বিশ্ববাজারেকমলেও বাংলাদেশে বেড়েই চলেছে খাদ্যপণ্যের দাম

 

 

জুনেরচেয়ে জুলাইয়ে খাদ্যপণ্যের গড় মূল্য বেড়েছে ২ দশমিক ২৮ ভাগ :এক বছরে বেড়েছে৭ শতাংশের বেশি

স্টাফ রিপোর্টার: টানাকয়েক মাস ধরে বিশ্ব বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম কমলেও বাংলাদেশে বাড়ছে। দামকমতে কমতে জুলাইয়ে বৈশ্বিক খাদ্য মূল্যসূচক ছয় মাসের মধ্যে সর্বনিম্নে নেমেএলেও দেশের বাজারে দাম বেশ ঊর্ধ্বমুখি। সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যানব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাবে জুনের চেয়ে জুলাইয়ে খাদ্যপণ্যের গড়মূল্যবেড়েছে ২ দশমিক ২৮ ভাগ। এক বছরে বেড়েছে ৭ শতাংশের বেশি। সরকারের আরেকসংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশও (টিসিবি) বলছে একই কথা।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) বৈশ্বিক খাদ্যমূল্যের জুলাই মাসেরমূল্যায়ন প্রতিবেদনে দেখা যায়, খাদ্যের মূল্যসূচক টানা চার মাসের মতোকমেছে। পাশাপাশি তা পৌঁছেছে ছয় মাসের মধ্যে সর্বনিম্নে। অর্থাৎ খাদ্যপণ্যের দাম ৬ মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম। সংস্থাটি বলছে- ভুট্টা, গম, তেল, তেলবীজের আন্তর্জাতিক দর নিম্নমুখি থাকায় সূচক কমছেই।

বিশ্বের বিভিন্ন বাজারে খাদ্যদ্রব্যের দাম তুলনামূলকভাবে বিশ্লেষণ করেমাসিক ভিত্তিতে প্রতিবেদন প্রকাশ করে এফএও। আন্তর্জাতিক বাজারে মাসজুড়েখাদ্যপণ্যের লেনদেনের ওপরই এ সূচক ওঠানামা করে। জুলাইয়ে এফএওর খাদ্যমূল্যেরগড় সূচক দাঁড়িয়েছে ২০৩ দশমিক ৯ পয়েন্টে। এটি জুনের চেয়ে ৪ দশমিক ৪ পয়েন্টকম। এছাড়া গত বছরের জুলাইয়ের চেয়ে কম ১ দশমিক ৭ শতাংশ।

সংস্থাটির প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত জুনে সূচকের অবস্থান ছিলো ২০৮দশমিক ৩ পয়েন্ট, মে মাসে ২১০ দশমিক ৪ পয়েন্ট, এপ্রিলে ২১১ দশমিক ৫ পয়েন্ট।এফএও’র জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ কনসেপসিয়ন কালপের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ও আগামীমৌসুমে সব রকম খাদ্যপণ্য সরবরাহ অতিরিক্ত থাকবে। এ সম্ভাবনায় গত মার্চথেকেই দরপতনের ধারা অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে দানাদার খাদ্যশস্য ও তেলসরবরাহ বাড়ায় এসব পণ্যের বৈশ্বিক মজুদ পুনর্গঠনের সুযোগও বেড়ে যাচ্ছে।শুধু তাই নয়, এফএও’র তথ্যে বলা হয়েছে, ভোজ্যতেলের মূল্যসূচক গত মাসে ৭দশমিক ৭ শতাংশ কমে নেমেছে ১৮১ দশমিক ১ পয়েন্টে। জুনে তেলের সূচক ছিলো ১৮৮দশমিক ৮ পয়েন্ট, মেতে ১৯৫ দশমিক ৩ পয়েন্ট ও এপ্রিলে ১৯৯ পয়েন্ট। তাদের হিসাবে সয়াবিন তেল ও পাম অয়েলের দরপতনও অব্যাহত রয়েছে।

সংস্থাটির হিসাবে, জুলাইয়ে চিনির বাজার ছিলো স্থিতিশীল। এফএওর দানাদারশস্যের মূল্যসূচক জুলাইয়ে ছিলো গড়ে ১৮৫ দশমিক ৪ পয়েন্ট, যা জুনের তুলনায়সাড়ে ৫ পয়েন্ট কম। এছাড়া গত বছরের চেয়ে কম ১৬ দশমিক ৬ শতাংশ।তবে ঠিক বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যানব্যুরোর (বিবিএস) সাম্প্রতিক হিসাবে জুলাইয়ে দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। মাসিকভিত্তিতে জুনের চেয়ে জুলাইয়ে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে ২ দশমিক ২৮ ভাগ। আর গতবছরের জুলাইয়ের চেয়ে এ বছরের জুলাই অর্থাৎ পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে একবছরে খাদ্যের দাম বেড়েছে ৭ দশমিক ০৪ শতাংশ। কারণ হিসাবে বিবিএস বলছে, খাদ্য, ফল, সবজি, বস্ত্র, বাড়ি বাড়া, আসবাব, গৃহস্থালী পণ্য, পরিবহন, শিক্ষা উপকরণসহ বেশ কিছু পণ্যের দাম বাড়ায় মূল্যস্ফীতি বেড়েছে।

এ বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী আহম মুস্তফা কামাল বলেন, রমজানের প্রভাবেমূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখি হয়েছে। এ মাসে মাছ, মাংস, ব্রয়লার মুরগি, শাক-সবজি, ফল, মসলা, মুড়ি, দুধ জাতীয় দ্রব্যাদি ও অন্য খাদ্যসামগ্রীর দাম বাড়ারকারণে জুলাই মাসে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে।মন্ত্রী বলেন, রমজান ও ঈদের মাস হওয়ায় পণ্যের দাম একটু বাড়বেই। এ মাসেমানুষ মনের আনন্দে খরচ করে।যার কারণে নিত্যপণ্যের দামও বেড়ে যায়।মন্ত্রী জানান, গ্রামীণ পর্যায়ে সাধারণ মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। এ পর্যায়েখাদ্য ও খাদ্য বহির্ভূত দু খাতেই মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখি। গ্রামে জুলাইমাসে খাদ্য ও খাদ্য বহির্ভূত উপ-খাতে মূল্যস্ফীতি ছিলো শতকরা ৭ দশমিক ৭৮শতাংশ ও ৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ, যা জুন মাসে ছিলো ৭ দশমিক ৬৪ শতাংশ ও ৫ দশমিক ১২শতাংশ।

এদিকে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন বাজার ঘুরে খাদ্যপণ্যসহ নিত্যপণ্যেরঊর্ধ্বমুখি প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। খোদ সরকারি বাণিজ্যিক সংস্থা ট্রেডিংকরপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত এক মাসেরব্যবধানে বেড়েছে রসুন, পেঁয়াজ, আলু, ডালসহ বেশ কটি নিত্যপণ্যের দাম। আরসংস্থাটির হিসেবে ১ বছরের ব্যবধানে বেড়েছে সব ধরনের চাল, খোলা তেল, ছোলা, মসুর, মুগ ডাল, আলু, রসুন, হলুদ, আদা, মুরগি, গুঁড়োদুধ ইত্যাদি পণ্যের।অর্থাৎ বিশ্ব বাজারে দাম কমার কোনো প্রভাব এদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে পড়েনা। অজুহাত হিসেবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, পণ্য আনতে কয়েক মাস লাগে। তাইআন্তর্জাতিক বাজারের কোনো প্রভাবইসঙ্গে সঙ্গে পড়ে না। এর জন্য মাস দুয়েকঅপেক্ষা করতে হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সম্প্রতি টাকার বিনিময় হারের সুবিধাও পেয়েছেনআমদানিকারকরা। ডলারের বিপরীতে দেড় বছরে টাকার মান বেড়েছে প্রায় ৮ শতাংশ। একসময় প্রতি ডলারের বিপরীতে ৮২ টাকা লাগলেও বর্তমানে পরিশোধ করতে হচ্ছে ৭৭টাকা। কিন্তু এর সুফল খুচরা পণ্যের ক্রেতাদের না দিয়ে মুনাফা তুলে নিচ্ছেনআমদানিকারকরা।
এ বিষয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস)মহাপরিচালক মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, সাধারণত দুটি কারণে বিশ্ববাজারে মূল্য কমার প্রভাব বাংলাদেশে পড়ে না। এর একটি হলো গুটিকয়েকআমদানিকারক পণ্য আমদানি করেন। তারা বাইরের রাষ্ট্রে দাম বাড়লে হুট করেবাড়িয়ে দেন। কিন্তু দাম কমলে তা কার্যকর করেন না। সিন্ডিকেটের কারণেব্যবসায়ীরা নিজেদের পকেট ভারী করতে সহজেই বাজারে নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে।তিনি বলেন, অন্য কারণও হতে পারে, পণ্য আমদানি করতে বেশকিছু দিন সময় লাগে।এক্ষেত্রে আমদানিকারক বেশি দাম দিয়ে পণ্য কিনলে পরে দাম কমলেও তারা কমাতেপারে না। আবার সার্বিকভাবে এতে ভোক্তা অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়। এরজন্য সরকার ওএর অঙ্গ প্রতিষ্ঠানগুলোর নজরদারি বাড়াতে হবে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে আমদানিপণ্য বাজারে পৌঁছাতে হবে। এতে পণ্যের খরচও অনেক কমে যাবে। একই সঙ্গেবাজারের মূল্য নিয়ন্ত্রণের দিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে।

উল্লেখ্য, ২০১৩-১৪ অর্থবছরেও সরকারে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্য অর্জিতহয়নি। এ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ৭ শতাংশ ধরা হলেও বছর শেষে তা৭ দশমিক ৩৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ এ সময়ে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে ৭শতাংশের বেশি।