কালীগঞ্জে ট্রেনের সাথে সংঘর্ষে বরযাত্রীবাহী বাসের ১১ জন নিহত :আহত ৫৬

 

 

ঝিনাইদহ অফিস/কালীগঞ্জ প্রতিনিধি: ঝিনাইদহ কালীগঞ্জের বারোবাজারে বরযাত্রীবাহী বাসের সাথে ট্রেনের সংঘর্ষে ১১ জন নিহত হয়েছেন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে একই পরিবারের তিন সদস্য রয়েছেন। গতকালশুক্রবার ভোরে বারোবাজার রেলক্রসিঙে এ দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন ওই বাসের অন্তত ৫৬ যাত্রী। সংঘর্ষের পর সৈয়দপুর থেকে খুলনাগামী সীমান্ত এক্সপ্রেস ট্রেনটি বাসটিকে ঠেলে প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে নিয়ে যায়। দুর্ঘটনার কারণে খুলনার সাথে সারাদেশের ট্রেন চলাচল প্রায় সাত ঘণ্টা বন্ধ থাকে। তবে বর-কনে আলাদা একটি মাইক্রোবাসে থাকায় তারা রক্ষা পান।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিয়ের অনুষ্ঠান শেষে ৭০ জন নিয়ে বরযাত্রীর ওই বাসটি কালীগঞ্জের সাকো মথুনপুর থেকে শৈলকুপার ফুলহরি গ্রামে ফিরছিলো। ভোর সাড়ে ৩টার দিকে বারোবাজার রেলক্রসিং পার হওয়ার সময় সৈয়দপুর থেকে খুলনাগামী সীমান্ত এক্সপ্রেস ট্রেন বাসটিকে ধাক্কা দেয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিযোগ, ওই রেলক্রসিঙে মোমিনুর রহমান ও হুমায়ুন কবির নামের দুজন গেটম্যান দায়িত্ব পালন করেন। ঘটনার সময় তারা সেখানে ছিলেন না। গেট বন্ধ না করায় বাসটি রেললাইনের ওপর ওঠে। এতে এ দুর্ঘটনা ঘটে।

নিহতরা হলেন-শৈলকুপা উপজেলার ফুলহরি কাজীপাড়া গ্রামের রঞ্জন কুমারের স্ত্রী বন্যা বিশ্বাস (৩৫), ছেলে কৌশিক কুমার (৮), ভাগ্নি ভবেশ কুমারের মেয়ে কৃষ্ণা রানী (২০), একই গ্রামের জগবন্ধু বিশ্বাসের ছেলে বিপ্লব বিশ্বাস (২৫), মহা প্রসাদের ছেলে শোভন কুমার (২১), অনিল বিশ্বাসের ছেলে সুধির কুমার (৪৫), সুধির কুমারের ছেলে অলোক কুমার (২০), আবাস সাহার ছেলে সুজয় বিশ্বাস (৩০), সঞ্জয় কুমার, (৩৪), একই এলাকার সঞ্জিত কুমার (৩২) ও ফরিদপুরের কানাইপুর এলাকার শ্যামল দাসের ছেলে উজ্জ্বল দাস (৩০)।

কালীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনোয়ার হোসেন বলেন, বারোবাজার রেলক্রসিং পার হওয়ার সময় সৈয়দপুর থেকে খুলনাগামী ওই ট্রেন বাসটিকে ধাক্কা দেয়। এ সময় বাসটি ট্রেন লাইনের ওপর আড়াআড়িভাবে পড়ে যায়। এ অবস্থাতেই বাসটিকে ঠেলে নিয়ে ট্রেনটি চলতে থাকে। প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে গিয়ে ট্রেনটি থামে। ট্রেন এলে রেলক্রসিঙে যান চলাচল বন্ধের জন্য ‘ব্যারিয়ার’থাকলেও ঘটনার সময় সেটি নামানো হয়নি। ওই সময় যে গেটম্যান দায়িত্বে ছিলেনতাকেও পাওয়া যাচ্ছে না। খবর পেয়ে ঝিনাইদহ, যশোর, কোটচাঁদপুর ও কালীগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে গিয়ে নিহত ও আহত ব্যক্তিদের উদ্ধার করেন। তবে বাসের চালকের বিষয়ে পুলিশ কোনো তথ্য দিতে পারেনি।

কোটচাঁদপুর ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন অফিসার নজরুল ইসলাম বলেন, ঘটনাস্থল থেকে তারা নয়জনের লাশ উদ্ধার করেছেন। আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে ৫৮ জনকে। তাদের যশোর, কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ ও ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। ফরিদপুর যাওয়ার পথে আহত ব্যক্তিদের মধ্যে একজন মারা গেছেন। কালীগঞ্জ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় একজন মারা গেছেন। নিহত ব্যক্তির সংখ্যা বাড়তে পারে বলে তিনি জানান। আহতদের মধ্যে ৩৯ জনকে যশোর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং ১৬ জনকে ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আহত বাসযাত্রীদের মধ্যে ১০ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। অপরদিকে ঝিনাইদহের সদর হাসপাতালমর্গে নিহতদের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন শেষে বিকেলে পরিবারের সদস্যদের নিকট লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে।

ট্রেনের যাত্রী সাংবাদিক অরিত্র কুণ্ডু বলেন, তিনি হঠাত জোরে একটা শব্দ শুনতে পান। এরপর মানুষের চিৎকার শুনেছেন। ট্রেনটি থামার পর নিচে নেমে দেখতে পান ট্রেনের মুখে বাস আর নিচে মানুষের লাশ। এদিকে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার, জেলা প্রশাসক শফিকুল ইসলাম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হাসানুজ্জামান ও রেলের কর্মকর্তাসহ স্থানীয় প্রশাসনের লোকজন।

ঝিনাইদহের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হাসানুজ্জামান বলেন, গেটম্যানের দায়িত্বে অবহলোর কারণে এ ঘটনা ঘটেছে কি না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এদিকে দুর্ঘটনার পর সীমান্ত এক্সপ্রেসের সাথে আটকে বাসটি লাইনের ওপর পড়ে থাকায় খুলনার সাথে সারাদেশের ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। খবর পেয়ে পাকশী থেকে রেলের বিভাগীয় ম্যানেজার মোশাররফ হোসেনের নেতৃত্বে ৫ সদস্যের একটি দল ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। খুলনা থেকে রিলিফ ট্রেন ঝিনাইদহে পৌঁছুলে শুরু হয় উদ্ধার কাজ। বাসটি সরিয়ে নেয়ার পর বেলা ১১টার দিকে আবার ট্রেন চলাচল শুরু হয় বলে রেলওয়ে পশ্চিম জোনের জিএম আবদুল আওয়াল মিয়া জানান।

ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসক শফিকুল ইসলাম জানান, দায়িত্বে অবহেলার কারণে বারোবাজার রেলস্টেশনের মাস্টার তুর্কি আহম্মেদ, দু লাইনম্যান মোমিনুর রহমান ও হুমায়ূন কবিরকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। দুর্ঘটনা তদন্তে অতিরিক্তি জেলা প্রশাসক নাসরিন জাহানকে প্রধান করে ৩ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী ৩ দিনের মধ্যে তাদেরকে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। এরই ভিত্তিতে পরবর্তীতে চূড়ান্ত ব্যবস্থা নেয়া হবে। এছাড়া রেলের পক্ষ থেকে তিন সদস্যের আরেকটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। এ কমিটিকেও এক সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে বলে জানান জিএম আবদুল আওয়াল মিয়া।

এদিকে ঝিনাইদহ-১ আসনের সংসদ সদস্য জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল হাই ফুলহরি গ্রামের নিহতদের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তিনি শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন। নিহতদের আর্থিক সাহায্য ও আহতদের চিকিৎসার ব্যয়ভারের প্রতিশ্র“তি দিয়েছেন তিনি।