স্বপ্ন পূরণের সিঁড়িতে মেহেরপুরের প্রতিবন্ধী আওয়াল হোসেন

 

ইচ্ছাশক্তিতে লক্ষ্যে পৌঁছানো যায়

মহাসিন আলী: সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে অনেকে। ধরে রাখতে পারে ক’জন?এর উত্তর- দৃঢ় মনোবল আর প্রচেষ্টা আছে যার; সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে। হোক সে সুস্থ কিংবা প্রতিবন্ধী। মেহেরপুর পল্লীর এমন এক প্রতিবন্ধী যুবক যে স্বপ্ন পূরণের সিঁড়ি বেয়ে ওপরের দিকে উঠে চলেছেন। লক্ষ্য পূরণ করেই তিনি খ্যান্ত হবেন। এমন প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন তিনি।

মেহেরপুর জেলা সদরের বুড়িপোতা ইউনিয়নের রাঁধাকান্তপুর গ্রামের আলী হোসেনের ৪ ছেলে-মেয়ের মধ্যে একমাত্র ছেলে আওয়াল হোসেন প্রতিবন্ধী। জন্মগত প্রতিবন্ধী নয় আওয়াল হোসেন। একমাত্র সন্তান অনেক বড় হবে এমন প্রত্যাশা ছিলো পিতা আলী হোসেনের। কিন্তু বিধি বাম। মাত্র ৩ বছর বয়সে একমাত্র পুত্র আওয়াল হোসেনের পোলিও হয়। চিকিৎসা করেও লাভ হয়নি। পা দুটি নষ্ট হয়ে যায় তার। শিশু আওয়াল হোসেনের হাঁটা-চলা বন্ধ হয়ে যায়। অন্যের ওপর ভর করে চলতে হয় তাকে। তাই বলে পিতার স্বপ্ন ভেঙে যায়নি। তিনি প্রতিবন্ধী ছেলেকে ভিক্ষুক বানাতে রাজি নন। পিতা হোসেন আলী স্বপ্নের বীজবপন করতে থাকলেন প্রতিবন্ধী শিশু আওয়াল হোসেনের মধ্যে। প্রতিবন্ধী আওয়াল হোসেন এখন ২০ বছরের যুবক। মেহেরপুর সরকারি কলেজে দর্শনে আনার্সসহ স্নাতক পড়ছেন তিনি। নিজের ভবিষ্যতের জন্য পিতার স্বপ্ন পূরণের সিঁড়ি বেয়ে এগিয়ে চলেছেন সামনের দিকে।

এক সকালে প্রতিবন্ধী আওয়াল হোসেনের সাথে সাক্ষাৎ হয়। তিনি বিশ্ববাসীকে জানাতে চান- সাহস আর সহযোগিতা পেলে ভিক্ষুক নয়; প্রতিবন্ধীরাও সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের মতো মানুষ হতে পারেন। প্রতিবন্ধীরাও দেখতে পারেন সুন্দর স্বপ্ন আর গড়তে পারেন সুন্দর ভবিষ্যত।

আওয়াল হোসেন তার নিজের কথা বলতে গিয়ে জানালেন, মাত্র ৩ বছর বয়সে পোলিও তাকে প্রতিবন্ধী করেছে। পায়ে ভর দিয়ে চলা বন্ধ হয়েছে তার। কিন্তু পোলিও মনের বল কমাতে পারেনি তার। ছোট থেকে লেখা-পড়ার প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিলো তার। তাই পিতা-মাতার ইচ্ছাতে আওয়াল হোসেনকে দাদা তেলাবত শেখ কোলে করে গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রেখে আসতেন। ছুটির পরে মা আন্তানুর খাতুন বিদ্যালয় থেকে তাকে বাড়ি নিয়ে আসতেন। দাদা আর বেঁচে নেই। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় পাশের পর পার্শ্ববর্তী আরআর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয় আওয়াল হোসেনকে। ওই সময় থেকে তাকে ক্র্যাচে ভর করে বিদ্যালয়ে যেত হতো। কৃতীত্বের সাথে ওই বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং মেহেরপুর পৌর ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন আওয়াল হোসেন। পৌর ডিগ্রি কলেজে ভর্তি হয়ে ক্র্যাচের সাথে তার চলার সাথী হিসেবে যুক্ত হয় ৩ চাকার হুইলার। এখন তিনি মেহেরপুর সরকারি কলেজে ভর্তি হয়েছেন। দর্শনে অনার্স পড়ছেন আওয়াল হোসেন। কোনো সরকারি অফিসের কর্মকর্তা কিংবা সরকারি কলেজের প্রভাষক হওয়ার স্বপ্ন তার।

লেখা-পড়ার পাশাপাশি আর কিছু তিনি করেন কি-না জানতে চাইলে বলেন, স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করছি। প্রতিবন্ধী বলে পিতা-মাতার ঘাড়ে চেপে বসতে হবে এমন ছেলে নই আমি। অবসর সময়ে নিজের বাসায় বসে বেশ কিছু ছেলেকে প্রাইভেট পড়ায়। মাসে বেশ কিছু টাকা আসে। এতেই আমার পড়ার খরচ চলে যায়। শুধু তাই নয়। স্বপ্ন পূরণ করতে শুধু ক্লাসের পড়া নয়। অনেক জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। প্রাইভেট পড়ানোর মধ্যদিয়ে আমার জ্ঞানভাণ্ডার শক্তিশালী হচ্ছে। ভবিষ্যতের স্বপ্ন পূরণে এটাও কাজে আসবে। তিনি আরো বলেন, প্রতিবন্ধীদের অধিকার আদায়ে সেভ দ্যা প্লানেট অ্যান্ড ডিসেবিলিটি’র (এসপিডি) সাথে যুক্ত হয়েছি। বর্তমানে এসপিডি’র পি.এইচ.আর.পি.বি.ডি প্রকল্পে কাজ করি। বেতন নয়; সেখান থেকে তিনি টি.এ/ডি.এ পেয়ে থাকেন মাত্র।

পিতার সহায় সম্পদের কথা জানতে চাইলে আওয়াল হোসেন জানান, মাঠে বাবার অল্প পরিমাণ জমি আছে। তাতেই তিনি আবাদ করেন। মাঝে মাঝে অন্যের জমিতেও কাজ করেন। প্রতিবন্ধী ভাতা পান কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, সমাজসেবা থেকে ৩/৪ মাস অন্তর মাসিক তিনশ টাকা করে ভাতা পান।

তিনি প্রতিবন্ধীদের উদ্দেশে বললেন, ইচ্ছা শক্তিতে লক্ষ্যে পৌঁছানো যায়। ছাড়ুন ভিক্ষাবৃত্তি। আসুন অন্যের সহযোগিতা নিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াই। সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচি।

Leave a comment