আর্জেন্টিনা-জার্মানি :কে সেরা
স্টাফ রিপোর্টার: তিনদিন বৃষ্টি হওয়ার পর কাল রাত থেকে ব্রাজিলের পাহাড়ে ভেসে বেড়ানো শাদামেঘের ভেলা সরে গেছে। আকাশে মেঘের আনাগোনা কমেছে। দিনে সূর্যের পরিষ্কারআলো। রাতে ঝকঝকে মায়াবী চাঁদের আলোয় মারাকানার স্টেডিয়াম যেন হাতছানিদেয়। ফুটবলের মোহনীয় টানে ইউরোপ-আমেরিকার ফুটবল যুদ্ধ দেখতে ফ্লোরিডাথেকে আসা পিতা-পুত্র স্টেডিয়ামের গেটে টিকিট না পেয়ে বিষন্ন মনে ফিরেগেছেন। স্বাগতিক ব্রাজিল নেই, তারপরও আজ আর্জেন্টিনা-জার্মানি ফাইনালেরটিকিট পাওয়া যাচ্ছে না। বিকেলে ফিফা সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছে, দু দলকে১৩ হাজার করে টিকিট দেয়া হয়েছে। তারপরও চাহিদা শেষ হচ্ছে না। কারণ একটাই।দীর্ঘদিন পর ইউরোপ-আমেরিকার ফুটবল লড়াই। আগ্রহের কমতি নেই কোথাও।
মারাকানায়গতকাল থেকে ফাইনালের দর্শকদের আনাগোনা বাড়ছে। আর্জেন্টাইনরা পতাকা হাতেবাঁশি, মেসি, ম্যারাডোনার ছবি নিয়ে হই চই শুরু করেছেন। পাশেই জার্মানিরাউল্লাস করছেন আত্মবিশ্বাস নিয়ে। ডয়েচল্যান্ডের দর্শকরা মনে করেন ব্রাজিলকে৭-১ গোলের স্কোর লাইনটাই বলে দেয়, জার্মানিকে ঠেকানোর কেউ নেই। আরআর্জেন্টাইন দর্শকরা জার্মানদের বলছেন, এতোদিন যেটা লুকিয়ে রাখা হয়েছে, সেই আসল খেলাটা আজ দেখাবে আর্জেন্টিনা। মেসি জাদুরকাঠি বের করবেন আজ। আরজার্মানরা বলছেন, ইতালীতে ম্যারাডোনা কীভাবে কেঁদেছিলো মনে আছে?ফাইনালেরআগে এমন তর্কযুদ্ধ মারাকানার আঙিনায়। আর কিছু সময় পরই বিশ্বকাপ ফুটবলেরময়দানী লড়াইয়ে নামবে আর্জেন্টিনা-জার্মানি। নেইমারদের ঘরের উঠানে রোমেরিওমেসি, ফিলিম লামদের লড়াই।
রি ও ডি জেনেরিওর মারাকানা স্টেডিয়াম।২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপের ফাইনালের মঞ্চ প্রস্তুত এখানে। যেখানে উরুগুয়েহেসেছিলো ১৯৫০ সালে। স্বাগতিকদের শোক আর কান্নার সাগরে ভাসিয়েছিলো লাসেলেস্তেরা। আবারো সেই মারাকানা স্টেডিয়াম। নেই এ দুই দলের কেউ।শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে মুখোমুখি এবার দুই সেরা, জার্মানি ও আর্জেন্টিনা।ইউরোপ ও আমেরিকার অঘোষিত এক ফুটবল যুদ্ধ দেখবে বিশ্ব। কে হাসবে ঐতিহাসিকমারাকানায়?বিশ্বকাপ ফুটবলের ইতিহাসে কোনো ইউরোপীয়ান দল লাতিন আমেরিকায়এসে চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি। এবার সেই সুযোগ এসেছে। নেদারল্যান্ডস, ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, পর্তুগাল নিজেদের হারিয়ে এখন জার্মানির দিকেতাকিয়ে আছে। লাতিন আমেরিকান দেশগুলো তাকিয়ে আছে আর্জেন্টিনার দিকে।
সেমিফাইনালেজার্মানির কাছে ৭-১ গোলে লজ্জার হারের পর বিশ্বকাপ নিয়ে ঘরের দর্শকদেরআমেজ আগের মতো নেই। শহর বা রাস্তায় ব্রাজিলীয়দের নেই তেমন উন্মাদনা। আছেশুধু রাস্তায় মেট্রো সাবওয়ে, বাসে আর্জেন্টিনা আর জার্মানিদের উত্সব।ব্রাজিলের বিদায়ে সরকার বিরোধীরা সুযোগ খুঁজছে, এটাকে আন্দোলনের ইস্যুহিসেবে নেয়ার। ১২ জুন শুরু হওয়া বিশ্বকাপ ফুটবলের ২০তম আসরটি আজ কোনোভাবেশেষ করাটাই যেন এখন মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্রাজিল প্রেসিডেন্ট দিলমারৌসেফের কাছে।আর্জেন্টিনা একই মহাদেশের হওয়ায় অনেক ব্রাজিলীয়ানএখন সমর্থন দিতে শুরু করেছেন মেসিদের। যেমন দিয়েছেন বার্সার বন্ধু নেইমারও।আর্জেন্টাইনদের জন্য এটা বাড়তি পাওয়াই। মেসি, হিগুয়েন, আগুয়েরোরা এটাকেকি শক্তি হিসেবে কাজে লাগাতে পারবেন।
১৯৮৬ মেক্সিকো বিশ্বকাপেজার্মানিকে হারিয়ে শিরোপা জিতেছিলো আর্জেন্টাইনরা। চার বছর পরের আসরেরফাইনালে সেই ম্যারাডোনাদের বিরুদ্ধে মধুর প্রতিশোধ নিয়েছিলো লোথারম্যাথিউসরা। ম্যারাডোনা ফ্যাল ফ্যাল চোখে চেয়ে দেখেছিলেন প্রতিপক্ষেরশিরোপা জয়ের আনন্দ-উত্সবের দৃশ্য। অশ্রু আর হূদয়ে রক্তক্ষরণ নিয়ে মাঠছাড়তে হয়েছিল ম্যারাডোনাকে। কেঁদেছিলেন বাতিস্তুতা, ক্যানেজিয়ারা। ২০০৬ ও২০১০ আসরের কোয়ার্টার ফাইনালে দেখা দু দলের। তাতে পরাজিত হয় মেসির দেশ।শেষেরবার আট দলের লড়াইয়ে, জার্মানরা তো ৪-০ গোলে বিধ্বস্ত করেছিলমেসিদের। গতির কাছে যেন ছোট পাস আর শৈল্পিক ফুটবলের পরাজয়। সেবার দলেরজন্য তেমন ভূমিকা রাখতে পারেননি বর্তমানের বিশ্বসেরা ফুটবলার লিওনেল মেসি।
রোববারেরফাইনালের অভিনেতা একই। আর্জেন্টিনার জন্য রীতিমত প্রতিশোধের সুযোগ এনেদিয়েছে এবারের ব্রাজিল বিশ্বকাপ। মেসি কি পারবেন, আগের পরাজয়গুলোরপ্রতিশোধ নিয়ে নিজেকে আকাশ সমান উচ্চতায় নিয়ে যেতে। ক্লাব ফুটবলে সব ধরনেরশিরোপা জয়ের পর আর্জেন্টাইন সুপার স্টারের জন্য এই একটি অর্জনই অপেক্ষাকরছে।
সার্বিক পরিসংখ্যানে এগিয়ে মেসিরাই। দু দল একে অপরেরমুখোমুখি হয়েছে ২০ বার। ৯ ম্যাচ জিতেছে তারা। ৬টিতে জিতেছে জার্মানি। বাকি৫টি হয়েছে ড্র। অবশ্য বিশ্বকাপের লড়াইয়ে থমাস মুলাররা পেছনে ফেলেছেনপ্রতিপক্ষকে। ৬ মাচের ৩টিতে জয় তাদের। দুটিতে ড্র, একটিতে হার। আরআন্তর্জাতিক প্রীতিম্যাচের ১৩টির ৮টিতেই জয় আর্জেন্টিনার। আলেসান্দ্রোসাবেলার পরীক্ষিত সৈনিকরা দেশকে শিরোপা উপহার দেয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে আছেন, এটাই স্বাভাবিক। বার্সেলোনা ফরোয়ার্ড দলে থাকায় সম্ভাবনা হয়তো বেশি।তিনবার বিশ্বকাপে অংশ নেয়া মেসির জন্যও সুবর্ণ সুযোগ। তাকে সঙ্গ দেয়ারজন্য সার্জিও আগুয়েরো, গঞ্জালো হিগুয়েন, ইনজুরি সেরে ওঠা অ্যাঞ্জেল ডিমারিয়া, মাসচেরানো, জাবালেতা প্রস্তুত। ইনজুরির কারণে ডি মারিয়াসেমিফাইনালে খেলতে পারেননি। ইনজুরি কাটিয়ে তিনি দলের সাথে হালকা অনুশীলনকরেছেন। আগুয়েরোও এখন ফিট। পূর্ণ শক্তির দল নিয়েই শেষ লড়াই করতে পারবেনসাবেলা। আর্জেন্টাইন কোচের আশা পূরণ করতে শিরোপা জিততে মরিয়া আগুয়েরাবলেই দিয়েছেন, জার্মানি সব সময় ফেবারিট। তবে যেকোনো উপায়ে আমাদের জিততেহবে। এটা আর্জেন্টাইনদের স্বপ্ন। ২৪ বছর পর আমরা ফাইনালে খেলছি। দেশেআমাদের দর্শক উত্সবের প্রস্তুতি নিয়েছে। আমরাও ট্রফি এনে দিতে চাই।
২০০৬বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ গোলদাতা মিরোস্লাভ ক্লোসাও বসে থাকবেন না।জার্মান ফরোয়ার্ড নিজেদের সেরাটা খেলে প্রতিপক্ষকে হারাতে চান, ব্রাজিলকে৭-১ গোলে হারানোর কথা ভুলে গিয়েছি। এখন ফাইনাল। আর্জেন্টিনাকে হারাতেচাই। এটা আমাদের ব্রত। ব্রাজিলের বিপক্ষে খেলা উপভোগ করেছি। ফাইনালেসর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে খেলবো।জোয়াকিম লো’কে অপেক্ষাকৃত কমইভাবতে হবে। পুরো শক্তির দলই মাঠে নামাতে পারবেন তিনি। ক্লোসা, পোডলস্কি, থমাস মুলার, খেদিরা আজ জীবনের শেষ বিন্দু ঢেলে দেবেন। রোনাল্ডোর১৫ গোলের রেকর্ড ভেঙে ক্লোসা ১৬ গোল করে নতুন ইতিহাস গড়েছেন। ক্লোসার জন্যতো বড় রেকর্ড অপেক্ষা করছে এ হাইভোল্টেজ ক্লাসিক ম্যাচে। ফুটবলারদেরপারফরম্যান্সে দু দলের ফরোয়ার্ড লাইন প্রায় সমশক্তির। তবে জার্মানদেরডিফেন্স লাইন খুবই শক্তিশালী। সেমিফাইনালে অসকার, ফ্রেড, হাল্করা যেডিফেন্স ভাঙতে পারেননি। মেসিরা কি সেই দুর্গ ভেঙে জার্মানসাম্র্রাজ্যের পতন ঘটাতে পারবেন?নাকি মেসিদের গুড়িয়ে দিয়ে সোনার ট্রফিযাবে ইউরোপে।
নিজেদের ঘরে ফাইনাল খেলতে না পেরে ব্রাজিলিয়ানরা যেনচোখ ঢেকে রেখেছেন। ঘরের উঠানে প্রতিবেশী এবং অতিথির উত্সব দেখতে হবে। এমনজ্বালা সইছে না। যে জার্মানি ব্রাজিলকে ফুটবল কলঙ্কের কালী দিয়ে গোসলকরিয়ে দিয়েছে, সেই জার্মানির সর্বনাশ দেখতে চায় ব্রাজিলিয়ানরা। সবচেয়ে খুশিহবে, মারাকানার মাঠেই যদি জার্মানির অহংকার গুড়িয়ে দেয়া যায়। ফিলিপ লামযেন সোনার ট্রফি স্পর্শ করতে না পারে। তাহলেই জ্বালা মিটবেব্রাজিলিয়ানদের। কে পারবে জার্মানিদের গুড়িয়ে দিতে?যে কান্নায় ভেসেছিলব্রাজিলিয়নরা। সেটা যেন জার্মানদের হয়, এটাই চায় ব্রাজিলিয়ানরা। বাধ্য হয়েজার্মানির বিপক্ষে অবস্থান নিতে গিয়ে এখন আর্জেন্টিনার মঙ্গল কামনা করতেহচ্ছে ব্রাজিল ফুটবল দর্শকদের।