সরকারের কাছে ৭৯১ কোটি টাকার বিদ্যুত বিল বকেয়া

সরকারি-বেসরকারি সংস্থার কাছে মোট বকেয়া ৩ হাজার ৫শ কোটি টাকা

 

স্টাফ রিপোর্টার: সরকার নিজেই বিল খেলাপি হয়ে গেছে! বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে বকেয়া বিদ্যুত্ বিল বাবদ পাঁচটি বিদ্যুত বিতরণ কোম্পানির পাওনা দাঁড়িয়েছে ৭৯১ কোটি ৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে বছরের পর বছর ধরে বিল দেয় না অনেক প্রতিষ্ঠান। বৈঠকের পর বৈঠক, দফায় দফায় চিঠি চালাচালি করেও কাজ হচ্ছে না। পরিশোধ হচ্ছে না বকেয়া বিল। এ ব্যাপারে বিদ্যুত্ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে পাওনাদার প্রতিষ্ঠানগুলোর আবেদনেও সাড়া মিলছে না। এ কারণে কোম্পানিগুলো আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

বিদ্যুত্ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান মিলিয়ে মোট বিদ্যুত্ বিল বকেয়া রয়েছে ৩ হাজার ৫শ ৬৯ কোটি টাকা। এই বকেয়া বিলের একটি বড় অংশ সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের। সাধারণত ছয় মাসের বিল বকেয়া হলেই বিদ্যুত্ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার কথা। কিন্তু এমনও প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা দীর্ঘ ১৭ থেকে ১৮ বছর ধরে বিদ্যুত্ বিল পরিশোধ করছে না। অথচ এই বিপুল পরিমান বকেয়া বিল পরিশোধ হলে সরবরাহ, বিতরণ ও গ্রাহক পর্যায়ে অবকাঠামোগত উন্নয়ন ঘটিয়ে আরো বেশি সংখ্যক গ্রাহকের কাছে বিদ্যুত্ পৌঁছে দেয়া সম্ভব হবে। সেইসাথে লোডশেডিংও বন্ধ হবে। এ প্রসঙ্গে পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক মাহবুব-ই-কায়নাত বলেন, আমাদের সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন নির্মাণ এবং সংস্কারে গুরুত্ব দিতে হবে। তাহলে সিস্টেম লসও কমবে।

বিদ্যুত্ বিল সবচেয়ে বেশী বকেয়া রয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগের কাছে। ২০১৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সরকারের এই বিভাগের কাছে পাঁচটি বিদ্যুত্ বিতরণ কোম্পানি পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (পবিবো), ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি), বাংলাদেশ বিদ্যুতায়ন বোর্ড ( বিউবো), ওয়েষ্টজোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি ( ওজোপাডিকো) ও ঢাকা বিদ্যুত্ বিতরণ কোম্পানি’র (ডেসকো) মোট বকেয়া বিল ৩২৩ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। এরপরেই রয়েছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। এই মন্ত্রণালয়ের বকেয়া ১১১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। আর সবচেয়ে কম বিদ্যুত্ বিল বকেয়া দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক)। মাত্র ৯ হাজার টাকা।

এছাড়া সরকারের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ৮৯ কোটি ১২ লাখ, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ৫৮ কোটি ৭৩ লাখ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ৩৫ কোটি ৯৩ লাখ, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ৩৩ কোটি ৩৪ লাখ, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের ১৯ কোটি ৮১ লাখ, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের ১৮ কোটি ৩৪ লাখ, রেলপথ মন্ত্রণালয়ের ১৩ কোটি ৫৭ লাখ, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ১২ কোটি ২১ লাখ, জনপ্রশাসনের ১০ কোটি ২১ লাখ, ডাক, তার ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের ৫ কোটি ৮৫ লাখ, মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের ৫ কোটি ৩১ লাখ, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ৫ কোটি ১৫ লাখ, আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ৪ কোটি ৮৩ লাখ, কৃষি মন্ত্রণালয়ের ৪ কোটি ৬২ লাখ, তথ্য মন্ত্রণালয়ের ৪ কোটি ৩৬ লাখ, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের ৩ কোটি ৭৪ লাখ, সড়ক বিভাগের ৩ কোটি ৫৫ লাখ, ভূমি মন্ত্রণালয়ের ৩ কোটি ২০ লাখ, পানি সম্পদের ৩ কোটি ৩ লাখ, সুপ্রিম কোর্টের ২ কোটি ৮১ লাখ, শিল্প মন্ত্রণালয়ের ২ কোটি ৫৭ লাখ, মত্স্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ১ কোটি ৬৫ লাখ, খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ১ কোটি ৩৯ লাখ, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের ১ কোটি ৬ লাখ, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ১ কোটি ৫ লাখ, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের ৯২ লাখ, বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের ৮৪ লাখ, অর্থ বিভাগের ৭২ লাখ, নৌ-মন্ত্রণালয়ের ৭০ লাখ, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়ের ৬২ লাখ, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের ৫৮ লাখ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদের ৫২ লাখ, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ৪৪ লাখ ১৯ হাজার, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ২৮ লাখ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের ২৩ লাখ, পরিকল্পনা বিভাগের ১৭ লাখ, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ১৩ লাখ, সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) ১৩ লাখ, নির্বাচন কমিশনের ১২ লাখ, খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ১২ লাখ, পরিসংখ্যান বিভাগের ১১ লাখ, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের ১১ লাখ, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের ৫ লাখ, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ৩ লাখ ৯০ হাজার, সেতু বিভাগের ৪ লাখ ১০ হাজার ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কাছে ২ লাখ ১৩ হাজার টাকা বিদ্যুত্ বিল বকেয়া রয়েছে।

সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে এই বকেয়া বিলের মধ্যে পবিবো ৫৪ কোটি ৩৯ লাখ, ডিপিডিসি ৪৩২ কোটি ৫৪ লাখ, বিউবো ১২৪ কোটি, ওজোপাডিকো ৭২ কোটি ৪৯ লাখ, ডেসকো ১০৭ কোটি ৬৩ লাখ টাকা পাবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়সহ সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক বাজেটে বিদ্যুত্ বিল পরিশোধের জন্য অনুমিত অর্থ বরাদ্দ থাকে। কিন্তু তারপরও বিল পরিশোধ করা হয় না। সর্বশেষ গত ২৫ মার্চ বকেয়া বিল আদায়ে বৈঠক করেছে বিদ্যুত্ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়। বৈঠকে বিল পরিশোধের তাগাদা দিয়ে ৪০টি মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

সূত্র জানিয়েছে, এর আগেও অনেক বার এ ধরনের চিঠি দেয়া হয়েছে। করা হয়েছে অনেক বৈঠক। কিন্তু তারপরও বছরের পর বছর বিল আটকে আছে। অন্যদিকে বিভিন্ন কারণে সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিদ্যুত্-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা যায় না।

তবে সরকারি প্রতিষ্ঠানের বকেয়া বিদ্যুত্ বিল আদায়ে এবার কঠোর হচ্ছে সরকার। এ প্রসঙ্গে বিদ্যুত্ সচিব মনোয়ার ইসলাম গতকাল ইত্তেফাককে বলেন, সরকারি হোক আর বেসরকারি হোক, বিল বকেয়া পড়লে প্রধানমন্ত্রী বিদ্যুত্ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিতে বলেছেন। আমরা বিল বকেয়া পড়লে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

Leave a comment