ডায়রিয়ার ভয়াবহ প্রকোপে বেসামাল চুয়াডাঙ্গা : পৌর সরবরাহকৃত পানি পান না করার আহ্বান

 

ঝিনাইদহ থেকে নেয়া হয়েছে চিকিৎসক : মেহেরপুর থেকে ধার নেয়া হয়েছে কলেরা স্যালাইনসহ ওষুধ : তদারকিতে ঢাকার মেডিকেল টিম

স্টাফ রিপোর্টার: ডায়রিয়ার ভয়াবহ প্রকোপে চুয়াডাঙ্গা বেহাল হয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যেই চুয়াডাঙ্গা পৌর কর্তৃপক্ষ পৌর সরবরাহকৃত পানি পান না করার জন্য অনুরোধ জানিয়েছে। গতকাল ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা পূর্বের তিন দিনের রেকর্ড ভেঙে ২শ ৭৪ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ দিয়ে গত ৪ দিনে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৬শ ৪ জন। এর মধ্যে নারীর সংখ্যাই বেশি।

একের পর এক ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী নিয়ে হাসপাতালের দিকে ছুটছেন তাদের নিকটজনেরা। দৃশ্য দেখে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে খোদ স্বাস্থ্য বিভাগ। এতো রোগী রাখা হবে কোথায়, চিকিৎসাই বা দেয়া হবে কীভাবে? এসব প্রশ্ন তুললেও চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের চিকিৎসক ও সেবিকারা নিরলসভাবে দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সংক্রমণ রোগ প্রতিরোধ কেন্দ্র থেকে তিন সদস্যের একটি টিম চুয়াডাঙ্গায় পৌঁছে গত মধ্যরাত পর্যন্ত বৈঠক করেছে। মেহেরপুর থেকে গতকাল ১ হাজার কলেরা স্যালাইন চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। ৮ হাজার স্যালাইন নিয়ে খুলনা থেকে ট্রাক চুয়াডাঙ্গার উদ্দেশে রওনা হয়েছে। ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব এলাকায় বিজিবি বিশুদ্ধ পানিসহ খাবার স্যালাইন সরবরাহের পাশাপাশি হাসপাতাল আঙিনায় তাবু গেড়ে রোগী রাখার ব্যবস্থা করেছে। ঝিনাইদহের দুটি ও চুয়াডাঙ্গা স্বাস্থ্য বিভাগের ৪টি মোট ৬টি মেডিকেল টিম গঠন করে ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা প্রদান করা হচ্ছে। চুয়াডাঙ্গার সকল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দুজন করে নার্স রেখে বাকিদের চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে দায়িত্ব পালনের নিদের্শনা দেয়া হয়েছে।

গত ১ আগস্ট শেষ রাত থেকে চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার বাগানপাড়া ও মসজিদপাড়ায় ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। পরদিন থেকে শুরু হয় গণহারে ডায়রিয়া আক্রান্ত। চুয়াডাঙ্গা মসজিদপাড়া, মাঝেরপাড়া, শেখপাড়া, জিনতলাপাড়া, বাগানপাড়াসহ পার্শ্ববর্তী এলাকার নারী-পুরুষ, শিশু কিশোর-কিশোরীর মধ্যে ডায়রিয়া ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়লে স্বাস্থ্য বিভাগ নড়ে চড়ে বসে। পৌর সরবরাহকৃত পানির বিশুদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। অনেকেই অভিযোগ তুলে বলেন, পৌর সবরবরাহকৃত পানি পানেই এমনটি হচ্ছে। অবশ্য পৌর কর্তৃপক্ষ অভিযোগ সঠিক নয় মর্মে বিবৃতি দিলেও গতকাল থেকে চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকায় মাইকিং করে সকলকে পৌর সরবরাহকৃত পানি পান না করার জন্য অনুরোধ জানিয়েছে। গতকাল সকাল ১১টার দিকে চুয়াডাঙ্গা পৌর মেয়র রিয়াজুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার টোটন চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল পরিদর্শনে যান। রোগীদের সাথে কথা বলেন। উপস্থিত সাংবাদিকদের তিনি বলেন, পৌর সবরাহকৃত পানি পরীক্ষার জন্য প্রেরণ করা হয়েছে। ব্যাপকভাবে ডায়রিয়া ছড়িয়ে পড়ার কারণে পৌর সরবরাহকৃত পানি আপাতত পান না করার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে। তবে গোসলসহ পরিবারের অন্যান্য কাজে এ পানি ব্যবহার করা যাবে। পানি পরীক্ষার রিপোর্ট পাওয়ার পর পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে।

গতকাল চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ডায়রিয়া আক্রান্ত ২৭৪ জন রোগী ভর্তি হন। এর মধ্যে ২৮ জন শিশু। বাকিদের অধিকাংশই নারী। গতকালের ভর্তি হওয়া রোগীর মধ্যে চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকা বাগানপাড়ার ৪৪, মসজিদপাড়ার ৩৩, মাঝেরপাড়ার ৩৬, জিনতলাপাড়ার ৩৩, আরামপাড়ার ১১ ও পৌর এলাকার মুক্তিপাড়াসহ অন্যান্য পাড়ার ৬৮ জন। বাকি ৪৭ জন বিভিন্ন গ্রামের। চুয়াডাঙ্গায় ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব ভয়াবহ রূপ নেয়ার খবর পেয়ে সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের তিন সদস্যের একটি টিম গতরাত ১০টার দিকে চুয়াডাঙ্গায় পৌঁছায়। টিমের নেতৃত্বে রয়েছেন সিডিসির উপপরিচালক ডা. শুকুমার সরকার। চুয়াডাঙ্গায় পৌছেই হাসপাতাল পরিদর্শন করেন। অল্প জায়গায় অতো রোগীর ভিড় দেখে প্রথমে এ টিম চমকে উঠলেও পরে অবশ্য সন্তোষ প্রকাশ করে বলেছেন, ছোট্ট একটি হাসপাতালে এতো রোগীর চাপ সামলেও যথাযথভাবে চিকিৎসা প্রদান করে চুয়াডাঙ্গার চিকিৎসক ও সেবিকারা উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। এ জন্য অবশ্যই চুয়াডাঙ্গা স্বাস্থ্য বিভাগ ধন্যবাদ পাওয়ার দাবি রাখে। যেহেতু অনেক রোগী, সেহেতু কিছু ত্রু টি হয়েছে। আর ত্রু টি রাখা চলবে না। আজ মঙ্গলবার রোগীর পায়খানার নমুনা সংগ্রহ করে দ্রুত পরীক্ষার জন্য প্রেরণ করা হবে। একই সাথে চুয়াডাঙ্গার সকল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দুজন করে সেবিকা রেখে বাকিদের চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ডায়রিয়া রোগীদের চিকিৎসা প্রদানের কাজে নিযুক্ত করতে হবে। ইতোমধ্যেই সেবিকাদের ডিউটি তিন শিফটে ৮ ঘণ্টার স্থলে দু শিফটে ১২ ঘণ্টা করে দায়িত্ব পালন করানো হচ্ছে। অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সেবিকাদের কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়ছে। হাসপাতালে অস্বাভাবিক রোগীর চাপের কারণে ল্যাটট্রিনগুলো ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। দৃশ্য দেখে ঢাকার টিম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কর্মীদের বাড়তি দায়িত্বের নির্দেশ দিয়ে বলেছে, পর্যাপ্ত ব্লিসিং পাউডার ব্যবহার করতে হবে। অপচয় রুখতে হবে। হাসপাতালের সকল কনসালটেন্ট চিকিৎসকদের বলা হয়েছে, অন্যান্য ওয়ার্ডের যে সকল রোগী বাড়িতেও চিকিৎসা নিতে পারবে তাদেরকে ছাড়পত্র দিয়ে বাড়ি পাঠাতে হবে। সকল চিকিৎসককে ডায়রিয়া রোগীদের চিকিসা প্রদানে আন্তরিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে।

চুয়াডাঙ্গা সিভিল সার্জন ডা. আজিজুল ইসলাম বলেছেন, ঝিনাইদহের দুটি ও চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের ৪টি মোট ৬টি মেডিকেল টিম ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা প্রদান করছে। প্রয়োজনে মেডিকেল টিমের সংখ্যা আরো বাড়ানো হবে। তা ছাড়া বহির্বিভাগও ২৪ ঘণ্টার জন্য খুলে রাখা হয়েছে। মহিলাদের জন্য ২০৯ ও ১০৮ পুরুষদের জন্য ২৪ ঘণ্টা চিকিৎসক রাখা হয়েছে। চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে কলেরা স্যালাইন ফুরিয়ে আসার কারণে খুলনায় ১০ হাজার স্যালাইনের চাহিদা দেয়া হয়। ৮ হাজার পাওয়া গেছে। যা গতকালই খুলনা থেকে ট্রাকযোগে চুয়াডাঙ্গার উদ্দেশে নেয়া হচ্ছে। মেহেরপুর থেকে ১ হাজার স্যালাইন ও এজিথ্রমাইসিন ইনজেকশন ২ হাজার নেয়া হয়েছে। খাবার স্যালাইন নেয়া হয়েছে ৩ হাজার ২শ। চুয়াডাঙ্গায় ডায়রিয়া পরিস্থিতি পরিদর্শনে আসেন যশোর সিভিল সার্জন ডা. আতিকুর রহমান খান ও মেহেরপুর সিভিল সার্জন ডা. ইসমাইল ফারুক।

রোগীর সংখ্যা যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে তা অব্যাহত থাকলে সামাল দেয়া অসম্ভব হয়ে পড়তে পারে আশঙ্কায় বিজিবিও সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে। চুয়াডাঙ্গাস্থ ৬ বিজিবির চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ৪টি তাঁবু গেড়েছে। অতিরিক্ত রোগী সেখানে রাখা যাবে। এছাড়া চুয়াডাঙ্গা বাগানপাড়া, মসজিদপাড়াসহ সংশ্লিষ্ট এলাকায় বিশুদ্ধ পানি ও খাবার স্যালাইনসহ পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট সরবরাহের কাজ শুরু করেছে। গতকাল ৬ হাজার লিটার পানি সরবরাহ করা হয়। এলাকার সাধারণ নারী-পুরুষ লাইন দিয়ে বিজিবির বিশুদ্ধ পানি সংগ্রহ করে। হাসপাতালেও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করছে বিজিবি। পাশাপাশি অমিয়’র তরফেও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহও অব্যাহত রয়েছে। পৌরসভাও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করছে। হাসপাতালে রোগী ও রোগীর লোকজনের হুড়োহুড়ি বন্ধ হয়নি। অনেকেই প্রভাব খাটিয়ে কলেরা স্যালাইন নিয়ে নিজের রোগীকে একের পর এক পুশ করছেন। অনেকেই তা না পেয়ে বাইরে থেকে চড়া দামে কিনে আনছেন। অনেক রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে কলেরা স্যালাইন জোর করে বেশি নিয়ে বাড়ি ফিরেও তা গ্রহণ করছে। কেউ কেউ টিকিটসহই হাসপাতাল ছেড়েছে। গতকাল সংক্রমিত এলাকায় সিভিল সার্জনসহ একটি মেডিকেল টিম পরিদর্শনে গেলে হাসপাতালের স্যালাইন দেয়া অবস্থায় এক রোগীকে রাস্তায় হাঁটতে দেখতে পান।

চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ডায়রিয়া রোগীর উপচেপড়া চাপে ভয়াবহ অবস্থা ফুটে উঠেছে। রোগীদের বেহালদশার বর্ণনা লিখে বোঝানো কঠিন। যেখানে সেখানে মল ত্যাগের দৃশ্যও ঘুরে ফিরে দেখতে হচ্ছে রোগীর লোকজনকে। দফায় দফায় সিভিল সার্জন হাসপাতাল পরিদর্শন করে চিকিৎসার সার্বিক দিক খোঁজখবর নিচ্ছেন। ডায়রিয়া রোগীদের চিকিৎসার্থে হাসপাতালে আপতত অপারেশন বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে প্রসূতির জরুরি অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক মো. দেলোয়ার হোসাইন বলেছেন, চিকিৎসা সেবাদানে যাবতীয় সহযোগিতা প্রদানের জন্য জেলা প্রশাসন সর্বদা প্রস্তুত। স্বাস্থ্য বিভাগ যখন যে বিষয়ে সহযোগিতা চাইবে তখন তাই দেয়ার চেষ্টা করা হবে। পুলিশ সুপারও সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন। তিনি স্বাভাবিক রাখতে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। গতকাল দু প্লাটুন পুলিশ হাসপাতালে মোতায়েন রাখা হয়।