দুর্নীতি দমন কমিশন-প্রশাসন দ্বন্দ্ব

 

জনপ্রশাসনের কর্মকর্তারা দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্ত কাজে চরম অসহযোগিতা ও প্রতিবন্ধবতা সৃষ্টি করছেন বলে জানা গেছে। বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। দুদক যদি প্রশাসনের কারও কাছে তথ্য-উপাত্ত বা কোনো সহযোগিতা চায়, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান তা দিতে আইনত বাধ্য। কাজেই বলা যায়, জনপ্রশাসনের যেসব কর্মকর্তা দুদককে সহযোগিতা করছেন না, তারা আইন লঙ্ঘন করছেন। সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান বা তদন্তে নথি সরবরাহে গড়িমসি করছেন সংশ্লিষ্টরা। সাক্ষ্য দেয়ার জন্য কর্মকর্তারা অনেক সময় হাজিরও হন না। উদাহরণ হিসেবে বলা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের সনদ জালিয়াতির সাথে জড়িত সচিব এবং নামে-বেনামে প্লট বরাদ্দের সাথে জড়িত সচিবদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরুর পর দুদক চরম অসহযোগিতার মুখে পড়েছে। এর আগে উন্নয়ন প্রকল্পের সন্ধান না মেলা ৪০টি গাড়ির খোঁজে নেমে আমলাতন্ত্রের রোষানলে পড়তে হয় দুদককে।

দুদকের কাজে জনপ্রশাসনের এ অসহযোগিতার কারণ খুঁজতে গেলে আমাদের কিছুটা পেছনে তাকাতে হয়। গত বছরের ১১ নভেম্বর জাতীয় সংসদে দুর্নীতি দমন কমিশন (সংশোধন) বিল ২০১৩ পাস হয়েছিলো। এ সংশোধনী সহকারে আইনটি বলবৎ হলে দুদককে নখদন্তহীন বাঘে পরিণত করা হতো বলে অনেকের ধারণা। কারণ এ আইনের ৩২(ক) ধারা অনুযায়ী সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, জজ ও ম্যাজিস্ট্রেটদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি সংক্রান্ত মামলা করতে সরকারের পূর্বানুমতির প্রয়োজন হতো। আইনটি সংসদে পাস হওয়ার পর দুদক চেয়ারম্যান, টিআইবি, সুশীল সমাজসহ বিভিন্ন নাগরিক সংগঠন এর তীব্র সমালোচনা করে। তারা এ সংশোধনী বাতিলের দাবি জানান। এ অবস্থায় একটি পরিবেশ ও মানবাধিকার সংগঠনের পক্ষ থেকে উচ্চ আদালতে রিট করা হয়। উচ্চ আদালত দুদক আইনের ৩২(ক) ধারা বাতিল ও সংবিধানবহির্ভূত ঘোষণা করে রায় দেন। বস্তুত ৩২(ক) ধারা বাতিল হওয়ার পর থেকেই দুদক ও প্রশাসনের মধ্যে দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করে। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, এ ধারাটি বাতিল হওয়ায় দুদক স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ পেলেও এ বিষয়ে প্রশাসনের কর্মকর্তারা সন্তুষ্ট নন। এ পরিস্থিতি শুধু অনাকাঙ্ক্ষিত নয়, দেশের দুর্নীতি দমন কর্মকাণ্ডের জন্য ক্ষতিকরও বটে। বিশেষ করে দুদক ও প্রশাসন যদি পরস্পর দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়, তাহলে দুদকের কার্যক্রম ব্যাহত হতে বাধ্য।

আমাদের কাছে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের এ আচরণের কারণ বোধগম্য নয়। ৩২(ক) ধারা বাতিল না হলে দুদক আইনের প্রয়োগের ক্ষেত্রে বৈষম্য সৃষ্টি হতো। সংবিধান অনুযায়ী আইন সবার জন্য সমান। কাজেই তাতে সংবিধানও লঙ্ঘন হতো। সবচেয়ে বড় কথা, এর ফলে দুদকের স্বাধীনতা খর্ব হতো, যা মোটেই কাম্য নয়। আমরা দুর্নীতি দমন কমিশন আইনটিকে সংবিধানের অন্তর্গত স্পিরিটের সাথে সাযুজ্যপূর্ণ রূপে দেখতে চাই। এর যেকোনো ব্যত্যয় একে একটি অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে পারে। আর এমন পরিণতি এ প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তাকেই করবে প্রশ্নবিদ্ধ। আমরা আশা করবো, প্রশাসনের কর্মকর্তারা বিষয়টি উপলব্ধি করে দুর্নীতি দমনে দুদককে সর্বাত্মক সহযোগিতা দেবেন। নয়তো দুদককে অসহযোগিতা করার পেছনে তাদের অসৎ উদ্দেশ্য রয়েছে বলে প্রশ্ন উঠতে পারে।

Leave a comment