ঝিনাইদহ অফিস: ঝিনাইদহের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি চরম অবনতি ঘটেছে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কর্মস্থলে লাঞ্ছিত হয়ে কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না। গ্রামগঞ্জে রাজনৈতিক কারণে সংঘর্ষ হচ্ছে প্রতিনিয়ত। সংঘর্ষে আহত হয়ে হাসপাতালে রেকর্ড পরিমাণ রোগী ভর্তি হচ্ছেন। খুন, অপহরণ, চুরি-ডাকাতি, চাঁদাবাজি ও ধর্ষণের ঘটনায় জনপদে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। যাত্রার নামে উলঙ্গ নাচ আর জুয়ার আসর ছেয়ে চলছে গ্রামে গ্রামে।
শৈলকুপা ও কোটচাঁদপুর শহরে পুলিশের তত্ত্বাবধানে মাসের পর মাস জুয়ার আসর চলছে। কিন্তু বন্ধ হচ্ছে না। পুলিশের আটক বাণিজ্যে মানুষ দিশেহারা। অপরাধীদের পাশাপাশি পুলিশও সমানতালে অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়েছে। পুলিশ আটক করে অভিনব পন্থায় মুক্তিপণ বাণিজ্য করছে। ফলে মানুষের আশা ভরসার শেষ আশ্রয়টুকু নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। কোটচাঁদপুর ও মহেশপুর এলাকায় পুলিশের নির্যাতনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। মহেশপুরের ওসি শাহাজান টাকার নেশায় যেন বিভোর। চাকরির শেষ পর্যায়ে এসে তিনি টাকা আদায়ে ব্যস্ত।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, চলতি বছরের ৫ মাসে নারী শিশুসহ জেলায় খুন হয়েছেন অন্তত ৩১ জন। হরিণাকুণ্ডু উপজেলার আদর্শ-আন্দুলিয়া গ্রামে মজিবর রহমানের ছেলে মসিয়ার রহমান (৫০) খুন হন। রহিম নামে এক মাদরাসাছাত্রকে অপহরণ করে ৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। অপহরণকারীচক্রের চার সদস্যকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। ঝিনাইদহ উপজেলা ছাত্রদলের সদস্য ইলিয়াসকে গুম করা হয়েছে। ৮ দিন ধরে তিনি নিখোঁজ। সদর উপজেলার এনায়েতপুর গ্রামে লুৎফর রহমানের ছেলে আব্দুল খালেক মণ্ডলকে কুপিয়ে খুন করা হয়েছে। মহেশপুর এবং সদর উপজেলার হলিধানী ও সাগান্নাসহ বিভিন্ন গ্রামে প্রতিনিয়ত ডাকাতির ঘটনা ঘটছে। এর মধ্যে সদর উপজেলার সাগান্না ও হলিধানী গ্রাম থেকে ডাকাতরা ৩০ ভরি সোনা ও নগদ টাকা লুট করেছে। বাধা দেয়ার কারণে পিটিয়ে আহত করা দু মহিলাকে। মোহাম্মদপুর, সাধুহাটি, বোড়াই, নাথকুণ্ডু ও বঙ্কিরা গ্রামে ডাকাতরা হানা দিয়েছে। কোটচাঁদপুর-জীবননগর সড়কে পুলিশ সদস্যরাও ডাকাতির কবলে পড়েছেন। বিষয়খালী এলাকায় গ্রামীণ ব্যাংকে ডাকাতি হয়েছে। তাদেরকে কুপিয়ে আহত করা হয়। কালীগঞ্জ পৌরসভার সাবেক প্যানেল মেয়র ইসমাইল হোসেন, আড়পাড়ার ৫ মাসের শিশু নুসরাত, মহেশপুর ঘুঘরী গ্রামে কৃষক আমিনুল হক, করিঞ্চা গ্রামের আব্দুর রাজ্জাক, শৈলকুপার দুধসর গ্রামের কৃষক বিশারত শেখ, শ্রমিক নেতা আব্দুল গফফার, হরিণাকুণ্ডু উপজেলার কাপাশহাটিয়া গ্রামে এক গৃহবধূ, শিকারপুর গ্রামের মহিউদ্দীন, শৈলকুপার চতুরা গ্রামে আইয়ূব হোসেন, কোটচাঁদপুরের ইউপি সদস্য হাফেজ আবুল কালাম, ঝিনাইদহ শহরের আরাপপুর এলাকায় শৈলকুপার মাদরাসাছাত্র জিহাদ, হরিণাকুণ্ডুর তোলা গ্রামে বোমা হামলায় জাহাঙ্গীর, শৈলকুপার মিনগ্রামে আজাদসহ অনেক মানুষ খুন হয়েছেন। এ সময়ে ডজন খানেক নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। হরিণাকুণ্ডু ও সদর উপজেলায় দু ছাত্রীকে অপহরণের পর পুলিশ উদ্ধার করেছে। তাদেরকে আটকে রেখে ধর্ষণ করা হয়েছে। জেলা শহরের চাকলাপাড়া ও কাঞ্চনপুরে দু শিশু ধর্ষণের ঘটনায় তড়িৎ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে পুলিশ। প্রভাবশালীদের চাপের কাছেও পুলিশ মাথানত করেনি।
এদিকে বিভিন্ন চরমপন্থি দলের নামে নীরব চাঁদাবাজি করা হচ্ছে। জ্বিনের বাদশার অত্যাচারে গ্রামের মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। শহরে ৫ মাসে শাতাধিক মোটরসাইকেল চুরি হলেও কোনো মোটরসাইকেল উদ্ধার হচ্ছে না। এ সব ঘটনায় জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর বড় ধরনের প্রভাব বিস্তার করেছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির মাঝে পুলিশের আটক বাণিজ্যে দিশেহারা মানুষ। ইতোমধ্যে দুজন ওসি ও একজন এসআইয়ের বিরুদ্ধে আটক বাণিজ্যর অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। এরা হলেন-মহেশপুর থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আকরাম হোসেন, কালীগঞ্জ থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মনির উদ্দিন মোল্লা এবং সদর থানায় কমর্রত এসআই মিলন মৈত্র। নতুন করে মহেশপুর থানার ওসি শসাহাজান ও কোটচাঁদপুর থানার এসআই মিজানের বিরুদ্ধে আটক বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। তারা সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ নিয়ে পুলিশ তদন্ত শুরু করেছেন।
মহেশপুর থানার ওসি শাহজাহান গত ৮ মে কাজির বেড় ইউনিয়নের বাঘাডাঙ্গা গ্রামের মুহাম্মদ আলী, জিন্নানগর গ্রামের সমশের আলী ও তার ছেলে এনামুল হককে মারপিট করে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে ৪ লাখ টাকা আদায় করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। নেপা গ্রামে মন্টু নামে এক ইউপি সদস্যকে হত্যামামলায় গ্রেফতার করে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে রাতভর পুলিশ লাইনস’র সামনে দেন দরবার করার খবর পাওয়া গেছে। এ ঘটনার প্রতিবাদে ওসি শাহজাহানের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের সমর্থকরা বিক্ষোভ মিছিল করে মহেশপুরের সংসদ সদস্য নবী নেওয়াজের বাড়ি ঘেরাও করেন। কোটচাঁদপুর থানার বর্তমান ওসিসহ কয়েক জনের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগে আদালতে নালিশি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
এদিকে কর্মস্থলে সরকারি কর্মকর্তারা নাজেহাল হচ্ছেন। ইতোমধ্যে ঝিনাইদহের চারজন নির্বাহী প্রকৌশলী মারধর খেয়েছেন। দুজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজেহাল হয়েছেন। একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট উপজেলা নির্বাচনের জের ধরে রোষানলে পড়েন। উপজেলা পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের প্রতিনিয়ত বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখিন হতে হচ্ছে। মাঠ প্রশাসনে এ নিয়ে ক্ষোভ ধুমায়িত হচ্ছে। অভিজ্ঞ মহলের ধারণা প্রভাবশালী মহলের অনৈতিক চাপ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দুর্বল করে তুলছে। এতে করে পুলিশের সাফল্য হারিয়ে যাচ্ছে এবং বেসামাল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।