তাছির আহমেদ: আ-তে আমটি আমি খাবো পেড়ে, সর্বপ্রথম আব্বা সুরেসুরে পরিচয় করে দিয়েছিলেন আদর্শলিপি বইতে। তারপর ছড়ায় ছড়ায়- আমপাতা জোড়া জোড়া, মারবো চাবুক চড়বো ঘোড়া। প্রাইমারি স্কুলের মাঠে দাঁড়িয়ে ‘ওমা ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে..। খনার বচনে- আমে ধান, তেঁতুলে বান। ছোট্ট ছোট্ট স্মৃতির অংশে, ছুটির দিনে মামার বাড়ি আম কুড়াতে সুখ। ঝড়ের দিনে আম পড়ার শব্দ টুকটুক। ছেলেবেলার আকণ্ঠ চঞ্চলতায় এ এক বিস্ময়কর রকম নেশায় মত্ত থাকতে হতো বোশেখ জ্যৈষ্ঠ মাসে। বসন্ত শেষে যখন আমের মুকুল বা বোল হতো তখন থেকেই কার বাড়ির গাছে বেশি বোল, কোন গাছে ধরবে এবার বেশি আম। কালবোশেখের ঝড়ে কার কোন গাছের বোল বেশি পড়লো। এ নিয়ে ছিলো নানা হা-পিত্যেশ। ঝড়ের দিনের কুড়িয়ে পাওয়া আম খুব বেশি খাওয়া না হলেও বেশি আম কুড়াতে পেরেছি ওইটুকুই আনন্দ। তৃপ্তি। স্কুলে কাঁচা আম খাওয়ার অদ্ভুত পদ্ধতি, ক্লাসের লম্বা দরোজার ফাঁকে আমটি ঢুকিয়ে দরজার চাপ দিতেই ফেটে চৌভাগ, বন্ধুদের ঠেলেঠুলে এ ভাগের অংশ কুড়িয়ে খাওয়া কি স্বাদ। সেই প্রথম পাঠের চেনা আম স্মৃতির পাতায় এখনো নানা খেলা করে।
এখন আমাদের বাজারে হরেক পদের আম বিকিকিনি হয় কিন্তু ভয় পাই। কারণ আমের যৌবন ধরে রাখতে এই আমব্যবসায়ীরা ব্যবহার করছে জীবনধ্বংসকারী কার্বাইট। তবুও মানে না মন। তাই কবির ভাষায় বলতে হয়, মধু মাসে পাকা আমের মধুর রসে মুখ রঙিন করতে কার না ভালো লাগে। সোহাগী প্রাণ আমকে নিয়ে লোককথায় তাইতো বলা হয়, যতো কুয়ো আমের ক্ষয়, তাল তেঁতুলের কিছু নয়। হনুমানের ছুড়ে দেয়া আমের আঁটি থেকেই নাকি ভারতীয় উপমহাদেশে আমগাছের জন্ম হয়। ইতিহাসের নানা পটপরিবর্তনেও যুক্ত রয়েছে আম। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের প্রতিবাদ সমাবেশ হয়েছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আম্রতলে। ১৯৭১’র ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে গঠিত হয় মুজিবনগর সরকার। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ উদ্দৌল্লার পতন হয় পলাশীর আম্রকাননে। ফলের রাজা আম নিজ যোগ্যতায় স্থান করে নেয় রাষ্ট্রের নথিপত্রে। ২০১০ সালের ১৫ নভেম্বর আমগাছকে জাতীয় বৃক্ষ ঘোষণা করে মন্ত্রিসভা। অন্যদিকে আমের প্রজাতি সংরক্ষণে রাজশাহীতে স্থাপন করা হয়েছে বাংলাদেশ আম গবেষণা কেন্দ্র। আর পৃথিবীতে যতো দেশে আম উৎপাদন হয় তার মধ্যে বাংলাদেশ অবস্থান করছে নবমস্থানে। হরেক রকম আমের জাত আমাদের এদেশে। অতি পরিচিত ফজলি আমের নামকরণ হয় ফজলি বিবির নামে।
আমের রাজধানী চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে উৎপাদিত আমের মধ্যে সেরা হলো ল্যাংড়া, ফজলি, ক্ষীরসাপাতি (গোপালভোগ), হিমসাগর, লক্ষণভোগ, মোহনভোগ, গোপালভোগ, বোম্বাই, রানীপসন্দ, বেগম পসন্দ, বাদশাপসন্দ, বিশ্বনাথ, বউ ভোলানী, ডাব, মনোহরা, আপেল, ময়ুরপঙ্খী, আলফানসো, বাদশাহী, আলমশাহী, বৃন্দাবনী, দিলশাদ, কোহিনুর, কোহেতুর, ওয়াবজান, হায়াত, বড়শাহী, ছোটশাহী, দিলখোশ, ফেরদৌসপসন্দ, সুলতানপসন্দ, বোম্বাই, গোলাবখাস, ক্ষীরসাপাতি, বোম্বাই ক্ষীরসাপাতি, সর ক্ষীরসাপাতি, ছোট ক্ষীরসাপাতি, জাফরান, মোহনভোগ, বিসমনী, ভরত, বিড়া, ভোজ, বৃন্দাবনী, বাবুই ঝাঁকি, বাতাস, চম্পা, চকচকি, চাপাতি, দুধসর, দ্বারিকা, দুধকুমার, দুধভোগ, আক্কেল গরম, ডায়মন্ড, নীলম, দোকশলা, বারোমাসি, কাঁচামিঠে, মিছরিভোগ, মিঠুরা, তোতাপুরী, কপটভাঙ্গা, হাতিঝুল, অরুণা, সুবর্ণরেখা, মিশ্রিদানা, নিলাম্বরী, কারাবাউ, কেউই সাউই, কেন্ট, পাহুতান, ত্রিফলা, কোলোপাহাড়, ফারীয়া, লতা, তোতা ফজলি, চিনি ফজলি, মালদহ, গৌরজিৎ, কিষাণভোগ, কালিভোগ, শিকাভোগ, সীতাভোগ ও চিনিভোগ।
আমের পুষ্টিগুণও অনেক। এতে রয়েছে আঁশ, ভিটামিন, মিনারেল এবং অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট। হজমেও সহায়তা করে এ আম। আম পটাশিয়ামের একটি সমৃদ্ধ উৎস। যা হার্টবিট ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। আমে কোলন, স্তন, প্রোস্টেট ক্যান্সাররোধক গুণ রয়েছে। আমে আছে ভিটামিন-ই, যা যৌনসংশ্লিষ্ট হরমোনকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং যৌনশক্তি বাড়ায়। নারীর ঋতুস্রাবকালীন খাদ্যে আম বেশ উপকারী। আমে আরও রয়েছে উচ্চমাত্রার দ্রবণীয় পথ্য আঁশ, পেকটিন এবং ভিটামিন সি, যা কোলেস্টরলের ক্ষতিকর মাত্রা কমায়।