মায়ের কোলে ঘুমন্ত শিশুরও রেহাই নেই

 

মাথাভাঙ্গা মনিটর: ‘শিশুদেরকাছে মায়ের কোলই সবচে’নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু ফিলিস্তিনেরগাজা নগরীর শিশুদের কাছে মায়ের কোলে ঘুমন্ত শিশুও আর নিরাপদ নয়। ইসরাইলেরওপর ফিলিস্তিনি হামাস যোদ্ধাদের রকেট হামলার প্রতিশোধের নামে গাজায় চলছেসামরিকভাবে শক্তিশালী ইসরাইলের উন্মত্ত বর্বরতা। ইসরাইল-হামাসের অসম লড়াইয়েমার খাচ্ছে গাজার বেসামরিক মানুষ। বিশেষ করে নারী ও শিশুরা; যাদের সাথেএই বিরোধের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই। নিজ বাড়ির শোবার ঘর, খেলার মাঠকিংবা আশ্রয় শিবির -কোনো জায়গাতেই নিস্তার নেই। বিমান হামলা হচ্ছেসবখানেই। মুহুর্তে ধ্বংসস্তুপে চাপা পড়ছে অগণিত অসহায় শিশু। ফিলিস্তিনিকর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ইসরাইলি সর্বশেষ অভিযানে এ পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা সাড়ে১৬শ’ছাপিয়ে গেছে। এদের মধ্যে পাঁচ শতাধিক শিশু-কিশোর। হাসপাতালে আরো শতশত শিশু আহত হয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। ইসরাইল জানিয়েছে, গাজায় অভিযানচালাতে গিয়ে তাদের ৬৩ জন সেনা এবং হামাসের রকেট হামলায় একজন বেসামরিক লোকনিহত হয়েছে।

এদিকে বিবিসি জানায়, গাজায় শুক্রবারের সাময়িকযুদ্ধবিরতি ভেঙে পড়ার পর ইসরাইলি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় কমপক্ষে ২০০ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। এসব মৃত্যুর বেশির ভাগইঘটেছে দক্ষিণ গাজার রাফাহ এলাকায়। ইসরাইলি হামলার অন্যতম লক্ষ্যস্থল ছিলোরাফাহ, যেখানে ফিলিস্তিনিদের হাতে একজন ইসরাইলি সৈন্য ধরা পড়েছে বলে মনেকরা হয়। গত দু দিনেও নিহতদের প্রায় সবাই বেসামরিক লোক। আহতরা হাসপাতালেওথাকতেও ভরসা পাচ্ছেন না। প্রচণ্ড গোলাবর্ষণের কারণে রাফাহ’র প্রধানহাসপাতালটি থেকে লোকজনকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, হাসপাতালেওক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাতে দ্বিধাবোধ করবে না ইসরাইল। কারণ গতকাল ইসরাইলেরএক মন্ত্রী সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, আন্তর্জাতিক মহল থেকে যতই সমালোচনা হোকনা কেন, তাতে গুরুত্ব দেবেন না তারা। হামাসের শক্তি ধ্বংস না হওয়া পর্যন্তগাজায় বিমান ও স্থল হামলা চলবেই।

শুক্রবার ৭২ ঘন্টার যে সাময়িকযুদ্ধবিরতি বলবত্ করা হয়েছিলো তা কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ভেঙে ফেলে ইসরাইল।এরপরেই পূর্ণ শক্তি নিয়ে গাজার উপর নৃসংশ তাণ্ডব শুরু করে দেশটির সেনারা।এই হামলার মধ্যে মিসরের উদ্যোগে শুরু হয়েছে নতুন একটি যুদ্ধবিরতির চেষ্টা।মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাতাহ আল-সিসি বলছেন, সবশেষ এই উদ্যোগের মধ্যেদিয়ে গাজায় রক্তপাত বন্ধ হবার সম্ভাবনা আছে। হামাসের একজন মুখপাত্র বলেছেন, এ পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করতে একটি ফিলিস্তিনি প্রতিনিধিদল কায়রোযাচ্ছে। তবে ইসরায়েল কোন প্রতিনিধি দল পাঠাচ্ছে কিনা তা স্পষ্ট নয়।

এ যেন শিশু নিধন যজ্ঞ! ইসরাইলগাজায় হামলা শুরু করার পর জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ইসরাইলকেআহ্বান জানানো হয় বেসামরিক লোকজনের যেন প্রাণহানি না হয়। কিন্তু সেইআহ্বানকে বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে বেসামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে হামলাচালিয়ে যেতে থাকে ইসরাইলি বাহিনী। এসব হামলার পর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোসবচেগুরুত্ব দিয়ে যেটা প্রচার করছে তা হলো ব্যাপক সংখ্যায়শিশু-কিশোরদের হতাহতের ঘটনা।গত বুধবার জাবালিয়ার একটি আশ্রয়শিবিরে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে ইসরাইল। এতে ১৬ জন নিহত হয়। টিভিতে দেখাযায়, এদের প্রায় সবাই নারী ও শিশু! এই ঘটনা দেখে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কিমুন একটি বিবৃতি দিয়ে একে জঘন্য মাত্রার বিভীষিকাহিসেবে উল্লেখ করেন। এরদু দিন আগে সোমবার গাজার একটি পার্কে খেলা করছিলো একদল শিশু। ইসরাইল হয়তোএদের মধ্যে হামাস জঙ্গিদের ভুত দেখেছিলো। মুহূর্তের মধ্যে মৃত্যুদূত হয়েউড়ে এলো একটি ক্ষেপণাস্ত্র। মাঠের মধ্যে খেলায় ব্যস্ত ৯ শিশুর সবাই নিহতহলো। এর বাইরে এক শিশুর মাও মারা গেলেন। মাঠের বাইরে থাকা আরো ৪৬ জন আহতহলেন।

এর আগে ১৬ জুলাই গাজা সিটির পশ্চিম অঞ্চলে আরেকটি মাঠের মধ্যেখেলা করছিলো একদল শিশু। সেখানেও ছোড়া হলো ক্ষেপণাস্ত্র। মারা গেলো ৮ শিশু।এসব শিশুদের বয়স ৯ থেকে ১১ বছরের মধ্যে ছিলো। সেখানে কয়েকজন বিদেশী নাগরিকএই হত্যাকাণ্ডের দৃশ্য দেখে দুটি শব্দে ঘৃণা প্রকাশ করেছিল- বর্বর, অসভ্য!

২০ জুলাই সবচে বড় আকারের নৃসংশতা চলে শিশুদের ওপর এদিনকয়েকটি ভবনে ইসরাইলি বিমান হামলায় শতাধিক লোক নিহত হয়। এদের মধ্যে ২৩ জনইছিলো শিশু! ১০ বছরের বালিকা আফনান ছাদের ওপর তার কাজিনদের নিয়ে খেলা করছিলো।তারা হঠাত তাকিয়ে দেখে পাখির মতো কি যেন একটা তাদের ভবন লক্ষ্য করে উড়েআসছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সব শেষ। দু দিন পর ভবনের ধ্বংসস্তুপ থেকে তাদেরলাশ বের করা হয়। গত ৮ জুলাই থেকে শুরু হওয়া হামলার প্রথম দশ দিনে ৭৩ জনশিশু নিহত হয়। এদের মধ্যে ৫০ জন ছেলে এবং ২৩ জন মেয়ে। সর্বশেষ গত সপ্তাহেজাতিসংঘের একটি স্কুলে স্থাপিত আশ্রয়শিবিরে ইসরাইলি হামলায় ১৬ জন শিশু নিহতহয়।

সারা বিশ্বের মানবাধিকার গ্রুপগুলো এভাবে গণহারে শিশুনিধনেরনিন্দা জানাচ্ছে। গতকালও ব্রিটেন, ফ্রান্সসহ অনেক দেশে প্রতিবাদ কর্মসূচিপালন করা হয়। কিন্তু শিশুনিধন বন্ধ হবে কিনা তার নিশ্চয়তা কারো কাছে নেই।

ইসরাইলি সেনাদের চোখে কুমিরের অশ্রু: এইগণহারে শিশু-কিশোর নিহত হবার ঘটনায় দুঃখিতবলে দ্য গার্ডিয়ানকেজানিয়েছেন একজন সিনিয়র ইসরাইলি সেনা। তিনি বলেছেন, হামাসের বিরুদ্ধে তারাঅভিযান চালাচ্ছেন। কিন্তু কয়েকজন নারী ও শিশু নিহত হয়েছে। তাদের প্রতিআমাদের সমবেদনা রইলো! তিনি পাল্টা অভিযোগ করে বলেন, এসব শিশুদের নিহত হবারঘটনায় গাজার হামাসই দায়ি। কারণ তারা শিশুদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে।শিশুদের আড়ালে বসে তারা ইসরাইলে রকেট হামলা করে।

বেঁচে থাকা শিশুদের কি হবে: ইউনিসেফেরএকজন শিশু বিশেষজ্ঞ বলেন, গাজার অন্তত ৬০ হাজার শিশুরমানসিক কাউন্সেলিঙের প্রয়োজন ছিলো। কিন্তু এর মধ্যে নতুন করে ইসরাইলিহামলায় তারা চোখের সামনে শত শত শিশুর মৃত্যু দেখছে। এতে তাদের মানসিকঅবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। হামলা থেমে যাওয়ারপরেও এদের স্বাভাবিক হতে অনেকটা সময় লেগে যাবে। কোমল মনের এসব শিশুদেরসবাই স্বাভাবিক জীবন লাভ করতে পারবে কি না তা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়।