আন্দোলনে আগ্রহ নেই বিএনপির : কেন্দ্রীয় ও তৃণমূল নেতাদের অনীহা

স্টাফ রিপোর্টার: সরকারবিরোধী আন্দোলনের ব্যাপারে আগ্রহ নেই বিএনপির। কেন্দ্রীয় নেতাদের মাঠে নামতে অনীহা, তৃণমূল পর্যায়ের নেতাদের অপারগতা প্রকাশ করা এবং এখনই আন্দোলনে না যাওয়ার ব্যাপারে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মহলের চাপ থাকায় বিএনপি হাইকমান্ড এ অবস্থান নিয়েছে।

জানা যায়, বুধবার রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে অন্যান্য প্রসঙ্গের পাশাপাশি আন্দোলনের বিষয়টি আলোচনায় স্থান পেলেও এ ব্যাপারে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ অধিকাংশ নেতাই আগ্রহ দেখাননি। আগে দল গুছিয়ে পরে আন্দোলনে যাওয়ার কথা বেশ কজনই বলেন। তবে জনসম্পৃক্ত কোন ইস্যুতে তাৎক্ষণিকভাবে আন্দোলন কর্মসূচি পালনের প্রয়োজন হলে তা পালন করার সিদ্ধান্ত হয়।

উল্লেখ্য, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনের পর থেকেই খালেদা জিয়াসহ বিএনপির সিনিয়র নেতারা ধারাবাহিকভাবে বলে আসছেন শীঘ্রই তারা সরকারবিরোধী কঠোর আন্দোলনে যাচ্ছেন। তবে উপজেলা নির্বাচন চলাকালে তারা বলতে থাকেন ৫ম দফা উপজেলা নির্বাচন শেষ হওয়ার সাথে সাথে দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা করে কঠোর আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। কিন্তু বুধবার রাতে খালেদা জিয়ার সভাপতিত্বে স্থায়ী কমিটির দীর্ঘ বৈঠক হলেও এতে কঠোর আন্দোলন দূরে থাক স্বাভাবিক আন্দোলনের ব্যাপারেও আগ্রহ দেখানো হয়নি। বরং এখনই আন্দোলনে না গিয়ে দলের নাজুক পরিস্থিতি থেকে কিভাবে বের হয়ে আসা যায় সে ব্যাপারে পর্যালোচনা হয়। এই পর্যালোচনা করতে গিয়েই বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ আদালতকে নিয়ে কটাক্ষ করে বক্তব্য দেয়ায় গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে এক হাত নেন। তিনি বলেন, দলের এখন নাজুক অবস্থা। এ অবস্থায় ‘দেশের সকল কোর্ট এখন মুজিব কোর্টের পকেটে’ এমন কথা বলা গয়েশ্বর রায়ের ঠিক হয়নি। অবশ্য গয়েশ্বর রায় মওদুদের এ আচরণ মেনে নিতে না পারায় খালেদা জিয়ার সামনেই ২ নেতার মধ্যে হট টক হয়। বিএনপি নেতাকর্মীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে উপজেলা নির্বাচন চলাকালেই সারাদেশের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের সাথে কেন্দ্র থেকে যোগাযোগ করে আন্দোলন করার ব্যাপারে তাদের মতামত নেয়া হয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ নেতাকর্মীই আপাতত আন্দোলন কর্মসূচি পালনে মাঠে নামতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। এমনকি কেন্দ্রীয় নেতারাও এ ব্যাপারে আগ্রহ দেখাননি। এ কারণে বাধ্য হয়েই দলীয় হাইকমান্ডকে আপাতত আন্দোলন কর্মসূচির দিকে যাওয়া থেকে পিছু হটতে হয়েছে। এ ছাড়া সরকারবিরোধী আন্দোলনে না যেতে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মহলের চাপও রয়েছে। এর বাইরে সারাদেশে দলের বিভিন্ন স্তরের অনেক নেতাকর্মী মামলায় জড়িয়ে কারাগারে রয়েছেন। আর এ কারণেই এখন সরকারবিরোধী আন্দোলনে যাওয়ার ব্যাপারে ভিন্ন কৌশল নেয়া হয়েছে।

উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি ভালো ফল করলেও এ নির্বাচনে কেন্দ্র থেকে ঠিক করে দেয়া দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন উপজেলায় বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়াকে কেন্দ্র করে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যেও বিরোধ দেখা দিয়েছে। সিলেটসহ দেশের কয়েকটি জেলায় এ নিয়ে তৃণমূল নেতাকর্মীরা চরম কোন্দলে জড়িয়ে পড়েছে। কেন্দ্র থেকে এ ব্যাপারে এখনও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এ অবস্থায় এখন আন্দোলন কর্মসূচি দিলে অনেক জেলা-উপজেলায় তা পালন করা কঠিন হয়ে পড়বে।

প্রসঙ্গত, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই আন্দোলনের কঠোর কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে এ নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এ জন্য বিএনপির নেতৃত্বে সারাদেশে ভোটকেন্দ্রভিত্তিক সংগ্রাম কমিটিও গঠন করা হয়। কিন্তু নির্বাচনের একমাস আগে থেকেই কেন্দ্রীয় নেতারা একে একে পালিয়ে যেতে শুরু করায় তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা হতাশ হয়ে যান। তারপরও তৃণমূল নেতাকর্মীরা নিজ নিজ এলাকায় আন্দোলন চালিয়ে যান। কিন্তু নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠিত হওয়ার পর বিভিন্নভাবে চরম বেকায়দায় পড়ে বিএনপি। আবার নতুন উদ্যমে আন্দোলনের কঠোর কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে সরকার কৌশলে তাদের থামিয়ে দেয়। এরই মধ্যে উপজেলা নির্বাচনের তোড়জোড় শুরু হলে বিএনপি আন্দোলনের কথা বাদ দিয়ে সারাদেশে উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের পক্ষে জোরেশোরে প্রচারে নামে। এতে বিএনপির আন্দোলনের গতি থেমে যায়। তবে প্রথম দু দফা উপজেলা নির্বাচনে ভাল ফল করলেও পরের ৩ দফায় সুবিধা করতে না পেরে দলের সর্বস্তরে হতাশা নেমে আসে।
আগে হাকডাক দিয়েও এখন আন্দোলনে না যাওয়ার আরেকটি কারণের মধ্যে রয়েছে বিএনপির নির্বাহী কমিটিসহ সারাদেশের সকল স্তরের যত কমিটি রয়েছে তার মধ্যে অধিকাংশ কমিটিই এখন মেয়াদোত্তীর্ণ। এ মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির নেতাদের কমান্ড এখন সাধারণ নেতাকর্মীরাও মানতে চাচ্ছেন না। তাই যখনই এসব কমিটি আন্দোলন কর্মসূচিসহ কোনো কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য অন্য নেতাকর্মীদের তলব করবেন তখন অনেকেই তাদের ডাকে সাড়া দিতে চাইবেন না। এছাড়া দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের আন্দোলন কর্মসূচি চলাকালে পালিয়ে যাওয়ায় কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে তৃণমূল নেতাদের দূরত্ব বেড়েছে। তৃণমূল নেতারা এখন কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রতি চরম ক্ষুব্ধ। তারা মনে করছে আন্দোলন চলাকালে তৃণমূল নেতাকর্মীদের বিপদের মুখে ঠেলে দিয়ে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবসহ কেন্দ্রীয় নেতারা পালিয়ে গেছেন। এই ক্ষোভের বহির্প্রকাশ দেখা যায় সম্প্রতি বিএনপি হাইকমান্ড দলের সিনিয়র নেতাদের নিয়ে ৫৬ টিম গঠন করে সারাদেশের সকল জেলা-উপজেলায় সাংগঠনিক সফর করার সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর। এ খবর শোনার পর তৃণমূল নেতারা দলীয় হাইকমান্ডকে জানায়, আগে আন্দোলনের সময় পালিয়ে যাওয়া নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে তারপর তাদের জেলা-উপজেলা সফরে পাঠাতে হবে। তা না হলে তাদের কথা কেউ শুনবে না। এ বিষয়টি উপলব্ধি করতে পেরে বিএনপি হাইকমান্ড ৫৬ টিমের সাংগঠনিক সফর স্থগিত করে। এরপর এখনও সিনিয়র নেতাদের জেলা সফর কর্মসূচি শুরু করতে পারেনি বিএনপি। আন্দোলন কর্মসূচি পালনের ব্যাপারে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাদের মতামত নিতে বৃহস্পতিবার থেকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বিভিন্ন জেলা-উপজেলার নেতাদের সাথে মতবিনিময় শুরু করেছেন। পর্যায়ক্রমে তিনি সারাদেশের সকল জেলা-উপজেলা পর্যায়ের নেতাদের সাথে কথা বলবেন। এরপর আস্তে আস্তে তিনি সরকারবিরোধী আন্দোলনের দিকে যাবেন। তবে কোনো স্পর্শকাতর ইস্যু নাগালে পেয়ে গেলে সেক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে কিছু আন্দোলন কর্মসূচি পালন করা হবে বলে দলীয় সূত্র জানিয়েছে।

বিএনপি এখন আন্দোলনে না যাওয়ার পেছনে আরও একটি কারণের মধ্যে রয়েছে ঢাকা মহানগরসহ দলের গুরুত্বপূর্ণ কিছু ইউনিটে কমিটি নিয়ে জটিলতা থাকা। এ জটিলতার কারণে আন্দোলনসহ দলীয় যে কোনো কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে বিএনপিকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এ বিষয়টি এখন ভালভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছে দলীয় হাইকমান্ড।

জানা যায়, সরকারবিরোধী আন্দোলনে যাওয়ার আগে দেশের রাজনৈতিক কেন্দ্রবিন্দু ঢাকা মহানগরসহ বিএনপির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সাংগঠনিক কমিটি পুনর্গঠন করা হবে। আন্দোলনে ভূমিকা পালন করতে পারবে এমন লোকদের দিয়ে এসব কমিটি করা হবে। কমিটি গঠনের পর আস্তে আস্তে দলীয় স্বাভাবিক কর্মসূচি পালনের পাশাপাশি আন্দোলন কর্মসূচির দিকে অগ্রসর হবে। এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান বলেন, আগে দল গুছিয়ে আমরা আন্দোলনে যেতে চাচ্ছি। তাই এখন আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়নি। তবে দলের জাতীয় কাউন্সিলের পর এ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন কর্মসূচি শুরু করা হবে।