স্টাফ রিপোর্টার:ফেনীউপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হক হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে অভিযুক্তজাহিদ চৌধুরীকে গতকাল রোববার সন্ধ্যায় বারাহীপুর এলাকায় গ্রেফতার করা হয়েছে। অপরদিকে খুনের চাঞ্চল্যকর বহু তথ্য বেরিয়ে আসছে ক্রমশ।
ফেনী উপজেলাচেয়ারম্যান একরামুল হক একরামকে হত্যার পরিকল্পনা তিন স্তরে সাজানো হয়েছিলো।প্রতি স্তরেই ছিলো কঠোর নজরদারি। নজরদারির দায়িত্বে ছিলেন প্রভাবশালী একরাজনৈতিক নেতার অস্ত্র ও কিলিং স্কোয়াডের প্রধান জেলা আওয়ামী লীগের নেতাজাহাঙ্গীর মোহাম্মদ আদেল। ১৯ মে রাতে জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ আদেলেরপেট্রোবাংলা রোডের বাসায় বসে প্রভাবশালীর ঘনিষ্ঠ ৬ জন সহযোগী কিলিং মিশনেরছক কাটেন। এ সময় প্রভাবশালী ওই নেতা কৌশলগত কারণে ঢাকায় অবস্থান করে ৬সহযোগীর সাথে টেলিকনফারেন্সে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেন। গত তিন দিনেগ্রেফতারকৃত ১৩ কিলার পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য জানিয়েছে।এ বৈঠকেউপস্থিত ছিলেন ফেনী পৌরসভার ৫নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবদুল্লাহ হেল শিবলু, আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদ চৌধুরী ওরফে জিহাদ, নিজাম হাজারীর অস্ত্রভাণ্ডারেরনিয়ন্ত্রক মামুন, জেলা আওয়ামী লীগের নেতা জিয়াউল আলম মিস্টার, এমপিরঅস্ত্রধারী দেহরক্ষী রাশেদ ও গানম্যান খোকন। জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ আদেলমধ্যরাত পর্যন্ত এদের নিয়ে বৈঠক শেষে দক্ষ প্রকৌশলীর মতো কিলিং মিশনেরমানচিত্র আঁকেন। জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ আদেলের হাতে আঁকা এ মানচিত্রটি উদ্ধারওকরা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশের একটি সূত্র।
সূত্র জানায়, পরিকল্পনাঅনুযায়ী ২০ মে সকাল ৮টায় কিলাররা একে একে ফেনীর সালাম কমিউনিটি সেন্টারেউপস্থিত হয়। এখানেই তাদের মধ্যে দায়িত্ব বণ্টন ও অস্ত্রের মহড়া অনুষ্ঠিতহয়। অস্ত্র মহড়ার প্রশিক্ষক ছিলেন ফেনী পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরআবদুল্লাহ হেল বাকি ওরফে শিবলু কমিশনার। কিলিং মিশন সফল করতে প্রয়োজনীয়অস্ত্রের জোগান দেন ফুলগাজী উপজেলার আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদ চৌধুরী ওরফেজিহাদ। কিলিং মিশন শুরুর আগে নিহত একরামুল হকের বাড়ি থেকে ফেনী ডায়াবেটিকহাসপাতাল ও ফেনী রেলগেট এলাকা পর্যন্ত তার গতিবিধি তদারকির দায়িত্বে ছিলেনএকরামুল হকের দীর্ঘদিনের সঙ্গী আনন্দপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণসম্পাদক বেলাল মেম্বার।
গ্রেফতারকৃতরা জানিয়েছে, আওয়ামী লীগ নেতাজাহাঙ্গীর মোহাম্মদ আদেল কিলিং শুরুর আগে একটি মোটরসাইকেলে করে নিজেইদায়িত্বপ্রাপ্তদের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করেন। এরপর তিনি ফেনী পৌরসভায় নিজঅফিসে মিশন সফল হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকেন। এ সময় তিনি তার অন্যতম সহযোগীবেলাল মেম্বারের সাথে দফায় দফায় ফোনে কথা বলেছেন। আওয়ামী লীগ নেতা জিয়াউলআলম মিস্টার, মামুন ও জাহিদ চৌধুরী ঘটনাস্থলের পাশেই অবস্থান নিয়ে জুনিয়রকিলারদের রাস্তায় অবস্থান নিশ্চিত করেন এবং উৎসাহ জোগান।
আদেল ওমিস্টারের উত্থান যেভাবে: সূত্র জানায়, জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ আদেল বাংলাদেশছাত্রলীগে যোগ দেন আশির দশকে। এরপর ১৯৮৫ সালে ফেনী জেলা ছাত্রলীগের সভাপতিহন। ছাত্রলীগের নেতা থাকা অবস্থায় তার খ্যাতি জোটে ‘কূটবুদ্ধি’র জোগানদাতাহিসেবে। এক পর্যায়ে তাকে ছাত্রলীগের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হলে তিনিজয়নাল হাজারীর সাথে ঘনিষ্ঠতা তৈরি করেন। ফেনীর বিভিন্ন খুন ও গুমেরপরিকল্পনাকারী হিসেবে ধরা হয় তাকে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ শাসনামলে দলেঅবস্থান পাকাপোক্ত করে না দেয়ায় জয়নাল হাজারীর ওপর ক্ষুব্ধ হন আদেল। ২০০১সালে জয়নাল হাজারী দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ আদেলওআত্মগোপনে চলে যান। ২০০২ সালে জয়নাল হাজারীর কুখ্যাত ক্লাস কমিটিরক্যাপ্টেন আজাহারুল হক আরজু, শাহজাহান সাজু, শাখাওয়াত হোসেন, করিম উল্লাহবিকমের সাথে জাহাঙ্গীর আদেলও কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার হন। দীর্ঘদিন জেলেথাকার সময় জয়নাল হাজারী তাদের কোনো খোঁজ না নেয়ায় নিহত উপজেলা চেয়ারম্যানএকরামুল হক ফেনী-২ আসনের এমপি নিজাম উদ্দিন হাজারীকে নিয়ে আলাদা গ্রুপ তৈরিকরেন তিনি। এই গ্রুপটি চট্টগ্রাম থেকে জামায়াত-শিবিরের অস্ত্রধারী শীর্ষক্যাডারদের ভাড়ায় এনে জয়নাল হাজারীর ক্যাডারদের বিরুদ্ধে অভিযানে নামে।ফেনীর তৎকালীন ডিসি আবদুল কুদ্দুস খান ও ওসি আমিনুল ইসলামের সহযোগিতায়জয়নাল হাজারীর ক্যাডারদের গণহারে গ্রেফতার করে জেলে ঢোকানো হয়। অনেকে এলাকাছেড়ে পালিয়ে যান। এক পর্যায়ে আতঙ্ক ছড়াতে জয়নাল হাজারীর বাড়ি শৈলকুটিরে তিনদফা হামলা চালায় আদেলের গ্রুপ। এর ফলে জয়নাল হাজারী শিবিরের আতঙ্কে ছড়িয়েপড়ে। এই আতঙ্ককে পুঁজি করে একরাম-নিজাম-আদেল সিন্ডিকেট ফেনীতে শক্ত অবস্থানতৈরি করে। ২০০৯ সালে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পরএকরাম-নিজাম-আদেল সিন্ডিকেট জেলাজুড়ে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, বালুমহালনিয়ন্ত্রণ, বিদ্যুত-গ্যাস সংযোগ ও ট্রাক-বাস টার্মিনাল নিয়ন্ত্রণে নিয়েব্যাপক চাঁদাবাজি শুরু করে। চাঁদাবাজির ভাগবাটোয়ারা নিয়ে সিন্ডিকেটের মধ্যেফাটল ধরলে উপজেলা চেয়ারম্যান একরাম সিন্ডিকেট থেকে বেরিয়ে যান। এরপর থেকেএকরাম ও আদেল-নিজামের সিন্ডিকেটের মধ্যে শুরু হয় ঠাণ্ডা লড়াই। ২০১০ সালেনিজাম উদ্দিন হাজারী নতুন করে ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য পদ নেন। মাত্রঅল্প কিছুদিনের মধ্যেই জয়নাল হাজারীশূন্য ফেনী আওয়ামী লীগে অন্যতম প্রধাননেতায় পরিণত হন নিজাম উদ্দিন হাজারী। ২০১২ সালে তিনি নিজেকে ফেনী আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক বলে প্রচার করেন। তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী জাহাঙ্গীরমোহাম্মদ আদেল ফেনী শহরে অস্ত্র ও চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে জেলার ডন হিসেবেপরিচিতি পান এবং বিশাল এক ক্যাডার বাহিনী তৈরি করেন। তার ক্যাডারদের মধ্যেঅন্যতম হলো- ফেনী পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর কৌহিনুর আলম, আবদুল্লাহ হিলমাহমুদ শিবলু, শীর্ষ সন্ত্রাসী নুরুল আলম ওরফে দাদা ভাই, জিয়াউল আলমমিস্টার, মামুন, আনোয়ার, জানে আলম, নরুল আফছার আপন, কুখ্যাত সন্ত্রাসী রুটিসোহেল ও শহিদান। আদেলের নেতৃত্বে ফেনীর বিভিন্ন টার্মিনাল থেকে চাঁদা আদায়ও টেন্ডারবাজির কমিশন নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে আছেন স্বপন মিয়াজী, মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ফেনী শাখার কর্মকর্তা সেন্টু, শুসেন চন্দ শীল, বাহারউদ্দিন বাহার, সোনাগাজীর ভুট্টুসহ আরও অনেকে। এমপি নিজাম উদ্দীন হাজারীরঅস্ত্র ও মাদকভাণ্ডার নিয়ন্ত্রক জিয়াউল আলম মিস্টার। ২০০৮ সালে মহাজোটসরকার ক্ষমতায় আসার পর নিজাম-একরাম-আদেল সিন্ডিকেটে যোগ দেন জিয়াউল আলমওরফে মিস্টার। চাঞ্চল্যকর উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হককে হত্যার আগে তারগতিবিধি পর্যবেক্ষণ ও কিলিং মিশনের নেতৃত্ব দেন জিয়াউল আলম মিস্টার। এ কাজেতার সঙ্গী হিসেবে রাখেন মামুন, জনি, রুটি সোহেল, আনোয়ার ও সোনাগাজীরভুট্টোকে। মাদক ব্যবসার অভিযোগও আছে মিস্টারের বিরুদ্ধে। ফেনীর ৮টি স্থানেমাদকের পাইকারি বাজার গড়ে তুলেছেন তিনি। মাদক ব্যবসার সূত্রে কয়েক বছরেরব্যবধানে তিনি নিজেকে কোটিপতির কাতারে নিয়ে গেছেন।
ওসির রুমে ঘুমালেনশিবলু: শনিবার রাতে গ্রেফতার হওয়ার পর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবদুল্লাহ হেলমাহমুদ শিবলুকে নিয়ে নানা ধরনের নাটক করেছে পুলিশ। প্রথমে তাকে হাতকড়া নাপরিয়ে ওসির কক্ষে চেয়ারে বসিয়ে রাখা হয়। ঘনিষ্ঠ বন্ধু হওয়ার কারণে শিবলুররাতের খাবারের জন্য সদর থানার সেকেন্ড অফিসার এসআই আলমগীর ব্যস্ত হয়েছোটাছুটি করেন। রাত ১২টায় ওসির কক্ষে নতুন ফ্যান লাগানো হয়। এরপর সকাল ৮টায়শহরের ‘ফাইভ স্টার’ নামের হোটেল থেকে নাস্তা আসে। শিবলুর বাড়ি থেকে ফলমূল ওউন্নত খাবার নিয়ে যায় পুলিশ। কিন্তু এসবই হয় গোপনে। সাংবাদিকের থানায়যাওয়া ছিলো নিষিদ্ধ।
আদেলের বক্তব্য: একরাম হত্যার সাথে জড়িত ওসন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ফেনী জেলা আওয়ামী লীগেরযুগ্ম সম্পাদক জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ আদেল রোববার বলেন, ঘটনার সময়তিনি ফেনীতে ছিলেন না। তাই হত্যাকাণ্ডের সাথে তার জড়িত থাকার প্রশ্নই আসেনা। তিনি বলেন, একরাম হত্যায় জামায়াত-শিবিরের লোক জড়িত। জামায়াত-শিবিরেরলোকজনই এখন উদ্দেশ্যমূলকভাবে তাকেসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের ঘটনার সাথে জড়াতেচাইছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ হত্যাকাণ্ডের সাথে এমপি নিজামউদ্দিন হাজারীকে জড়িয়ে বক্তব্য দিয়ে জয়নাল হাজারী পানি ঘোলা করছেন। জয়নালহাজারী এ হত্যাকাণ্ডের প্রধান নায়ক দাবি করে তিনি বলেন, হাজারী অনেক লোককেহত্যা করেছে। তার কারণে আওয়ামী লীগ বিতর্কিত হয়েছে। এমনকি আওয়ামী লীগসভানেত্রীও বিতর্কিত হয়েছেন।নিজাম হাজারীর নেতৃত্বে ফেনীতে যখন সুন্দরএকটি রাজনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তখন জয়নাল হাজারী পরিস্থিতি জটিল করেতুলছেন।
ফেনীউপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হক হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে অভিযুক্তজাহিদ চৌধুরীকে রোববার সন্ধ্যায় বারাহীপুর এলাকায় গ্রেফতার করা হয়েছে।গ্রেফতারের পর তাকে থানা হাজতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। গত শনিবার র্যাবেরব্রিফিঙে বলা হয়েছিলো আটক আসামিদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে একরামুল হককে হত্যারপরিকল্পনা করেন জাহিদ চৌধুরী।
এদিকে একরাম হত্যা মামলায় গ্রেফতারকৃত ১৩জনকে বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডে নেয়ার অনুমতি দিয়েছেন আদালত। রোববার মামলারতদন্ত কর্মকর্তা ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করলে ফেনী জেলার মুখ্যবিচারিক হাকিম খায়রুল আমিন ৮ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
আদালত সূত্রজানিয়েছে, ঢাকায় র্যাবের হাতে গ্রেফতারকৃত ৮ জন ও ফেনী পুলিশের হাতেগ্রেফতার একজনসহ মোট ৯ জনকে ৮ দিনের এবং ঘটনার পরপরই গ্রেফতারকৃত চারজনকে ৫দিনের রিমান্ডের আদেশ দেয়া হয়। পুলিশ জানিয়েছে, গ্রেফতারকৃতরা প্রাথমিকজিজ্ঞাসাবাদে আওয়ামী লীগের দু নেতার নাম বলেছে। আরও তথ্যের জন্য রিমান্ডেনিয়ে তাদের ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
ফুলগাজীতে হরতাল আহ্বান পরেপ্রত্যাহার: এদিকে একরাম চেয়ারম্যান হত্যার প্রতিবাদে সোমবার ফুলগাজীউপজেলায় সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকে রাতে প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয় ফুলগাজীউপজেলা আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠন। সকালে উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নিহতএকরামের চাচাতো ভাই উপজেলা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক এ হরতালের ডাক দিলে উপজেলাআওয়ামী লীগ ও যুবলীগ সমর্থন জানায়।