এমপি ইলিয়াস মোল্লাকে অপমানের জেরে আগুন!ফাঁসি দাবি

দীর্ঘদিনেরবিদ্যু সমস্যা নিয়ে সৃষ্ট রাজু বস্তিবাসীর ক্ষোভকে কাজে লাগিয়েছেন স্থানীয়এমপি ও তার ক্যাডাররা?

 

স্টাফ রিপোর্টার:একইপরিবারের ৯ জনসহ ১০ জন নিহত হওয়ার প্রতিবাদে গতকাল রোববার দিনভর সড়ক অবরোধ করেবিক্ষোভ করেছে মিরপুরের কালসীতে কুর্মিটোলা আটকে পড়া পাকিস্তানি (বিহারি)ক্যাম্পের বাসিন্দারা। তারা কালসী-নতুন ডিওএইচএস সড়কে ও কালসী রোডে কয়েকটিগাড়ি ভাঙচুর করেছে। বিক্ষোভে মিল্লাত ক্যাম্পসহ অন্যান্য ক্যাম্পেরবিহারিরাও যোগ দিয়েছেন। ঘটনাস্থল ও বিহারি অধ্যুষিত এলাকাগুলোয় মোতায়েন করাহয়েছে অতিরিক্ত পুলিশ। পুলিশের সাথে বিহারিদের দফায় দফায়ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া হয়েছে। নিহত ১০ জনের লাশ ময়নাতদন্ত শেষে নির্বাহীম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বিহারিরাঘটনাস্থলে প্রধানমন্ত্রী যাওয়ার দাবি করে লাশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়অভিমুখে বিক্ষোভের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। গতকালরোববার রাত ৯টায় এ রিপোর্ট লেখাপর্যন্ত ক্যাম্প এলাকায় বিক্ষোভ করছিলো বিহারিরা। তখন পর্যন্ত নিহতদের লাশদাফন হয়নি।

এদিকে অভিযোগ উঠেছে, কুর্মিটোলাবিহারি ক্যাম্পে আগুনের ঘটনার তিন দিন আগে অপমানিত হয়েছিলেন স্থানীয় সংসদসদস্য (এমপি) ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লা। সবাইকে দেখে নেবে- এ মর্মে হুমকি দিয়েক্যাম্প ত্যাগ করেছিলেন এমপি। ওই ঘটনার বদলা নিতেই গত শনিবার ভোরে আতশবাজিরইস্যুকে কাজে লাগিয়ে রাজু বস্তি এবং স্থানীয় যুবলীগ নেতারা আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সহায়তায় কুর্মিটোলা ক্যাম্পে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে। দীর্ঘদিনেরবিদ্যুত সমস্যা নিয়ে সৃষ্ট রাজু বস্তিবাসীর ক্ষোভকে কাজে লাগিয়েছেন স্থানীয়এমপি ও তার ক্যাডাররা। এছাড়া নৃশংস হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে আছে ক্যাম্পেরজমি দখলের ষড়যন্ত্রও।এমপি ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগকরেছেন কুর্মিটোলা বিহারি ক্যাম্পবাসী। আগুন ও নিহতের ঘটনায় স্থানীয় এমপিরজড়িত থাকার অভিযোগ এনে রোববার ক্ষুব্ধ ক্যাম্পবাসী তার কুশপুত্তলিকা দাহকরে। পাশাপাশি এমপির ফাঁসি দাবি করে বিভিন্ন স্লোগান দেন বিহারিরা। এদিকেঘটনার ৪৮ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও স্থানীয় এমপি ঘটনাস্থল পরিদর্শন না করায় তারদিকে সন্দেহের তীর আরও ঘনীভূত হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।

বিহারিদেরনেতা মোস্তাক আহমেদ অভিযোগ করেন, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ ওমাস্তানরা বিহারিদের জমি দখলের পাঁয়তারা করছে। এ ক্ষেত্রে পুলিশের পল্লবীজোনের পুলিশ কর্মকর্তা এসি কামাল অতি উৎসাহী হয়ে কাজ করেছেন। তার বিরুদ্ধেদখল অপরাধী চক্রকে শেল্টার দেয়ার অভিযোগ করেছেন আরও অনেকে। তবে এ অভিযোগভিত্তিহীন বলে দাবি করেছেন এসি কামাল। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এমপিকে যেরাতে অপমান করা হয়, ওই রাতের পরদিন রাজু বস্তির নেতা মো. নিয়াজ বাদী হয়ে ২০জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন। বৃহস্পতিবার এ মামলা দায়েরের পরশুক্রবার বিকেলে পুলিশ গিয়ে ক্যাম্পের বাসিন্দাদের সতর্ক করে। এ সময় পুলিশজানায়, রাজু বস্তির বিদ্যুত লাইন সংযোগ নিয়ে কেউ বাড়াবাড়ি করলে তার খবরআছে। এমপি সাহেবের নির্দেশে এখানে তারা এসেছেন বলেও পুলিশ জানায়বাসিন্দাদের।

বিহারি ক্যাম্পের রিলিফ কমিটির চেয়ারম্যান জালাল উদ্দিনভল্টু বলেন, এ ঘটনার পেছনে ইলিয়াস আলী মোল্লা ও তার লোকজন জড়িত। তিনিপ্রতিশোধের বদলা নিতে এ হত্যাকাণ্ড ঘটান। এতে তার সন্ত্রাসী বাহিনী ওযুবলীগের কতিপয় নেতা জড়িত রয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করলে ঘটনার রহস্যবেরিয়ে আসবে। ভল্টু বলেন, রাজু বস্তির বিদ্যুত লাইন সংযোগ দেয়ার জন্য এমপিআমাকে ডেকেছিলেন। আমি মিটিংয়ের কারণে যেতে পারিনি। এর জন্য আমাকেসহ ২০ জনকেমামলায় ফাঁসানো হয়।
ক্যাম্পের বাসিন্দারা অভিযোগ করেন, রাজু বস্তিতেবিদ্যুত লাইন ছিলো না। তাই স্থানীয় যুবলীগ নেতা জুয়েল রানা ও রাজু বস্তিরলোকজন স্থানীয় সংসদ সদস্য ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লার প্রভাব খাটিয়ে পাশের মূলবিহারি ক্যাম্প থেকে অবৈধভাবে বিদ্যুত লাইনের সংযোগ নেয়। চাঞ্চল্যকর তথ্যহল, রাজু ক্যাম্পের লোকেরা বিদ্যুত সুবিধে নিলেও বিহারি ক্যাম্প থেকেবিদ্যুত সংযোগ নেয়ার কারণে তাদের বিদ্যুতের বিল পরিশোধ করতে হতো না। কিন্তুএমপির লোকজন রাজুর বস্তির প্রতিটি বাড়ি থেকে বিদ্যুৎ বিলের টাকা নিত। এটাকা অনেকের মাঝে ভাগ-ভাটোয়ারা হতো।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ইলিয়াসমোল্লার ক্যাডার বাহিনীর অন্যতম ৫ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগ নেতা জুয়েল রানা এরাজু বস্তিতে বিদ্যুত সংযোগের মাধ্যমে অবৈধভাবে টাকা উত্তোলন করে। এ নিয়েবিহারি নেতাদের মাঝে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। তারা বিদ্যুত কোনোভাবেই রাজুবস্তিতে দেবে না বলে কঠোর অবস্থান নেন। এক পর্যায়ে তারা রাজু বস্তিতে দেয়াবিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। পরে এমপির লোকজন কুর্মিটোলা ক্যাম্পেরবিদ্যুত ও পানির লাইন বিচ্ছিন্ন করে। এ ঘটনায় রাস্তায় নেমে পড়েন ক্যাম্পেরলোকেরা। শনিবারের অগ্নিসংযোগের ঘটনার তিন দিন আগে বিহারিরা বিদ্যুৎ ও পানিরসংযোগ দাবি করে। সেই দিন পুলিশের কাছে খবর পেয়ে এমপি ইলিয়াস আলী মোল্লাসেখানে গেলে তার সঙ্গে অনেকের তর্কাতর্কি হয়। এক পর্যায়ে পরিস্থিতি খারাপেরদিকে গেলে গভীর রাত পর্যন্ত এমপি সেখানে অবস্থান করেন। পরিস্থিতি প্রতিকূলহওয়ায় ক্যাম্পবাসীকে দেখে নেয়া হবে- এই মর্মে হুমকি দিয়ে চলে আসেন। এরইজের হিসেবে শনিবার ভোরে কুর্মিটোলা বিহারি ক্যাম্পে আগুন লাগানো হয় বলেক্যাম্পবাসীর অভিযোগ।

বিহারি ক্যাম্পের মুন্না হোসেন অভিযোগ করেন, অগ্নিকাণ্ডের তিন দিন আগে রাতে এমপি ইলিয়াস আলী মোল্লা ক্যাম্পের সামনেহাজির হন। তিনি সেখানে এলাকার লোকদের উদ্দেশে বলেন, ‘রাজু বস্তিতে বিদ্যুৎলাইন থাকবে। এ লাইন বৈধ না অবৈধ এবং কোথা থেকে এসেছে এটি দেখার দরকার নেই।তিনি আরও বলেন, কে বিদ্যুৎ লাইন বিচ্ছিন্ন করার আদেশ দিলেন সেটিও বিবেচনায়আনার দরকার নেই। শেখ হাসিনার সরকার জনগণের সরকার। তাই জনগণের জন্য যেটিমঙ্গল হবে সেটিই করা হবে।’ ওই সময় লোকজন বলাবলি করে রাজু বস্তি থেকে আপনারনেতারা বিদ্যুতের বিল তুলছে এ বিষয়ে ইলিয়াস মোল্লা কোনো ধরনের কর্নপাতকরেননি। এমপির বক্তব্যের পর ক্যাম্পের লোকজনের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ ছড়িয়েপড়ে। মুন্না আরও দাবি করেন, ওই রাতে বিক্ষুব্ধ লোকজন ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লারপাঞ্জাবির কলার ছিঁড়ে ফেলে। ধাক্কাধাক্কিতে ইলিয়াস মোল্লা পড়ে যান।

এঘটনার পর রাজু বস্তির বাসিন্দা মাদক ব্যবসায়ী মো. রিয়াজ বাদী হয়ে বিহারিক্যাম্পের লোকজনের বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করেন। মামলানম্বর ৫। এ মামলায় কুর্মিটোলা বিহারি ক্যাম্পের সভাপতি জালাল উদ্দীন আহমেদভল্টু ও সেক্রেটারি মো. ফিরোজসহ ২০ জনকে আসামি করা হয়। জানতে চাইলে স্থানীয়সংসদ সদস্য ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লা এ বিষয়ে জানান, তিনি ভল্টুকেডেকে তিন ঘণ্টারও বেশি সময় অপেক্ষা করেন। কিন্তু সে ঘটনাস্থলে আসেন না। পরেতিনি সেখান থেকে চলে যান। তিনি দাবি করেন, আমি রাজনীতি না করলেও এ ধরনেরপচা নির্দেশ দিই না। তদন্ত করে দেখা হোক আমার লোক জড়িত থাকলে তাদের আইনেরআওতায় নেয়া হোক।

বিহারিদের নেতা স্ট্রান্ডেড পাকিস্তানিজ জেনারেলরিপ্যাট্রিয়েশন কমিটির (এসপিজেআরসি) কুর্মিটোলা ক্যাম্পের সভাপতিনিজামুদ্দিন বলেন, বাইরে থেকে দরজা লাগিয়ে একই পরিবারের ৯ জনকে পুড়িয়েহত্যা করা হয়েছে। পুলিশ গুলি করে মেরেছে একজনকে। তাদের লাশ মর্গ থেকেক্যাম্পে নেয়ার পর প্রধানমন্ত্রী যদি আমাদের ক্যাম্পে আমাদের দুঃখের কথাশুনতে না আসেন, স্থানীয় এমপি আমাদের ওপর কি অত্যাচার শুরু করেছেন তা জানতেনা আসেন তাহলে আমরা লাশগুলো নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গিয়ে বিক্ষোভকরব। একই কমিটির প্রচার সম্পাদক খোরশেদ আলম বলেন, আগুনে পুড়িয়ে আমাদেরক্যাম্পের লোকদের হত্যার দায়ে এমপি ইলিয়াস মোল্লার যথাযথ বিচার করে ফাঁসিরদড়িতে ঝুলাতে হবে।