দেরিতে হলেও দেশজুড়ে শুদ্ধি অভিযানে নামছে আওয়ামী লীগ

বুধবার কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের বৈঠকে আসতে পারে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত

 

স্টাফ রিপোর্টার: অবশেষে ঘুম ভাঙছে শাসক দল আওয়ামী লীগের! দীর্ঘদিন পরে হলেও সারাদেশেসাংগঠনিক শুদ্ধি অভিযানে নামছে দলটি। দিবস বৃত্তেঘুরপাক খাওয়া আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক স্থবিরতা কাটাতে দ্রুতোই কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্তধারাবাহিক সম্মেলনের মাধ্যমে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটিগুলো পুনর্গঠন, যোগ্য-ত্যাগী উজ্জ্বল ভাবমূর্তির তরুণ নেতৃত্ব গঠন, সহযোগী সংগঠনগুলোচাঙ্গা এবং চৌদ্দদলীয় জোট সক্রিয় ও অধিক কার্যকর করার সিদ্ধান্ত নিয়ে মাঠেনামার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটির নীতিনির্ধারকরা।

জানা গেছে, আগামী বুধবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠেয়দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকেইসারাদেশে মেয়াদোত্তীর্ণ সকল জেলা ও মহানগর কমিটি, সকল সহযোগী সংগঠন এবংকোন্দল-দ্বন্দ্ব ও ভারপ্রাপ্তের ভারে ন্যুব্জ জেলা কমিটিগুলোর সম্মেলন এবংদলে শুদ্ধি অভিযান পরিচালনার দিনক্ষণ ও পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হবে। আর এবৈঠকেই সারাদেশের সাংগঠনিক অবস্থার পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট জমা দেয়ার জন্যইতোমধ্যে দলের কেন্দ্রীয় সাত বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদককে নির্দেশও দেয়াহয়েছে।

তৃণমূলের সম্মেলনের প্রস্তুতি সম্পর্কে যোগাযোগ করা হলে আওয়ামী লীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, সম্মেলনের মাধ্যমেমেয়াদোত্তীর্ণ কমিটিগুলো পুনর্গঠনের প্রস্তুতি আমাদের রয়েছে। সর্বশেষ দশমজাতীয় নির্বাচন এবং তার আগে বিএনপি-জামায়াত জোটের ভয়াল সহিংসতা ওধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের কারণে আমরা ১৪ জেলার বেশি সম্মেলন করতে পারিনি। এবারক্ষমতায় আসার পর উপজেলা নির্বাচনের কারণে সম্মেলন বন্ধ রয়েছে। এখন পরিবেশঅনুকূলে থাকায় বুধবারের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে আলোচনা করে দ্রুতোই সারাদেশেসম্মেলনের মাধ্যমে মেয়াদোত্তীর্ণ জেলা-মহানগর ও উপজেলা কমিটিগুলো পুনর্গঠনকরা হবে।

এতোদিন শুধু দিবসের বৃত্তে ঘুরপাক খেয়েছে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কর্মসূচি।ক্ষমতার পাঁচ বছর ধরে খুঁড়িয়েই চলেছে স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারীসর্ববৃহৎ এ রাজনৈতিক দলটি। বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটির মেয়াদও আর বেশিদিননেই। দুবারের চমকের কেন্দ্রীয় কমিটি তৃণমূল পর্যায়ে সাংগঠনিক পরিচালনা করাতো দূরের কথা, বছরের পর বছর মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি দিয়ে সারাদেশের সবসাংগঠনিক কমিটি চললেও সেদিকে কোনোই নজর ছিলো না দলটির কেন্দ্রীয় নেতাদের।সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও সর্বশেষ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও শুধু দলীয়বিভেদের কারণে বিপুলসংখ্যক দলীয় প্রার্থীর ভরাডুবি ঘটলেও তবুও ঘুম ভাঙেনিতাদের। কেন্দ্রীয় অমনোযোগিতার কারণে কেন্দ্র থেকে প্রান্ত-সর্বত্রসাংগঠনিক বিশৃঙ্খলায় দলটির কর্মকান্ডে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।

সর্বশেষ নারায়ণগঞ্জের ঘটনায় টনক নড়েছে ক্ষমতাসীন দলটির। অভ্যন্তরীণকোন্দল-বিভেদের জের ধরে নিজ দলেরই সাত সমর্থকের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়সারাদেশেই তোলপাড়ের সৃষ্টি করেছে। দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতার আসার মাত্র সাড়েচার মাসের মাথায় বড় ধরনের চাপে পড়তে হয়েছে বর্তমান সরকারকে। এ ইস্যুকেকেন্দ্র করে একদিকে বিরোধী দলের কৌশলী অপপ্রচার, অন্যদিকে নিজ দলেরইবিবদমান দু গ্রুপ শামীম ওসমান ও সেলিনা হায়াৎ আইভীরপরস্পরবিরোধী কাদাছোড়াছুড়িতে উল্টো চরম অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়তে হয়েছে সরকারেরনীতিনির্ধারকদের।
আওয়ামী লীগ ও সরকারের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জের ঘটনাসহসারাদেশে দলের সাংগঠনিক বিশৃঙ্খলায় চরম ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করেছেনপ্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত পাঁচ বছরে অসংখ্যবার সিদ্ধান্ত হওয়ার পরওতৃণমূল সম্মেলন করতে না পারায় সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতাদেরভর্ৎসনা করেছেন তিনি।

গত কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকেও সারাদেশে উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীরপরাজয়ের কারণ, কোন্দল-দ্বন্দ্বে জড়িত নেতাদের চিহ্নিত করে পূর্ণাঙ্গসাংগঠনিক রিপোর্ট প্রস্তুত করার জন্য প্রধানমন্ত্রী সাত বিভাগীয় সাংগঠনিকসম্পাদকদের নির্দেশ দেন। বুধবারের বৈঠকে রিপোর্ট জমা দেবেন সাংগঠনিকসম্পাদকরা। এতে অনেক বড় বড় নেতা-মন্ত্রী-এমপিরা ফেঁসে যেতে পারেন।

নীতিনির্ধারক সূত্রগুলো বলছে, আগামী ৬ মাসের সময় বেঁধে দিয়ে দলেরসর্বস্তরের ধারাবাহিক সম্মেলনের মাধ্যমে দল ঢেলে সাজার প্রাক-প্রস্তুতিচলছে। মূল কর্মকাণ্ড শুরু হবে আগামী মাস থেকেই। আর রমজান জুড়ে চলবে সংগঠনকেঢেলে সাজার কাজ। কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে দিনক্ষণ চূড়ান্ত হওয়ার পরপরইসারাদেশের সাংগঠনিক জেলাগুলোর সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে স্ব স্ব এলাকায়সম্মেলনের প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুলইসলাম চিঠি পাঠাবেন। ইতোমধ্যে দলের কয়েক কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদককে ডেকেসারাদেশে সাংগঠনিক সফরের প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে হাইকমান্ডথেকে। নির্দেশনা অনুযায়ী সাত বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকরা এ ব্যাপারেপ্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও চূড়ান্ত করছেন।

সম্মেলন কেন হচ্ছে না তার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে দায়িত্বপ্রাপ্ত একাধিককেন্দ্রীয় নেতা জানান, দল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়, এজন্য জেলা, উপজেলা কিংবামহানগর নেতারা কেউ-ই পদ ছাড়তে চান না। সম্মেলন হলে পদ-পদবি হারানোর ভয়রয়েছে, আর পদে না থাকলে ক্ষমতার স্বাদ থেকে বঞ্চিত হবেন- এমন আশঙ্কা থেকেইবার বার তাগিদ দেয়া সত্ত্বেও জেলার নেতারা নানা অজুহাত দেখিয়ে সম্মেলনকরছেন না। সহযোগী সংগঠনগুলোরও হয়েছে একই অবস্থা। দ্রুত সম্মেলনের মাধ্যমেকমিটিগুলো পুনর্গঠন করা না হলে দলের ত্যাগী ও তরুণ উজ্জীবিত নেতাদের ধরেরাখাই কঠিন হবে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ক্ষমতার পাঁচ বছরে দলের চেয়ে মন্ত্রী-এমপি-নেতাদেরব্যবসা-বাণিজ্যসহ সরকারী কর্মকাণ্ডেই অধিক ব্যস্ত থাকা, দীর্ঘদিন এলাকায় নাযাওয়া, নিজস্ব বাহিনী তৈরি করা, দলীয় নেতাকর্মীদের উপেক্ষা করে এলাকায়পরিবার-পরিজনদের নিয়ে আধিপত্য বিস্তার, স্থানীয় নেতাকর্মী থেকে বিচ্ছিন্নহওয়া এবং তৃণমূলে নিজেদের পছন্দের ব্যক্তিদের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানোরচেষ্টা প্রভৃতি কারণে সারাদেশেই আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক অবস্থা নাজুকঅবস্থায় গিয়ে পৌঁছেছে।
অধিকাংশ স্থানেই আওয়ামী লীগের শত্রু এখন আওয়ামী লীগ। নারায়ণগঞ্জের মতোসর্বত্র গৃহদাহ চললেও সেদিকে মোটেও নজর দেয়নি কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। পাঁচবছরের প্রতিটি স্থানীয় নির্বাচনে ঘরের শত্রু বিভীষণ- এ প্রবাদটি স্পষ্টহলেও তা নিরসন করতেও ব্যর্থ হয়েছে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। বরং ক্ষমতার মেয়াদেদুটি কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে নেতৃত্বের চমক সৃষ্টি ছাড়া সংগঠনকেশক্তিশালী করার ক্ষেত্রে কোনো চমকই দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে আওয়ামী লীগেরকেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ।

আর এসব কারণেই গত ৫ জানুয়ারি নির্বাচন পূর্ববর্তী ও পরবর্তী বিএনপি-জামায়াতজোটের ভয়াল নাশকতায় একমাত্র ঢাকা মহানগর ছাড়া আর কোথাও ন্যূনতম রাজনৈতিকপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি আওয়ামী লীগ। বরং অনেক স্থানেই রাজনৈতিকমোকাবেলার পরিবর্তে অসহায় নেতাকর্মী ও সমর্থকদের অসহায় অবস্থায় ফেলে রেখেইএলাকা ছেড়ে অনেক জেলা-মহানগর নেতা পালিয়ে থাকারও কয়েকটি উদাহরণ রয়েছে।দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর এ সব ব্যর্থ নেতাদের চিহ্নিত করে কোনোব্যবস্থা নিতেও পারেনি আওয়ামী লীগের বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটি।

সূত্র জানায়, দলীয়ভাবে এবং বিভিন্ন সরকারি গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমেসারাদেশে আওয়ামী লীগের প্রকৃত সাংগঠনিক অবস্থার সার্বিক চিত্র সংগ্রহকরেছেন দলটির প্রধান শেখ হাসিনা। তবে এবার দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণকারী কিংবাদলের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টিকারী কাউকেই ক্ষমা করবেন না তিনি।
নারায়ণগঞ্জের উদাহরণ তুলে ধরে দলটির দুইজন নীতিনির্ধারক নেতার মতে, এবারেরশুদ্ধি অভিযানে অতীত নানা কুকর্ম কিংবা দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নকারী অনেকনেতারই কপাল পুড়বে। তালিকায় থাকা তৃণমূলের স্বচ্ছ-ত্যাগী ও উজ্জ্বলভাবমূর্তি থাকা নেতাদের বাছাই করে তাদের জেলা-উপজেলা-মহানগরের গুরুত্বপূর্ণপদে আনা হবে। বিশেষ করে সারাদেশেই উদ্যমী-উচ্চ শিক্ষিত ও সাহসী তরুণনেতাদের আনা হবে জেলা-মহানগর কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদে। সর্বোচ্চ কঠোরঅবস্থানে থেকে এবার সম্মেলনের মাধ্যমে সারাদেশেই দলকে ঢেলে সাজা হবে বলেইজানিয়েছেন তারা।

এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির ভারপ্রাপ্ত দফতরসম্পাদকের দায়িত্বে থাকা প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ড. আবদুস সোবহানগোলাপ জানান, আগামী বুধবার সন্ধ্যা ৭টায় গণভবনে আওয়ামী লীগকেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠক হবে। এতে সভাপতিত্ব করবেনপ্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৈঠকে ৭ জুন ঐতিহাসিক ছয় দফা দিবস, ২৩ জুনআওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচি চূড়ান্ত করা ছাড়াও সাংগঠনিকবিষয়ে আলোচনায় বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আসতে পারে।