নারায়ণগঞ্জেসাত অপহরণ ও খুন : আরিফের স্বীকারোক্তি

 

স্টাফ রিপোর্টার:নারায়ণগঞ্জেসাত অপহরণ ও খুনের ঘটনায় নিজের সরাসরি অংশগ্রহণ ও র‌্যাবের বেশকিছুকর্মকর্তার সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেছেন র‌্যাবের চাকরিচ্যুত কর্মকর্তামেজর আরিফ হোসেন। গতকালবুধবার আদালতে ১৬৪ ধারায় দেয়া ২০ পাতার জবানবন্দিতে পুরোকিলিং মিশনের বর্ণনা দিয়েছেন তিনি। তার জবানবন্দিতে উঠে এসেছে গ্রেফতারকৃতলে. কর্নেল তারেক সাঈদ, লে. কমান্ডার এমএম রানাসহ র‌্যাবের ঊর্ধ্বতনকর্মকর্তা ও একাধিক রাজনৈতিক ব্যক্তির নাম।গতকাল দুপুরে নারায়ণগঞ্জেরসিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কেএম মহিউদ্দিনের আদালতে ১৬৪ ধারায় দেয়া এজবানবন্দি রেকর্ড করা হয়।

জানা গেছে, মেজর আরিফকে গতকাল বুধবার সকাল ১০টায়অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে আদালতে হাজির করা হয়। এরপর জবানবন্দি দেয়ারসিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য বেলা ১১টা পর্যন্ত তাকে সময় বেঁধে দেন আদালত। বেলা২টার পর আরিফ তার জবানবন্দি দেয়া শুরু করেন। বিকাল পৌঁনে ৫টার দিকেজবানবন্দি লিপিবদ্ধ করা শেষ হয়। স্বীকারোক্তিতে কী বলেছেন মেজর আরিফ- এতথ্য জানার জন্য উদগ্রীব হয়েছিলেন মিডিয়াকর্মীরা। কিন্তু জবানবন্দির কপিমেলেনি।আদালতের একটি সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, মেজরআরিফের জবানবন্দিতে উঠে এসেছে এ হত্যার পরিকল্পনাকারী হিসেবে একজনসরকারদলীয় মন্ত্রীর ছেলের নাম। ওই মন্ত্রীর ছেলের মাধ্যমেই নূর হোসেননজরুলকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। জবানবন্দিতে মেজর আরিফ আরও উল্লেখ করেন, আইনজীবী চন্দন সরকারকে অপহরণের সময় তাকে নজরুলের লোক বলে ভুল করেছিলোর‌্যাবসদস্যরা। ওই ৭ জনকে তুলে নেয়ার দায়িত্বে ছিলেন এমএম রানা। অপহরণের পরঘটনাস্থলেই চন্দন সরকারের পরিচয় জানা যায়। একপর্যায়ে চন্দনকে ছেড়ে দেয়ারওসিদ্ধান্ত হয়েছিলো। কিন্তু অ্যাড. চন্দন সেখানে আর্গুমেন্টকরায় তাকেওহত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ওই সূত্র আরও জানায়, অপহরণের বিষয়টির‌্যাবের ঊর্ধ্বতন মহলের কাউকেজানানো হয়েছিলো। সেখান থেকে গ্রিন সিগনালপেয়েই বাকি কাজ করা হয়েছে। মেজর আরিফ তার জবানবন্দিতে বর্ণনা করেছেন, কিভাবে ৭ জনকে শ্বাসরোধ করে হত্যার পর লাশের সাথে ইট বোঝাই বস্তা বেঁধেশীতলক্ষ্যা নদীতে ফেলা হয়েছে। ইটগুলো র‌্যাবের আদমজী ক্যাম্পের পাশেই একটিপ্রতিষ্ঠানের কাজের জন্য রাখা হয়েছিলো।

নারায়ণগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতিরসভাপতি সাখাওয়াত হোসেন খান আদালতে দেয়া আরিফের জবানবন্দির বরাত দিয়ে বলেন, আরিফ ইতিমধ্যে সাত খুনে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। ২০ পাতারজবাবন্দিতে আমরা জানতে পেরেছি যে, পুরো কিলিং মিশন তারেক সাঈদ নিজে উপস্থিতথেকে সম্পন্ন করেছেন। যেভাবে সাত জনকে খুন করা হয়েছে তার রোমহর্ষক বিবরণদিয়েছেন মেজর আরিফ। এ হত্যায় পরিকল্পনাকারীর একজন হয়ে তারেক সাঈদ পুরোকিলিং মিশন মনিটরিং করেছেন। জবানবন্দিতে বের হয়ে এসেছে এ হত্যায় নূরহোসেনের হয়ে র‌্যাব কর্মকর্তারা টাকার বিনিময়ে কাজ করেছেন। এ হত্যায়র‌্যাবের উচ্চপর্যায় থেকে শুরু করে নিপদস্থ পর্যন্ত কারা কারা জাড়িত ছিলেনতাও বেরিয়ে এসেছে।

৩নং সেলে আরিফ: নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগারের একটিসূত্র জানিয়েছে, ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয়ার পর মেজর আরিফকে কারাগারেপাঠানোর নির্দেশ দেন আদালত। সেখান থেকেই তাকে নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগারেনিয়ে যাওয়া হয়। কারাগার কর্তৃপক্ষ মেজর আরিফকে ৩নং সেলের একটি কক্ষেরেখেছে। সেখানে রয়েছে লাগোয়া বাথরুম। রাতে শোয়ার জন্য দেয়া হবে দু’খানিপুরনো কম্বল। আজ সকালে কারাগারের নতুন কয়েদি হিসেবে মেজর আরিফের ছবি তোলাহবে, নেয়া হবে ফিঙ্গার প্রিন্ট, স্বাক্ষর আর শরীরের উল্লেখযোগ্য কোনোচিহ্নের বর্ণনা।

তারেক ৫ দিনের রিমান্ডে : চাকরিচ্যুত র‌্যাব-১১ এরসাবেক কমান্ডার অবসরে পাঠানো সেনাবাহিনীর লে. কর্নেল তারেক সাঈদকে চতুর্থদফায় পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। সাত হত্যাকাণ্ডের ঘটনার প্যানেলমেয়র নজরুল ইসলামের স্ত্রীর ও অ্যাড. চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় পালেরদায়ের করা পৃথক দুটি মামলায় সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করলে আদালত পাঁচ দিনেররিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। একই মামলায় তৃতীয় দফার রিমান্ড শেষে মেজরআরিফকেও হাজির করা হলে আদালত তাকে জেলহাজাতে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

আদালতসূত্র জানায়, গতকালবুধবার বিকাল ৫টা ১৮ মিনিটে তারেক সাঈদকে নারায়ণগঞ্জ সিনিয়রজুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ইশতিয়াক আহমেদ সিদ্দিকীর আদালতে হাজির করা হয়। ঠিকদু’মিনিট পরেই সেখানে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের খাসকামরায় অপেক্ষমাণ মেজর আরিফকেও হাজির করে পুলিশ। শুনানির সময় আদালতরাষ্ট্রপক্ষে কোর্ট পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) আশরাফুজ্জামান আদালতকেজানান, পারিপার্শ্বিক এভিডেন্স ও এ যাবৎ তদন্তে এ ঘটনার রহস্য প্রায়উদঘাটন হয়ে গেছে। ইতিমধ্যেই মেজর আরিফ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকারকরে জবানবন্দি দিয়েছেন। তদন্তে কিছু লোকের নাম এসেছে এবং নূর হোসেন কোথায়পালিয়ে গেছেন এসব তথ্য জানতে আসামি তারেক সাঈদকে আরও জিজ্ঞাসাবাদেরপ্রয়োজন। এ সময় রিমান্ড শুনানির সময় রাষ্ট্রপক্ষে পুলিশ ও আইনজীবীরাবিভিন্ন যুক্তি তুলে ধরেন। আদালতকে অ্যাড. সাখাওয়াত হোসেন জানান, মেজরআরিফের জবানবন্দিতে তারেক সাঈদের নাম প্রকাশ পেলেও তিনি এখন পর্যন্ত মুখখোলেননি। আদালতকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, গত শুক্রবার যখন তারেকসাঈদকে আদালতে আনা হয় তখন তিনি বলেছিলেন, তিনি সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান।কিন্তু আমরা কাগজে-কলমে দেখতে পেলাম তারেক সাঈদের বাবা মানুষকে হয়রানিকরতে ৩৭টি মামলা করেছেন। সেই ঘরের সন্তান তিনি। পেশাদার খুনি বলেই তিনি এতোবড় কিলিং মিশন সম্পন্ন করেছেন। এ সময় বারের সাবেক যুগ্মসম্পাদক অ্যাড.আনিসুর রহমান জুয়েল বলেন, ২৭ এপ্রিল অপহরণের দিন রাত দেড়টায় হাজীগঞ্জচেকপোস্ট এলাকায় র‌্যাবের ৩টি গাড়ি আটকে দেয় সেখানকার পুলিশ। সে সময়তল্লাশি করতে চাইলে র‌্যাব সদস্যরা নেমে আসেন। তাদের সাথে তারেক সাঈদওছিলেন। তিনি নেমে এসে বলেন আমি কমান্ডিং অফিসার। সেই গাড়িগুলোতেই অপহ্নতরাছিলেন। এ সময় তারেক সাঈদ আদালতে বলেন, সব অভিযোগ কল্পনাপ্রসূত। যতো দ্রুতসম্ভব এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করা হোক। শুনানি শেষে সিনিয়র জুডিশিয়ালম্যাজিস্ট্রেট ইশতিয়াক আহমেদ সিদ্দিকী তারেক সাঈদকে ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুরকরেন।