তাছির আহমেদ:মবে পাগলের দোতলা ঘরে ঘুমোনোর শখ হবে না কেনো? ডেল কার্নেগির সেই উক্তি, তুমি যদি আকাশে অট্রালিকর স্বপ্ন দেখো ভুল করোনি, তা বাস্তবায়নের পথে হাটো। এ উপদেশবানী মবে পাগল না শুনলেও তার প্রবল ইচ্ছে তাকে সফল করেছে। সে এখন তার নিজের হাতে তৈরি দোতলা ঘরে ঘুমোয়। আগলে রাখে তার স্বপ্নে গড়া অট্রালিকা।
চুয়াডাঙ্গা দামুড়হুদার হাউলী ইউনিয়নের ডুগডুগি গ্রামের রহম আলী কালক্রমে এলাকায় পাগল হিসেবেই পরিচিত।ইট, কাঠ, খড়, সিমেন্ট, বালি, কাঁচ কুড়িয়ে যে দোতলা বাড়ি বানানো যায় তা এই মবে পাগলের অট্ট্রালিকা না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। দামুড়হুদা-দর্শনা সড়কের পাশেই এ বাড়িটি।সাদা চোখে দেখেই বোঝঅ যায় এটা ঝুঁকিপূর্ণ। তাতে তার যায় আসে না। তার শুধু একটাই শঙ্কা, বাড়িটা কেউ ভেঙে দেবে না তো? বাড়িটির ছবি তুললেই তেড়ে এসেন তিনি। মারতে উদ্যত হন। সেইসাথে বলেন, এ ছবি তুললি ক্যান?ভেঙে দিবি?দে দিনি দেখি?ক্যামন তোর সাহস! মবে পাগলের ভয়ে, এলাকার মানুষ তাকে কেউ কিছু বলে না, শুধু বলে, দেখি না কি করে।
স্থানীয়রা বললেন, বছরের পর বছর ধরে আনুমানিক প্রায় ১ যুগ লেগেছে দোতলা ঘর করতে। ইচ্ছা করলেই যে কেউ উঠতে পারবে না। দেখতে হলেও দূরে দাঁড়িয়ে। মবে পাগলের বড় ভাইয়ের ছেলে মিলন বলেছেন, চাচার বাড়ির ঘরের দোতলার দেয়ালেএখন চলছে প্লাস্টারের কাজ,ভাঙা টাইলস-মাইলস আর কাঁচের আয়না জুড়ছেন কোথাও কোথাও। দেখতে দেন না কাওকে।ওখানে গেলেই মারতে আসেন।
সরেজমিনে, গত শুক্রবার অপরাহ্নের কিছু সময় আগে তখন ঠিক পৌনে ৭টা, দৈনিক মাথাভাঙ্গা পত্রিকার হালকা হলুদ গেঞ্জি গায়ে দেয়া দুজনকেতার বাড়ির সামনে দেখে মবে পাগলের সন্দেহ হলো। তখন তিনি তার দোতলার ঘরের দরজায় বসেনিষ্পলক চোখে এদের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার কিছু বোঝার আগেই, তার বাড়ির ছবি ক্যামেরা দিয়ে তুললে, বিদ্যুত গতিতে তিনি লোহার সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসেএ দুজনের মধ্যে যে হালকা-পাতলাতাকে হালকা ধাক্কা দিয়ে বললো, এ শালা তোরা ছবি তুললি ক্যান?ভেঙে দিবি?দে দিনি দেখি?ক্যামন তোদের সাহস! আপনার কষ্টের গড়া জিনিস আমরা ভাঙবো কেনো! ওই প্রতিবেদক এ কথা বলতেই, তিনি চেচামেচি করে পাশের বাড়ি থেকে তার ভাবীকে ডেকে নিয়ে এলেন। বিষয়টি কী জেনেশুনে ক্ষান্ত হলেন। এসময় তার সাথে ছিলো তারই আপন বড় ভাইয়ের ছেলে মিলন। হঠাত কালো মেঘে পশ্চিমা আকাশ আছন্ন, সেই সাথে তুমুল কালবোশেখি ঝড়, তারপর এলো বৃষ্টি। হাউলী ইউনিয়ন পরিষদ ভবন খুব কাছে, তাই আমরাও ছুট দিলাম ওখানে নিরাপদ স্থান ভেবে।
এ ভবনের সামনেই অবস্থিত এক চায়ের দোকানে বসে মিলনসহ একাধিক ব্যক্তি জানালেন, তার ওই দোতলা বাড়ি তৈরির নানা ইতিহাস। এ বাড়িটি তৈরি করতে তার প্রায় দশ-এগারো বছর সময় লেগেছে। তারপরও এখনো তার বাড়ির কাজ শেষ হয়নি। একতলা তৈরিতে তার চার বছর সময় লাগলেও দোতলায় গিয়ে লেগেছে প্রায় ছয়-সাত বছর। একই ইউনিয়নের পুরাতন হাউলী গ্রামের মরিয়ম বিবিকে তিনি আজ থেকে প্রায় ত্রিশ বছর আগে বিয়ে করেন। তাদের দাম্পত্যে জন্ম নেয় একটি পুত্রসন্তান। পুত্রের বয়স যখন দশ-বারো, তখন মাথায় দেখা দেয় সমস্যা রহম আলীর। অভাবী সংসার তার ওপর স্বামী রহম আলীর পাগলামীর যন্ত্রণা, সহ্য করতে আর না পেরে, একমাত্র পুত্রসন্তানটি সাথে নিয়ে ফিরে গেলেনমরিয়ম বিবি তার বাপের বাড়ি।
মরিয়ম বিবি ফিরে যাবার পর রহম আলী এলাকার মানুষের কাছে দিনদিন পরিচিতি লাভ করেন মবে পাগল। তারপর পাগল বেশে তিনি তার ভাইয়ের বাসায় কিছুদিন বসবাস করেন। এ বসবাস তার ভালো না লাগায় ওখানেই তিনি নিজ হাতে তৈরি করেন মাটির একটি বাড়ি। এসময় পাকা বাড়িতে বসবাস করা গ্রামেরই একটি লোক তার মাটির বাড়ি ও তাকে নিয়ে খুব তামাশা করে। সেই তামাশা ছিলো অনেকটা “বাবুই পাখিরে ডাকি, বলিছে চড়াই, কুঁড়ে ঘরে থেকে কর শিল্পের বড়াই, আমি থাকি মহাসুখে অট্টালিকার পরে, তুমি কতো কষ্ট পাও রোদ বৃষ্টির ঝড়ে।”
এক বৃষ্টির রাতে তার মাটির বাড়ির খড়ের ছাউয়া ছাদ দিয়ে ঘরের মধ্যে প্রচুর বৃষ্টি পড়ে। এ রাগে ওই মাটির ঘরটি ভেঙে ফেলে তিনি তৈরি করেন ছোটকরে একতলা পাকা বাড়ি। এ একতলা পাকা বাড়িটি তৈরি করতে তার প্রায় ৪ বছর সময় লেগেছে। এ ৪ বছর অবধি বাড়িটির ছাদ না হওয়ার আগ পর্যন্তও তিনি রোদ বৃষ্টি উপেক্ষা করে ওখানেই থাকতেন। তারপর ৭ বছরের ব্যবধানে করেন দোতলা। অবাক বিষয় তিনি তার হাতকে রাজমিস্ত্রির কুর্ণি হিসেবে ব্যবহার করে একাএকা পুরোবাড়িটি তৈরি করেন। এ কাজে কেউ সাহায্যের জন্য তার দিকে এগোতে গেলে তাকেও তিনি মারতে গেছেন। আনুমানিক দশ ফিট প্রস্থ, পনেরো ফিট চওড়া আর পচিশ ফিট উচ্চতার এ বাড়িটির দেয়ালে তিনি ব্যবহার করেছেন, ইট সিমেন্ট বালি আর খোয়া। আর বাড়ির ছাদ ব্যবহার করেছেন ইপিল গাছের গুড়ি, খড়, কাঠের তক্তা, রড়, তার, কাঁচ এবং টালি। এ বাড়ির তৈরির বিভিন্ন সরঞ্জামাদি মানুষের কাছে চেয়ে চেয়ে জোগাড় করে বাড়িটি এ অবস্থায় রুপ দিতে তার সময় লেগেছে প্রায় এগারো বছর। তার দু’হাতে সিমেন্টের খারে প্রচুর ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে তবুও তিনি কখনো বলেননি ব্যথা লেগেছে।
দামুড়হুদা উপজেলা চেয়ারম্যান মাও. আজিজুর রহমান বলেন, রহম আলী ওরফে মবে পাগলের এ বাড়ি আমার বাড়ির পাশে হওয়ায় তাকে দেখেছি তার নিজ হাত দিয়ে বাড়ি তৈরি করতে। বাড়ি তৈরি করবে বলে মাঝে মাঝে চেয়েছে একদু’শো টাকা। ওযে সত্যি সত্যি এরকম বাড়ি করবে তা আমি কখনো ভাবিনি।