গ্যাসভিত্তিক আট বিদ্যুতকেন্দ্রের ভাগ্য অনিশ্চিত

 

স্টাফ রিপোর্টার: গ্যাস সংকটে বিদ্যমান বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। তাই নতুন করে কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস না দেয়া এবং গ্যাসনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এতে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে গ্যাসভিত্তিক ৮টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভবিষ্যত। সংকটে পড়া বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো হচ্ছে ঘোড়াশালে ৩৬৫ মেগাওয়াট, শাহজীবাজার ৩৩০ মেগাওয়াট, শিকলবাহা ২২৫ মেগাওয়াট, ঘোড়াশাল তৃতীয় ইউনিট ৪১৬ মেগাওয়াট, ঘোড়াশাল ষষ্ঠ ইউনিট ৪০০ মেগাওয়াট, ঘোড়াশাল চতুর্থ ইউনিট ৪০৩ মেগাওয়াট, গাজীপুরে ১৫০ মেগাওয়াট এবং ২০০ মেগাওয়াটের দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র। এর মধ্যে ঘোড়াশালের পুরনো ৩টি কেন্দ্রেও তৃতীয়, চতুর্থ এবং ষষ্ঠ ইউনিটের উৎপাদন বাড়াতে এগুলোকে যৌথ বিদ্যুৎকেন্দ্রে (কম্বাইন্ড সাইকেল) পরিণত করার চেষ্টা চলছে।

জানা গেছে, ৮টি কেন্দ্রের মধ্যে গাজীপুরের দুটিতে ৭০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস প্রয়োজন। গ্যাস থাকলে গ্যাস পাবে, না থাকলে পাবে না_ এমন শর্তে গ্যাস সরবরাহে সম্মতি দিয়েছে পেট্রোবাংলা। বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটির অর্থায়ন এবং জমি অধিগ্রহণ শেষ হয়েছে। কিন্তু গ্যাস সরবরাহের অনিশ্চয়তায় কেন্দ্র দুটি নির্মাণ নিয়ে সংশয় থেকে যাচ্ছে। এদিকে গত একনেক বৈঠকে গ্যাসের অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও ঘোড়াশালে আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ৩৬৫ মেগাওয়াট নতুন কেন্দ্রের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এটিতেও গ্যাস প্রাপ্তি সাপেক্ষে, অর্থাৎ নতুন গ্যাস উত্তোলন হলেই বরাদ্দ- এমন শর্তে সম্মতি দিয়েছে পেট্রোবাংলা। অন্য বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতেও গ্যাস সরবরাহের নিশ্চয়তা নেই।

সম্মিলিতভাবে কেন্দ্রগুলো থেকে ২৪৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হওয়ার কথা। ২০১৮ সালের মধ্যে এই বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করার কথা। এর মধ্যে ৬টি বিদ্যুৎকেন্দ্রই মেগা সাইজের।
গ্যাসের নিশ্চয়তা ছাড়াই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রভাব সম্পর্কে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক মোস্তফা কে মুজেরী জানান, গ্যাসে যদি সরবরাহ বৃদ্ধি করা সম্ভব না হয়, তাহলে বিদ্যমান গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলোতেই গ্যাস দেয়া যাবে না। নতুন কেন্দ্র নির্মাণ করা হলে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। কেননা, হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে কেন্দ্র নির্মাণ করা হলেও জ্বালানি সরবরাহ না পেলে তা থেকে কাঙ্ক্ষিত সুফল পাওয়া যাবে না। বরং তা আরো বেশি দুর্যোগ বয়ে আনবে। আবার বিদ্যুতকেন্দ্রে গ্যাস দিতে গেলে সার উৎপাদন বন্ধ রাখতে হয়। তাছাড়া গৃহস্থালির গ্যাস সরবরাহ বিঘি্নত হবে।

তিনি আরো জানান, গ্যাস উত্তোলন করা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। বিনিয়োগ করলেই যে সাথে সাথে গ্যাস পাওয়া যাবে, তা নয়। অনেক ক্ষেত্রে খনন করে কিছুই পাওয়া যায় না, দশটি করলে একটি বা দুটিতে পাওয়া যায়। তাই বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে বিকল্প জ্বালানির দিকে নজর দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রাথমিক জ্বালানি, বিশেষ করে কয়লার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা উচিত। দেশে প্রচুর কয়লা মজুদ রয়েছে। কিন্তু তা উত্তোলনে যে খুব একটা প্রচেষ্টা নেয়া হচ্ছে, তাও নয়।

জানা গেছে, বিদ্যুতকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ করে পেট্রোবাংলা। কিন্তু সংস্থাটি বলছে, তাদের কাছে পর্যাপ্ত গ্যাসের সংকুলান নেই। তবে যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের সাথে এর আগে গ্যাস সরবরাহ চুক্তি হয়েছে, সেগুলোতে গ্যাস সরবরাহ করা হবে। সম্প্রতি পেট্রোবাংলার কাছে এই ৮টি কেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহের অনুরোধ জানায় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। তবে পেট্রোবাংলা এখনো সেই অনুরোধে সাড়া দেয়নি।

এদিকে নতুন করে আর কোনো গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি না করতে পেট্রোবাংলার পক্ষ থেকে পিডিবিকে অনুরোধ করা হয়েছে। কিন্তু পিডিবি পেট্রোবাংলার অনুরোধ না মেনেই একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি করছে। তাই গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জ্বালানি সঙ্কটে পড়েছে পিডিবি। বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিকল্পনার সময় গ্যাস পাওয়া যাবে কিনা, তা বিবেচনায় না নেয়ায় এই জটিলতা হচ্ছে।
জানা গেছে, সম্প্রতি পেট্রোবাংলার এক বৈঠকে নতুন এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহে তাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করে বলা হয়, গ্যাসের বর্তমান চাহিদা মেটাতেই তারা হিমশিম খাচ্ছে। বর্তমানে গ্যাস সরবরাহের যে ক্ষমতা রয়েছে, তার চেয়ে চাহিদা অনেক বেশি। তাই নতুন গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাস্তবায়নের আগে কর্তৃপক্ষের উচিত পেট্রোবাংলার কাছ থেকে গ্যাস সরবরাহের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া।
এ ব্যাপারে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান হোসেন মনসুর যায়যায়দিনকে জানান, নতুন করে গ্যাসভিত্তিক

বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণ করা হলে তাতে গ্যাস দেয়া অনিশ্চয়তায় পড়বে। সরকার চাইলে বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ করা হতে পারে। তবে তা নতুন গ্যাস প্রাপ্তি ও উত্তোলন সাপেক্ষে। এই হিসাবে পেট্রোবাংলা ঘোড়াশালের ৩৬৫ মেগাওয়াট কেন্দ্রটিতে গ্যাস সরবরাহে সম্মত হয়েছে। কেন্দ্রটি উৎপাদনে গেলে গ্যাস দেয়া হবে।

পেট্রোবাংলার একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, এখনই গ্যাস সরবরাহে ঘাটতি রয়েছে। চলমান কেন্দ্রগুলোতেই পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থায় নতুন বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য গ্যাস দেয়া এক কথায় অসম্ভব। তবুও পিডিবি নতুন বিদ্যুৎ প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিকল্পনা নেয়ার আগে কখনো পেট্রোবাংলাকে জানানো হয় না। দরপত্র আহ্বান এবং প্রাথমিক চুক্তির পর গ্যাস ক্রয় চুক্তির সময় পেট্রোবাংলাকে জানানো হয়। পরে চাপ দিয়ে গ্যাস ক্রয় চুক্তিও করা হয়। গ্যাস দেয়া সম্ভব কিনা, তা বিবেচনা করা হয় না।

পেট্রোবাংলার এক হিসাব অনুযায়ী, দেশে প্রমাণিত এবং সম্ভাব্য গ্যাস মজুদের পরিমাণ ২৭ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ)। এ পর্যন্ত প্রায় ১১ দশমিক ৭২ টিসিএফ গ্যাস তোলা হয়েছে। আবার সম্ভাব্য মজুদ নির্ধারণের ক্ষেত্রে কূপ খনন না করেই অনুমানের ভিত্তিতে গ্যাসের হিসাব নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রতি বছর দেশে গ্যাস প্রয়োজন হয় আধা টিসিএফ। ক্রমান্বয়ে তা আরো বাড়ছে। পেট্রোবাংলা ২০১৬ সাল পর্যন্ত তাদের যে পরিকল্পনা দিয়েছে, তাতে দৈনিক আরো ৭৯০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধি করা হবে।

জানা গেছে, নতুন-পুরনো মিলিয়ে গ্যাস সরবরাহ চুক্তি রয়েছে প্রায় ৭০টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের সাথে। এখন ৫০টির মতো কেন্দ্রে গ্যাস দেয়া হচ্ছে। এগুলোতে দৈনিক প্রায় ১৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট চাহিদার বিপরীতে সাধারণত সরবরাহ করা হয় ৭৫০-৮০০ টিসিএফ। গ্রীষ্মে তা দাঁড়ায় প্রায় ১০০০ মিলিয়ন ঘনফুটে। বাড়তি গ্যাসের জোগান দিতে সার কারখানা বন্ধ করে বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ করা হয়। পাশাপাশি সিএনজি স্টেশনগুলোতে রেশনিং করতে হচ্ছে।

এ অবস্থায় চুক্তিভুক্ত বাকি ২১টি বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ করতে হলে প্রায় দুই হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস প্রয়োজন হবে, যা দেশের মোট গ্যাস উৎপাদনের প্রায় সমান। এই পুরো গ্যাস বিদ্যুৎকেন্দ্রে গেলে অন্যান্য খাতে গ্যাস দেয়া যাবে না। তার ওপর নতুন করে ৮টি বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস দিতে হলে গ্যাসের চরম সংকট সৃষ্টি হবে। কেননা, এই ৮টি কেন্দ্রে প্রায় ৪১০ মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি গ্যাস প্রয়োজন হবে।

পেট্রোবাংলা বলছে, তারা যতোটা গ্যাস দিতে পারবে, তার চেয়ে অনেক বাড়িয়ে গ্যাস দেয়ার প্রতিশ্রুতি নেয়া হচ্ছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০১৫ সাল পর্যন্ত যেসব স্থান থেকে গ্যাস পাওয়ার কথা ছিলো, তাতে আশানুরূপ সাড়া নেই। নতুন ক্ষেত্র থেকেও পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে না। পুরনো ক্ষেত্র থেকে এখনো উৎপাদন বৃদ্ধি করা হচ্ছে।