দুর্নীতির রাহুগ্রাসে শিক্ষা প্রকল্প:সংসদীয় স্থায়ী কমিটির উদ্বেগ

 

 

স্টাফ রিপোর্টার: শিক্ষারবিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে ভয়াবহ অনিয়ম-দুর্নীতি চলছে। প্রকল্প শেষ না করেইবিল গ্রহণ, প্রকল্প প্রস্তাবনার শর্ত না মেনে নির্মাণ কাজ, নির্মাণ কাজেনকশা অমান্য, প্রস্তাবিত আকারের চেয়ে ছোট ভবন নির্মাণ, নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার, উপবৃত্তি প্রদানে অনিয়ম, প্রশিক্ষণ শেষ না করেই সৃজনশীলপদ্ধতি বাস্তবায়ন, স্যানিটেশন ব্যবস্থার শর্ত অমান্য ও টয়লেট নির্মাণ নাকরা, নির্মিত ভবনে আসবাবপত্র সরবরাহ না করাসহ নানা ঘটনা ঘটছে বিভিন্নপ্রকল্পে। উপরন্তু এসব অনিয়ম অনেকটা প্রতিকারহীনভাবেই চলছে। এ কারণে এডিপিরমূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে।

গত ১০ আগস্ট সরকারি প্রতিশ্রুতি সম্পর্কিতসংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে সরকারের ‘বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ওমূল্যায়ন বিভাগ’ (আইএমইডি) একটি প্রতিবেদন পেশ করে। ওই প্রতিবেদনেই এসবঅনিয়ম-দুর্নীতির চিত্র ফুটে উঠেছে। জানা গেছে, প্রকল্পের বিভিন্নঅনিয়ম-দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র এবং প্রকল্প ও প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নেধীরগতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সংসদীয় কমিটি।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ওইদিন বৈঠকে বিগত সংসদের প্রথম অধিবেশন থেকে শেষ অধিবেশন পর্যন্ত (সংসদের)ফ্লোরে প্রধানমন্ত্রী এবং শিক্ষামন্ত্রীর দেয়া প্রতিশ্রুতির ওপরও পৃথক দুটিপ্রতিবেদন দাখিল করা হয়। এতে দেখা গেছে, বিগত ৫ বছরে প্রধানমন্ত্রী শিক্ষাবিষয়ে মোট ৫৯টি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয় মাত্র ২০টিবাস্তবায়ন করেছে। বাকিগুলোর মধ্যে ২০টির বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াধীন, ১০টিরকার্যক্রম চলমান আর ১টি অবাস্তবায়িত হিসেবে দেখানো হয়েছে। অন্যদিকে সংসদেরফ্লোরে শিক্ষামন্ত্রী মোট ২৩টি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এরমধ্যে মাত্র ৮টিবাস্তবায়িত হয়েছে। জানতে চাইলে কমিটির সভাপতি কাজী কেরামত আলী বলেন, বৈঠকে শিক্ষা ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন ও অগ্রগতিরবিষয়েও পর্যালোচনা হয়েছে। আইএমইডি যেসব অনিয়মের তথ্য তুলে ধরেছে তা খতিয়েদেখবে কমিটি। বিষয়টি শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি এবংমন্ত্রণালয়কেও খতিয়ে দেখতে বলা হয়েছে। তিনি আরও জানান, প্রয়োজনে তদন্তকমিটি গঠন করা হবে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিরসভাপতি ডা. আফছারুল আমিন এ বিষয়ে বলেন, ‘প্রকল্প বাস্তবায়নে কোনো ধরনেরঅনিয়ম-দুর্নীতি হলে তা আমরা খতিয়ে দেখবো। তবে এখন পর্যন্ত আমরা কোনো তথ্যপাইনি। সংবাদপত্রে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে বা সংসদের অন্য কোনো কমিটি এব্যাপারে অনুরোধ করলেও তা আমলে নেয়া হবে।’ তিনি আরও জানান, আইন অনুযায়ীতারা বিভিন্ন বিষয়ে পর্যালোচনা ও অনুসন্ধান শেষে মন্ত্রণালয়কে সুপারিশকরেন। তারাই এ বিষয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারেন।

আইএমইডির প্রতিবেদনেবলা হয়েছে, ‘তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে নির্বাচিতবেসরকারি কলেজসমূহের উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পে কার্যক্রম গ্রহণের ক্ষেত্রেবিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন আনা হয়। কিন্তু এর জন্য প্রকল্প পরিচালকসহ যথাযথকর্তৃপক্ষের কোনো অনুমোদন নেয়নি পূর্ত কাজ বাস্তবায়নকারী সংস্থা শিক্ষাপ্রকৌশল অধিদফতর (ইইডি)।’ উদাহরণ হিসেবে প্রতিবেদনে পল্লবীতে বঙ্গবন্ধুডিগ্রি কলেজের পাইল কাস্টিংয়ের তথ্য তুলে ধরা হয়। এতে আরও বলা হয়, কোনোকোনো ক্ষেত্রে ভবন নির্মাণে ডিপিপির অর্থ সংস্থানের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখেকার্যক্রম সম্পাদন করা হচ্ছে। আবার কলেজের ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রেজলাভূমি, ডোবা ও পুকুর এলাকা নির্বাচন করা হয়েছে। এতে কাজের ব্যয় বেড়েযাবে। ‘সেকেন্ডারি এডুকেশন কোয়ালিটি অ্যান্ড অ্যাকসেস এনহ্যান্সমেন্ট’ (সেকায়েপ) প্রকল্পে যাদের উপবৃত্তি দেয়া হচ্ছে, তাদের অনেকেই এ অর্থ পাওয়ারযোগ্য নয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার নাজিরপুর উচ্চবিদ্যালয় ও বড়াইগ্রাম উপজেলার সেন্ট যোসেফ উচ্চ বিদ্যালয়ে উপবৃত্তি প্রাপ্তছাত্রছাত্রীদের ২০ ভাগই পাওয়ার যোগ্য নয়। এ ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত ত্রুটি করাহয়েছে। এ প্রকল্প থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে গণিত ও ইংরেজি বিষয়ে অতিরিক্তক্লাসের ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু প্রকল্পের এ লক্ষ্যটি অর্জিত হচ্ছে না।ছাত্রছাত্রীদের ভালো ফল অর্জনের সংখ্যা কম। এ প্রকল্পের মাধ্যমে স্যানিটেশনব্যবস্থা উন্নয়নের কথা থাকলেও আইএমইডি তাদের পরিদর্শনে তার কোনো নজিরপায়নি। এভাবে প্রকল্পের অধীন শিক্ষক-অভিভাবক সমিতি গঠন, প্রশিক্ষণ প্রদান, জেলা শিক্ষা অফিসের সাথে উপজেলা শিক্ষা অফিসের সমন্বয়ের কোনো কার্যক্রমেইসঠিকভাবে বাস্তবায়ন দেখতে পায়নি আইএমইডি।

‘শেরেবাংলা কৃষিবিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন’ প্রকল্পের অধীনে ৪০০ আসনবিশিষ্ট ১০তলাভিতের ওপর ৫তলা ছাত্রহল নির্মিত হচ্ছে। ৬৬০০ বর্গমিটার আয়তনের এ ভবননির্মাণের কথা থাকলেও ৫৪০০ বর্গমিটার আয়তনের ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এধরনের পরিবর্তনের জন্য প্রকল্প প্রস্তাবনা সংশোধনের প্রয়োজন থাকলেও তা করাহয়নি। এমন কি বিষয়টি কীভাবে নিষ্পত্তি হয়েছে সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্টকর্মকর্তারা কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। আবার এ প্রকল্পের অধীনেইনির্মিতব্য একাডেমিক ভবন ২০১৪ সালের মার্চে শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু ২০১৩সালের অক্টোবরে পরিদর্শনকালে কাজ মাত্র অর্ধেক শেষ হয়েছে। বাকি সময়ে কাজশেষ করা সম্ভব হবে না বলে মনে করে আইএমইডি। তাদের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ভবনটি নিম্নর্মাণে নিমানের ইটসহ অন্যান্য সামগ্রী ব্যবহার করা হয়েছে। আর ৪০০আসনবিশিষ্ট ছাত্রীহল নির্মাণে অপ্রশস্ত চারটি সিঁড়ি ব্যবহার করা হয়েছে।

প্রতিবেদনেবলা হয়, ‘মাধ্যমিক শিক্ষাখাত উন্নয়ন প্রকল্প’র (এসইএসডিপি) অধীনে সৃজনশীলপদ্ধতি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। কিন্তু পরিদর্শনের সময়ে এর আর্থিক অগ্রগতি ৮৫ভাগ হলে প্রশিক্ষণের অগ্রগতি মাত্র ৫০ ভাগ। এতে আরও বলা হয়, প্রশিক্ষণ কাজশেষ না করেই নতুন কারিকুলাম প্রস্তুত করে সৃজনশীল পদ্ধতির নতুন পুস্তকপ্রণয়নের কারণে যথাযথভাবে পাঠদান করা সম্ভব হবে না। এ সংশয়ের বাস্তব প্রমাণদিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, শিক্ষকরা সৃজনশীলের প্রশ্ন তৈরি করতে পারেন না।যে কারণে ৮৫ ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক সমিতি থেকে প্রশ্নপত্র সংগ্রহকরা হচ্ছে পরীক্ষার জন্য।

এ প্রকল্পের অধীনে অবকাঠামো নির্মাণেরক্ষেত্রেও অনিয়ম রয়েছে। রাজশাহীর পবা উপজেলার এমআরকে উচ্চ বিদ্যালয় এবংপুঠিয়া উপজেলার ধোকরাকুল উচ্চ বিদ্যালয়ে ৩টি নতুন শ্রেণিকক্ষ নির্মাণ করাহলেও অনুমোদিত ডিপিপি অনুযায়ী টয়লেট ব্লক নির্মাণের কথা থাকলেও তা করাহয়নি। অর্থাৎ এ অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে। কিন্তু প্রকৌশলীরা তা ধরেননি।

প্রতিবেদনেদেখা যায়, ‘নির্বাচিত বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়সমূহের ভৌত অবকাঠামোউন্নয়ন’ প্রকল্পের অধীনে ভবন নির্মাণ করা হলে রংপুরের গঙ্গাচড়ায় বিভিন্নবিদ্যালয়ে আসবাবপত্র সরবরাহ না করা, ইডেন মহিলা কলেজে ছাত্রীনিবাস নির্মাণেকোনো জলাভূমি ভরাট না করলেও সে খাতে প্রায় ২০ লাখ টাকা বিল করা, ভবনরক্ষণাবেক্ষণের জন্য লোকবলের সংস্থান না রাখা, ভবনের নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ারপরও প্রায় ২ বছর তা হস্তান্তর না করা, ‘কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়স্থাপন-প্রথম পর্যায় (২য় সংশোধিত) শীর্ষক সমাপ্ত প্রকল্পের অধীন নিম্নমানেরসামগ্রীতে নির্মিত প্রশাসনিক ভবনের ২য় তলায় ফাটল, নবাব ফয়জুন্নেসা ছাত্রীহলের পানি সরবরাহ এবং বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা অতি নিম্নমানের, বঙ্গবন্ধু হলেরবিভিন্ন স্থানে ফাটল এবং শর্তানুযায়ী সব শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের কম্পিউটারপ্রশিক্ষণ না দেয়ার তথ্য উল্লিখিত হয়েছে। প্রতিবেদনে শিক্ষা মন্ত্রণালয়েরচলমান ও সমাপ্ত বিভিন্ন প্রকল্পের মধ্যে দৃষ্টান্তস্বরূপ ১১টি প্রকল্পেরতথ্য দেয়া হয়।