ফাইজার চৌধুরী: বিশ্বকাপ ফুটবল উপলক্ষে চুয়াডাঙ্গা স্টেডিয়ামে উড়ছে বিদেশি পতাকা। অথচ ফুটবল বা ক্রিকেটের একটি বলও এ মাঠে এখনও পর্যন্ত গড়ায়নি। খেলা হবেই বা কীভাবে?নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে, শেষ হয়েছে জেলা ক্রীড়া সংস্থার কাছে হস্তান্তর প্রক্রিয়াসহ অন্য আনুষ্ঠানিকতা, শুধু বাকি আছে উদ্বোধন। শুধুমাত্র উদ্বোধনের অপেক্ষা করতে গিয়ে আধুনিক সুযোগ সুবিধা সম্পন্ন চুয়াডাঙ্গা জেলা স্টেডিয়ামটি অকেজো হয়ে পড়ে আছে বেশ কয়েকমাস যাবত।
নবনির্মিত স্টেডিয়াম এলাকার পরিবেশ বর্তমানে সংরক্ষিত এলাকার মতো। বলা যেতে পারে, সর্বসাধারণের এখানে প্রবেশ নিষেধ। সংবাদকর্মী পরিচয় দেয়ার পরও প্রধান গেট খুলতে অপারগতা প্রকাশ করলেন ১২ দশমিক ৩৬ একর জমির ওপর নির্মিত জেলা স্টেডিয়ামে একমাত্র নিরাপত্তাকর্মী কাম কেয়ারটেকার। চুয়াডাঙ্গা জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদকের কাছে মুঠোফোনে কথা বলার পর মিললো ঢোকার অনুমতি।
হুইপ চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের সংসদ সদস্য সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দারের বহু চেষ্টা তদবিরে চুয়াডাঙ্গাবাসীর দীর্ঘ দিনের দাবি জেলা স্টেডিয়ামের নির্মাণকাজ ২০১২ সালের প্রথম দিকে শুরু হয়। স্থানীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স আবুল কালাম আজাদ ১৭ কোটি ৯০ লাখ (জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের প্রতিবেদনে নির্মাণ ব্যয় দেখানো হয়েছে ১৭ কোটি ১লাখ টাকা) টাকার এ প্রকল্পের কাজ চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে শেষ করেছে। ঠিকাদার আবুল কালাম আজাদ জানান, ২০১৪ সালের (চলতি বছর) মার্চ মাসে তিনি জেলা ক্রীড়া সংস্থার কাছে স্টেডিয়াম হস্তান্তর করেছেন। নির্মাণ কাজে ত্রুটি বা মানের প্রশ্নে দ্বিমত পোষন করলেন তিনি। দুর্নীতি দমন কমিশন কর্তৃক (দুদক) এ স্টেডিয়াম নির্মাণে অনিয়মের বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের কথা তোলা হলে তিনি জানান, তাদের নির্মাণ কাজে কোনো দুর্নীতি নেয়। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে দেশের কয়েকটি স্টেডিয়াম নির্মাণে যে অনিয়মের অভিযোগ জমা হয়েছিলো, সেই ব্যাপারে স্বাক্ষ্য দিতে তাকে দুদকে তলব করা হয়।
নতুন স্টেডিয়ামে রয়েছে তিনতলা বিশিষ্ট ভিআইপি গ্যালারি, ড্রেসিং রুম, প্রেসবক্স, সাধারণ গ্যালারিসহ আধুনিক স্টেডিয়ামের প্রায় সব সুযোগ-সুবিধা। দর্শক ধারণ ক্ষমতা ১২ হাজার। হস্তান্তরের ৩ মাস পার হওয়ার পরও নতুন স্টেডিয়ামের কার্যক্রম কেন শুরু হয়নি? (যদিও চলতি মাসের প্রথম সপ্তায় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সভায় প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে যে, চুয়াডাঙ্গা জেলা স্টেডিয়ামের নির্মাণকাজ নাকি ৯০ শতাংশ শেষ হয়েছে) এ প্রশ্নের জবাবে জেলা ক্রীড়া সংস্থার সভাপতি চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক দেলোয়ার হোসাইন জানান, স্টেডিয়ামটি প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করবেন বলে কথা ছিলো। এ জন্যই দেরি হচ্ছে। উদ্বোধনের পর বিভাগীয় পর্যায়ের ফুটবল বা ক্রিকেট লীগ এ স্টেডিয়ামে আয়োজন করা সম্ভব বলে তিনি জানান। এমনকি জাতীয় ক্রিকেট লীগের খেলাও এখানে খুব সহজেই চালানো সম্ভব। এজন্য তিনি বিসিবির দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তাহলে কী নামকরণের জন্য অপেক্ষা?এবার তিনি (জেলা প্রশাসক) এ বিষয়ে তার জানা নেই বলে জানিয়ে বলেন, নির্মাণের প্রথম থেকে হস্তান্তর প্রক্রিয়া পর্যন্ত নতুন স্টেডিয়ামের নাম চুয়াডাঙ্গা জেলা স্টেডিয়াম বলে তিনি জেনে এসেছেন।
নতুন স্টেডিয়ামে যাওয়ার পথেই স্টেশন সংলগ্ন স্থানে চুয়াডাঙ্গা জেলা ক্রীড়া সংস্থার বর্তমান কার্যালয়। এর সাথেই পুরাতন স্টেডিয়াম। গ্যালারি, মাঠের হতশ্রী এ পরিবেশেই চলছে ফুটবল অথবা ক্রিকেট লীগ। যদিও তা অনিয়মিত। বিকেলে অনুশীলনে ব্যস্ত চুয়াডাঙ্গা জেলা দলের ফুটবলার জানান, নতুন স্টেডিয়ামের মাঠে খেলার আকুতি ও সম্ভাবনার কথা। এতো বছর যাবত যে মাঠ ও গ্যালারি চুয়াডাঙ্গা স্টেডিয়াম নামে পরিচিত সেটি আসলে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের প্রাকটিস গ্রাউন্ড। এ কথার সত্যতা মিললো ৪০’র দশকে অবিভক্ত বাংলার অন্যতম ফুটবলার আব্দুল ওয়াদুদের মুখে। টানা দশ বছর কোলকাতা মোহামেডানের হয়ে মাঠ কাঁপিয়েছেন সাবেক এ স্ট্রাইকার। প্রায় শতবর্ষী ওয়াদুদ জানান, মোহামেডান ক্লাবের ফুটবলারদের অনুশীলনের জন্য ১৯৪৩ সালে নিজেদের উদ্যোগেই তৈরি করেছিলেন এ মাঠ। যা এতো দিন স্টেডিয়াম নামে চলে আসছে। এ কথার সত্যতা মিললো জেলা প্রশাসকের দেয়া বক্তব্যেও।
সাধারণ মানুষ আর খেলোয়াড়দের প্রশ্ন, বহুল প্রত্যাশিত স্টেডিয়ামের নির্মাণকাজ যখন শেষ হয়েছে। তখন কেনই বা এ পরিবেশে তাদেরকে খেলা চালিয়ে যেতে হচ্ছে?অবশ্য এ প্রশ্নের উত্তর সংশ্লিষ্টদের সকলেই কৌশলে এড়িয়ে গেছেন। চুয়াডাঙ্গাবাসী সবচেয়ে অবাক হয়েছিলো গত বছরের ২৭ আগস্টে। যেদিন প্রায় তৈরি হওয়া নতুন স্টেডিয়ামের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন তৎকালীন যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী আহাদ আলী সরকার। বেশ ঘটা করে আয়োজিত ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের ফলক উন্মোচন অনুষ্ঠানের পর প্রতিমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, মাস দুয়েকের মধ্যেই এখানে কার্যক্রম শুরু হবে। যোগ হবে আরও অনেক সুযোগ-সুবিধা। মন্ত্রীর পরিদর্শন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের প্রায় বছর ঘুরে এলো। এখনও সেই একই অবস্থানে পড়ে আছে চুয়াডাঙ্গা জেলা স্টেডিয়াম। পরিচর্যার অভাবে ইতোমধ্যে মরে গেছে মাঠের দুর্বাঘাস।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন জানালেন, কোনো ধরনের কার্যক্রম না থাকা পাশাপাশি দেরি হওয়ার কারণে চুয়াডাঙ্গা নতুন স্টেডিয়ামের যে হাল হতে চলেছে, তাতে উদ্বোধনের আগে এটিকে আবার মেরামত করতে হবে।
চুয়াডাঙ্গা জেলা তথা এ অঞ্চলের খেলাধুলার মানোন্নয়নে স্টেডিয়ামটি যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে পারবে বলে মনে করেন খেলার সাথে সংশ্লিষ্টরা। পাশাপাশি দেশের ক্রীড়া ক্ষেত্রে অত্যন্ত সম্ভবনাময় একটি ভেন্যু উদ্বোধনের অপেক্ষায় মাসের পর মাস পড়ে থাকবে এ বিষয়টি মানতে পারছেন না কেউই।