ত নিজেদের আত্মীয়স্বজন ছাড়া তাদের সহযোগিতায় কেউ এগিয়ে আসেননি বলে জানিয়েছেন তারা। এই ঘটনায় ঘটনাস্থলে মারা যান ৯ জন, পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান আরো দুজন। যাদের সকলের বাড়ি ঝিনাইদহের শৈলকুপার ফুলহরি গ্রামে। ওই গ্রামের স্কুলশিক্ষক তাপস বিশ্বাসের বিয়েতে গিয়েছিলেন তারা।

আহতদের পরিবারের লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, দুর্ঘটনায় মোট আহত হন ৪৭ জন। যাদের মধ্যে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান দুজন। বাকিদের মধ্যে ২৯ জন চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরে গেছেন। এখনও বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ১৬ জন। এদের মধ্যে মিঠু সাহা ঢাকা বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে রয়েছেন। তার অবস্থা খুবই খারাপ। ঘটনার পর থেকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় রয়েছেন তিনি। তার ভাই গৌতম সাহা জানান, তাদের আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। ভাইয়ের এই চিকিৎসা খরচ জোগাতে গিয়ে সব শেষ করে ফেলেছেন। এখন ভাইয়ের জ্ঞান ফিরলো না। ভেবে পাচ্ছেন না টাকার জন্য ভায়ের চিকিৎসা করাতে পারবেন কি-না। ঢাকা অর্থোপেডিক হাসপাতাল চিকিৎসাধীন রয়েছেন অমিত বিশ্বাস। তিনি জানান, সামান্য ব্যবসা করে সংসার চালাতেন। এখন চিকিৎসা করাতে গিয়ে ধার-দেনা করছেন। তারপরও টাকা জন্য ভালোভাবে চিকিৎসা করাতে পারছি না। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল চিকিৎসাধীন আহত মিঠুন বিশ্বাসের ভাই সুব্রত বিশ্বাস জানান, খুবই কষ্ট করে টাকার জোগাড় করছেন। ভাইকে বাঁচাতে হলে তাদের ধার-দেনা হলেও করতে হচ্ছে। তাবে তাদের দুঃখ সারকার বা রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে এলেন না। তিনি অভিযোগ করেন, রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারনে এ দুর্ঘটনা। কিন্তু সেই কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটি করেই তাদের দায়িত্ব শেষ করেছেন।

আহত মিরা সরকারের মেয়ে প্রভাতী রাণী জানান, তার বাবা ৩ মাস হলো মারা গেছেন। মা ছাড়া পৃথীবিতে তার কেউ নেই। দুর্ঘটনায় মায়ের একটি পায়ের মাংশ সব উঠে গেছে। ডায়াবেটিস থাকায় পায়ে পচন ধরেছে। ফরিদপুর ডায়াবেটিকস হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। হাসপাতালে চিকিৎসার খরচ জোগাড় করতে না পেরে নয়ন তারা নামের এক বোনের বাড়িতে উঠেছেন। তিনিও ওই দুর্ঘটনায় আহত। টাকা জোগাড় হলে মাকে আবার হাসপাতালে নেবেন বলে জানান প্রতিভা রাণী।

ওই ঘটনায় আহত সংবাদিক অরিত্র কুন্ডু জানান, যারা বাড়িতে গেছেন তাদের মধ্যেও অনেকের এখনও চিকিৎসা প্রয়োজন। কিন্তু টাকার অভাবে তারা বাড়ি ফিরতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি অভিযোগ করেন এতো বড় একটা ঘটনায় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ, সরকার বা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা কেউ তাদের খোঁজ করেনি। আর্থিক সহযোগিতার দাবি নিয়ে তারা ঝিনাইদহ শহরে একটা মানববন্ধনও করেছেন, কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। তিনি দাবি করেন, টাকার অভাবে আহতদের কেউ কেউ এখনও মারা যাবেন।

এদিকে দুর্ঘটনার পর ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসন কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটি তাদের রিপোর্ট দিয়েছেন। এতে ক্রসিঙের গেটম্যান, বারোবাজার স্টেশন মাস্টার ও বাসের চালককে দায়ী করা হয়েছে। কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক নাসরিন জাহান জানান, তারা প্রতিবেদন দিয়েছেন। এখন ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন ঊর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ।

অপরদিকে রেলওয়ের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটিও রিপোর্ট জমা দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলীয় ব্যবস্থাপক আব্দুল আওয়াল। তিনি বলেন, রিপোর্ট অনুযায়ী তারা ব্যবস্থা নেবেন। তবে আহতদের সহযোগিতার বিষয়ে তিনি জানান, রেলওয়ের এ জাতীয় ঘটনায় সহযোগিতার সুযোগ নেই। তবে মানবিক কারণে ঘটনার দিন তারা যে যা পেরেছেন সহযোগিতা করেছেন।