জাতিসংঘের বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার আরও১৫ ভাগ বেড়ে যেতে পারে

 

স্টাফ রিপোর্টার: জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হারঅনেক বেড়ে যেতে পারে। কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে  দেশ। এর  প্রভাবমোকাবেলা করতে না পারলে ২০৩০ সালের মধ্যে সামগ্রিক দারিদ্র্যের হার আরও ১৫ভাগ বেড়ে যেতে পারে। জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক আন্তঃসরকার সংস্থার (ইন্টারগভর্মেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট  চেঞ্জ-আইপিসিসি) পঞ্চম মূল্যায়নপ্রতিবেদনে এসব উদ্বেগের চিত্র তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, দারিদ্র্যবিমোচনে বাংলাদেশের যে অগ্রগতি হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তা হুমকিরমুখে পড়তে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের পক্ষে তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করা হয়েছে এবংজাতিসংঘ সদর দপ্তরে আগামী ২৩শে সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠেয়  হাইপ্রোফাইল ক্লাইমেটসামিট-এ এসব তুলে ধরা হবে।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভবিষ্যতে  কেবল  যে  প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়বে তা-ই নয়, এর ফলে খাদ্যনিরাপত্তাও সঙ্কটে পড়বে। কমেযাবে কৃষি উৎপাদন। বাড়বে মানুষের রোগ-শোক। এসব সমস্যা  মোকাবেলায় সবাইকেএকসঙ্গে কাজ করে বৈশ্বিক তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে বলে আইপিসিসিরপঞ্চম মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেবাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়া কি কি সঙ্কটে পড়তে পারে, কীভাবে তা মোকাবেলা করতেহবে, সে সব বিষয় তুলে ধরা হয় প্রতিবেদনে। আইপিসিসির প্রতিনিধিরা গত ৭আগস্ট পরিকল্পনামন্ত্রীর কাছে এই প্রতিবেদন ও তাদের সুপারিশ তুলে ধরেন।পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল বলেছেন, জলবায়ু পরির্বতনের কারণেসবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশ। এ জন্য উন্নত বিশ্বই দায়ী। আমরাইনোসেন্ট ভিকটিম। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রতি বছর আমাদের জিডিপির  শতকরা১ ভাগ ক্ষতি হচ্ছে। এ জন্য  আন্তর্জাতিকভাবে সোচ্চার হতে হবে। তিনি আরওবলেন, বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের  প্রভাব  মোকাবেলায়  প্রচুর অর্থ ব্যয়করছে। উন্নত দেশগুলোকে এ খাতে এগিয়ে আসতে হবে। আইপিসিসির ৫ম বার্ষিকীমূল্যায়ন প্রতিবেদন ২০১৪-এ বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশেরসমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা অতি দ্রুত বাড়ছে। এ ছাড়া উন্নত বিশ্বের অতিমাত্রায়কার্বন নিঃসরণের ফলে জলবায়ু পরিবর্তনে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন রোগের সৃষ্টিহচ্ছে। যার ফলভোগ করতে হচ্ছে বাংলাদেশের মতো দেশের সাধারণ মানুষকে। এঅবস্থা চলতে থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ তাপমাত্রা আরও ৫ থেকে ৭ ডিগ্রি বাড়বে।তাপমাত্রা ২ ডিগ্রির  বেশি বাড়লেই পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। এর ফলে ধান ৮ ভাগএবং গমের উৎপাদন ৩২ ভাগ কমবে। উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনেসবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হবে। এর প্রভাব  মোকাবিলা করতে না পারলে ২০৩০সালের মধ্যে সামগ্রিক দারিদ্র্যের হার আরও ১৫ ভাগ বেড়ে যেতে পারে। বেড়েযাবে ম্যালেরিয়া ও ডেঙ্গুর প্রকোপ।  আর এ  থেকে  বেরিয়ে আসতে উন্নত বিশ্বেরদেয়া আশ্বাসের প্রতিফলন ঘটাতে হবে। এ অবস্থায়  উন্নয়নশীল দেশের কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরণের পরিমাণ কমাতে উন্নত বিশ্বের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ নিয়েউন্নয়নশীল রাষ্ট্রের জন্য অবিলম্বে ব্যবস্থা করার আহ্বান জানিয়েছে জলবায়ুপরিবর্তন সম্পর্কিত আন্তঃরাষ্ট্রীয় বৈজ্ঞানিকদের সংগঠন দ্য ইন্টারগভর্মেন্টাল প্যানেল অব ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি)। বিশেষ করে দক্ষিণএশিয়ায় অতি দ্রুত এ সম্পর্কে ব্যবস্থা না নিলে এক সময় তা বড় ধরনের বিপর্যয়সৃষ্টি হবে যা কোন উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের পক্ষে সামলানো কঠিন হয়ে পড়বে।সংগঠনটি ৫ম বারের মতো জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট দুর্ভোগে মানুষ কীভাবেকষ্ট করছে ও ভবিষ্যৎ বিপর্যয় কি আকার ধারণ করবে তা তুলে ধরেছে। জলবায়ুপরিবর্তন নিয়ে ১৯৮৮ সাল থেকে কাজ করছে আইপিসিসি।

সারা বিশ্বের ৮৫০ বিজ্ঞানীএখানে কাজ করছেন। বিশ্বের বিভিন্ন  দেশ থেকে জলবায়ু পরিবর্তনের তথ্য নিয়ে  প্রতিবেদন তৈরি করে আইপিসিসি। ২০১৩ সালের  সেপ্টেম্বর  থেকে আইপিসিসির  পঞ্চম প্রতিবেদন তৈরির কাজ শুরু হয়। এবারের  মূল্যায়ন প্রতিবেদন তৈরিরসঙ্গে যুক্ত ছিলেন সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা পরিবর্তন বিষয়ক গবেষক জন চার্চ এবংবেসরকারি সংগঠন সিডিকেএনের বাংলাদেশ প্রধান মনজুরুল হান্নান খান। দুর্যোগব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মেজবাউল আলম বলেন, এখন আর কোন সন্দেহ নেইজলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে এবং আমাদের উন্নয়ন ও  প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করছে।জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে  বেশি ক্ষতির শিকার বাংলাদেশ।

এ ক্ষেত্রেঅনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, সাইক্লোন, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, সমুদ্রের উচ্চতাবৃদ্ধিসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হচ্ছি আমরা। এ রিপোর্টেবিজ্ঞানসম্মতভাবে তুলে ধরা হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন ও তার  প্রভাব এবং করণীয়সম্পর্কে। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের সচিব শফিকুর রহমান পাটোয়ারী বলেন, এইপ্রতিবেদনে খাদ্য নিরাপত্তা, কৃষি ও ব্যবসা বাণিজ্যসহ অর্থনৈতিক ক্ষতিকরপ্রভাব সম্পর্কে বাস্তব চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। তিনি বলেন, ন্যাশনালক্লাইমেট চেঞ্জ ফান্ড সরকারের অর্থায়নে কাজ  করছে। ক্লাইমেট চেঞ্জরেজিলিয়ান্স ফান্ড কাজ করছে দাতাদের সহায়তায়। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবেজলবায়ু পরিবর্তনের  ক্ষেত্রে  নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি বিশ্বকমিউনিটির উন্নয়নেও  কাজ করছে।

ক্লাইমেট এশিয়া ২০১৩-এর প্রতিবেদন:ক্লাইমেট এশিয়ার জরিপে অংশ  নেয়া  প্রায় ৩৩ হাজার মানুষ ক্রমবর্ধমানতাপমাত্রা এবং চরম আবহাওয়া থেকে শুরু করে খাদ্য ও পানি সঙ্কটের কারণে তাদেরপরিবেশ এবং জীবনযাত্রার মূল উপাদানগুলোতে ব্যাপক পরিবর্তনের পক্ষে মতদিয়েছেন। তিন-চতুর্থাংশ মত প্রদানকারী বলেছেন, গত ১০ বছরে তাপমাত্রা ক্রমশবাড়ছে। এছাড়া, চলতি বছর তাপমাত্রা ৪০ থেকে ৪২ ডিগ্রি পর্যন্ত বাড়ে।বাংলাদেশের শতকরা ৮৪ ভাগ মানুষ জানিয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তন তাদের উপার্জনক্ষমতার ওপর প্রভাব ফেলেছে। পেশা পরিবর্তনসহ জীবনযাত্রা এবং কৃষিকাজেওপরিবর্তন এনেছে তারা। গবেষণায় বলা হয়, ঢাকার মতো বড় শহরগুলোতে পরিবেশবিপর্যয়ের কারণে শরণার্থী হয়ে আসা জনগোষ্ঠীকে সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।বস্তিতে বসবাসকারীরা অবকাঠামোর অভাব, ঘনবসতি, দূষণ এবং পর্যাপ্ত অর্থউপার্জন করতে না পারার কারণে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

দেশের বিভিন্নপ্রান্তের জেলে এবং কৃষকরা জানিয়েছেন, উন্নয়নের কিছু উপকারিতা তারা ভোগকরছেন। তবে দ্রব্যমূল্যের  বৃদ্ধি এবং স্বল্পতা তাদের জন্য বড় সমস্যা।এদিকে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গত কয়েক বছর ধরে স্বাভাবিকের চেয়ে জোয়ারেরপানি বেড়ে যাওয়ায় খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলা, পিরোজপুর ওবাগেরহাট  জেলার আমন চাষ ব্যাহত হচ্ছে। প্রতি বছর নষ্ট হচ্ছে আমন বীজ। এরফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কৃষকরা। চালের দাম বেড়ে গেছে  কেজি  প্রতি ৫ টাকাথেকে ১০ টাকা পর্যন্ত। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনের পূর্বাভাসে বলা হয়,  প্রতি তিন থেকে পাঁচ বছর পর পর বাংলাদেশের দু-তৃতীয়াংশ এলাকা বন্যায় ডুবেযাবে। এতে ফসলের ক্ষতি হওয়ার পাশাপাশি গরিব মানুষের ঘরবাড়ি বিনষ্ট হবে।তাপমাত্রা আড়াই ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে বন্যায় প্লাবিত এলাকার পরিমাণ শতকরা২৯ ভাগ বাড়বে। বন্যার সময় আগের  চেয়ে বেশি উচ্চতা নিয়ে পানি প্রবাহিত হবে।এতে প্রধান ফসল  বোরো ও আমনের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। প্রতিবেদনে আরও বলাহয়, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৬৫ সেন্টিমিটার বাড়লে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের শতকরা৪০ ভাগ ফসলি জমি হারিয়ে যাবে।