পরীক্ষা নেয়া হয় মেধা যাচাইয়ের জন্য। কিন্তু প্রায় প্রতিটি পরীক্ষা এখন প্রহসনে পরিণত হয়েছে। পরীক্ষার আগেই ফাঁস হয়ে যাচ্ছে প্রশ্নপত্র। প্রশ্নপত্র ফাঁসের কৃতিত্ব দেখাচ্ছে যারা, তাদের পকেটে জমা হচ্ছে লাখ লাখ টাকা। প্রশ্নপত্র ফাঁস কারো জন্য পৌষ মাস হলেও সত্যিকারের মেধাবীদের জন্য সর্বনাশ হয়ে দেখা দিচ্ছে। অন্যদিকে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা এ ঘটনা উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। চলতি ঢাকা বোর্ডের এইচএসসি পরীক্ষার বাংলা দ্বিতীয়পত্র ও ইংরেজি প্রথমপত্র ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা নিয়েছে কর্তৃপক্ষ এমন অভিযোগও রয়েছে। কিন্তু শিক্ষামন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টি নাকচ করে এ ঘটনা কিছু সুবিধাভোগীর গুজব বলে মন্তব্য করেন। অবশেষে গত বুধবার দিনভর ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের দু সেট প্রশ্ন মোবাইলফোনের ক্ষুদেবার্তার মাধ্যমে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ছে এমন অভিযোগে ঢাকা বোর্ডের নির্ধারিত পরীক্ষা স্থগিত করে কর্তৃপক্ষ। আমরা মনে করি, এ ধরনের প্রবণতা চরম নৈরাজ্যকর। এটিকে জাতিবিনাশী কর্মকাণ্ড বললেও অত্যুক্তি হয় না।
দেশে প্রশ্নপত্র ফাঁস একটি রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্নপত্রের ওপর ভরসা করে কেউ কেউ সহজেই বৈতরণী পার হচ্ছে। মেধাবী না হয়েও তারা দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে ভর্তি হচ্ছে মানসম্মত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। দুর্নীতির সুবাদে চাকরির জন্য যোগ্য বলে বিবেচিত হচ্ছে। আর সত্যিকারের মেধাবীরা বঞ্চিত হচ্ছে প্রাপ্য সুযোগ থেকে। কারণ এক অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হচ্ছে তাদের। পরীক্ষার্থীদের একাংশ ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্নপত্র কিনে সঠিক জবাব রপ্ত করে পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে। বৃহত্তর অংশকে পরীক্ষা দিতে হচ্ছে নিয়মতান্ত্রিকতার কঠিন পথে। পিএসসি, জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসি এমনকি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা নিয়েও যে কারণে সংশয় সৃষ্টি হচ্ছে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, স্কুল-কলেজের ভর্তি পরীক্ষা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের এ চিত্র চরম অবক্ষয়ের। বিষয়টি লজ্জার এবং গ্লানির। উদ্বেগের তো বটেই। ফলে এর পুনরাবৃত্তি রোধই কাঙ্ক্ষিত।
গত বছর সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় দেশে যখন তোলপাড় চলছে, তার মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) মেডিকেল অফিসার নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়। এখানেই শেষ নয়। নৈর্ব্যক্তিক পদ্ধতির এ পরীক্ষার প্রশ্ন ও উত্তরপত্র কেন্দ্রের বাইরে নিয়ে পূরণ করার অভিযোগও ওঠে। এতে তাৎক্ষণিকভাবে প্রাথমিক খোঁজখবরে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় ওই নিয়োগ পরীক্ষা কর্তৃপক্ষ বাতিল করে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের যে চিত্র একের পর এক পাওয়া যাচ্ছে, তা চরমভাবে সামাজিক অবক্ষয়ের সাক্ষ্যবহ। এ ঘটনা অবশ্যই ধিক্কারযোগ্য।
বারবার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনার মধ্যদিয়ে এটা সহজেই প্রতীয়মান হয় অবক্ষয়কারীদের শিকড়বাকড় কতোটা বিস্তৃত ও সামগ্রিকভাবে সমাজচিত্র কতোটা বিবর্ণ হয়ে পড়েছে। এটি ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধি হিসেবে দেখা দিয়েছে এবং এ ব্যাধি যে টোটকা কোনো দাওয়াইয়ে সারবে না, তাও অনুধাবন করা কষ্টকর নয়। অতীতে স্কুল-কলেজ এবং বিসিএসসহ বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের কেলেঙ্কারি বারবার উদঘাটিত হয়েছে বটে, কিন্তু এর পুনরাবৃত্তি বন্ধ করা যায়নি। কেন যায়নি, তার সদুত্তর মেলা দুরূহ কোনো বিষয় নয়। অতীতে যতোবার এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে, তারপর কিছু দিন মিডিয়ায় হইচই চলেছে এবং সে কারণেই প্রশাসনের সাময়িক তৎপরতাও পরিলক্ষিত হয়েছে। কিন্তু এক পর্যায়ে যখন সব থেমে যায়, তখন অশুভশক্তি তাদের হীনকর্ম সাধনে আবার তৎপর হয়ে উঠেছে। তবে এবার শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের পর সরকারি কঠোর পদক্ষেপ কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপের সন্ধান পায়। বিজি প্রেসের মতো সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ও অধিক নিরাপত্তাসম্পন্ন কেন্দ্রটির অভ্যন্তরের উৎকট চিত্রও প্রকাশিত হয়ে পড়ে। চলতি এইচএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটা অস্বাভাবিক নয়।
যে দুষ্টচক্র শিক্ষা, পরীক্ষা কিংবা কর্মসংস্থান ব্যবস্থা- প্রায় সবকিছুতেই ছোবল মারছে, তারা যে দেশ-জাতির কতো বড় সর্বনাশ ঘটিয়ে চলেছে, তা বর্ণনায় শেষ করার নয়। এ রাহুগ্রাস থেকে মুক্তি পেতে সরকার ও প্রশাসনের কঠোর মনোভাব নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি সমাজসচেতনতা বৃদ্ধির কোনোই বিকল্প নেই।