চলে যাচ্ছি দোস্ত…

স্টাফ রিপোর্টার: সাব্বির হাসান। রাজধানীর আহসান উল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। গত ১২ এপ্রিল শনিবার তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে বন্ধুদের উদ্দেশ্যে লিখেছিলেন, ‘চলে যাচ্ছি দোস্ত! একদম নেটওয়ার্কের বাইরে।’ অত্যন্ত হৃদয় বিদারক কাকতাল এই যে, ফেসবুকে দেয়া সেই স্ট্যাটাসই সাব্বিরের জীবনে সত্য হতে যাচ্ছে বলে সমূহ আশঙ্কা করছেন তার সহপাঠী বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজন।

গত সোমবার কক্সবাজারের সেন্ট মার্টিন ভ্রমণে গিয়ে সাগর সৈকতে গোসলের সময় অন্য আট সহপাঠীর সাথে স্রোতের টানে তিনিও ভেসে যান। পরে স্থানীয়রা চেষ্টা চালিয়ে উদ্ধার করে পাঁচজনকে। আর যে চারজন এখনো নিখোঁজ রয়েছেন সাব্বির তাদের একজন। সাব্বিরের বাসা রাজধানীর মোহাম্মদপুরে। মোহাম্মদপুর হাউজিং সোসাইটির ১৫১ নম্বর বাড়ির দ্বিতীয় তলায় বাসায় বাবা-মায়ের সাথে থাকতেন সাব্বির। পুত্র নিখোঁজের সংবাদে মা সেলিনা আক্তার কেবলই কাঁদছেন। বুকফাটা আহাজারিতে একটাই অভিব্যক্তি-‘আমার ছেলেকে ছবি হতে দেব না। হে আল্লাহ, তুমি আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দাও। আল্লাহ, আমি তোমার কাছে ছেলের জীবন ভিক্ষা চাই।’

সাব্বিরের বাবা হাসানুর রহমান পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব। এলপিআরে রয়েছেন। হাসানুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, সাব্বির খুব ভালো ছবি তুলতে পারতো। দৃক গ্যালারিতে ছবির প্রদর্শনী হয়েছিলো তার। কথা ছিলো বিদেশে বেশ কয়েকটি প্রদর্শনীতে অংশ নেয়ার। মেমোরি মেকারস নামে একটি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিতে আলোকচিত্রগ্রাহক হিসেবে কাজও করতো সে। পুত্র নিখোঁজের ঘটনায় শোকাতুর বাবা বলেন, ‘ভেবেছিলাম আমার চাকরির পর সাব্বির পরিবারের দায়িত্ব নেবে। সবাই মিলে একসঙ্গে বাকিটা জীবন সুখে কাটাব। কিন্তু কী থেকে কী হয়ে গেলো।’ সাব্বিরের মতো এখনো নিখোঁজ শাহরিয়ার ইসলাম নোমান। তার গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলার লক্ষ্মীখোলার বাড়িতে শোকের মাতম চলছে। একমাত্র ছেলে নিখোঁজ হওয়ার খবরে বার বার মূর্ছা যাচ্ছেন বাবা নজরুল ইসলাম, অচেতন অবস্থায় শয্যাশায়ী মা শামসুন নাহার। ভাইকে ফিরে পাওয়ার খবর জানতে টিভির পর্দায় নিস্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে একমাত্র ছোট বোন নুসরাত জাহান নিশি, নাতিকে ফিরে পাওয়ার প্রত্যাশায় আল্লাহর কাছে প্রার্থনার পাশাপাশি নাতির মোবাইলে বার বার ফোন করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন নব্বই বছরের বৃদ্ধা করিমন নেছা।

পরিবারে দু সন্তানের মধ্যে বড় নোমান ছিলো মেধাবী ছাত্র। ৫ম ও ৮ম শ্রেণিতে মেধাতালিকায় বৃত্তিসহ এসএসসি ও এইচএসসি উভয় পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে আহসান উল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার বিজ্ঞানে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। নজরুল ইসলাম বলেন, ‘পরীক্ষা শেষে বাড়িতে আসতে বললেও নোমান বাড়িতে না এসে দাদীকে ধরে মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে সমুদ্র দেখতে যায়। ছেলে বলেছিলো, পরীক্ষা শেষ হয়েছে। ভ্রমণ শেষে একেবারেই বাড়ি ফিরবো।’ হাউ মাউ করে কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ‘তার ফেরা আর হলো না’। মা শামসুন নাহার কতক্ষণ পর পর ছেলের নাম ধরে চিত্কার দিয়ে মূর্ছা যাচ্ছেন। আত্মীয়-স্বজনদের কোনো সান্ত্বনাই তাকে শান্ত করতে যথেষ্ট নয়।

সোমবার নোমানের সাগরে নিখোঁজ হওয়ার সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে আত্মীয়-স্বজন ও এলাকাবাসীর মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে। অসংখ্য লোক এসে তাদের বাড়িতে ভিড় করছে। নিখোঁজ ছাত্রের বাবা, মা, দাদী ও পরিবারের পক্ষ থেকে অন্তত নোমানের লাশটি হলেও খুঁজে বের করে তাদের কাছে ফেরত দেয়ার ব্যবস্থা করতে সরকারের প্রতি দাবি জানান।

Leave a comment