ভারত ও বাংলাদেশে ইসির ক্ষমতা এক : প্রয়োগ ভিন্ন

স্টাফ রিপোর্টার: কথায় নয়, কাজেই পরিচয়। কালো টাকার ব্যাপারে কঠোরপন্থা অবলম্বন এবং বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে বদলি করার নির্দেশ মেনে নেয়ার জন্য ভারতে মমতা ব্যানার্জির পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে নতি স্বীকার করতে বাধ্য করার মাধ্যমে দেশটির নির্বাচন কমিশন এ প্রবাদটিকে আরো একবার সত্য প্রমাণিত করল। সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন করতে নির্বাচন কমিশন কিভাবে পুরো প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তার দুটি জ্বলন্ত উদাহরণ হলো সাম্প্রতিক এ ঘটনা দুটি। এ কারণেই আমাদের দেশেও একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন পাওয়ার আশায় দেশের নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা প্রায়ই ভারতীয় নির্বাচন কমিশনের উদাহরণ টেনে আনেন। বাংলাদেশ ও ভারত- দু দেশের নির্বাচন কমিশনই সাংবিধানিকভাবে স্বতন্ত্রভাবে কার্য পরিচালনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা রাখে। ভোটারদের প্রভাবিত করা কিংবা ভোটারদের ভোট পেতে তাদের প্রলোভন দেখানোর জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর অর্থ এবং ক্ষমতার ব্যবহার ও প্রয়োগ ভারতে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। দেশটিতে আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে কালো টাকা ও অবৈধ তহবিলের ব্যবহার বন্ধ করতে এবার ভারতীয় নির্বাচন কমিশন সারাদেশ থেকে নগদ প্রায় ১৯৫ কোটি ভারতীয় রুপি জব্দ করেছে। এরমধ্যে শুধু অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে জব্দ করা হয়েছে ১১৮ কোটি রুপি। গ্রামাঞ্চলে অবৈধ অর্থ সরবরাহ চিহ্নিত করতে বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের নিয়ে বেশ কয়েকটি বাহিনী নিয়োগ করেছে ভারতীয় নির্বাচন কমিশন। আর অর্থের আনাগোনার ওপর শকুনের চোখ রাখতে দেশজুড়ে রাজস্ব কর্মকর্তারা তো আছেনই।ভারতের জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রচারণা চালানোর সময় ভোটারদের নগদ টাকা প্রদান এবং নানারকম প্রলোভনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে দেশটির নির্বাচন কমিশন ১১ হাজার ৪৬৯টি অভিযোগ লিপিবদ্ধ করেছে এবং এরই মধ্যে ২৬.৫৬ লাখ লিটার মদ এবং ৭০ কেজি হেরোইন জব্দ করেছে।আগামী ৩৫ দিনে দেশটির ৫৪৩টি লোকসভা আসনে নির্বাচন হবে। এ উপলক্ষে আয়কর এবং শুল্ক ও আবগারি বিভাগের মতো গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় রাজস্বের ৬৫৯ জন কর্মকর্তাকে লোকসভার আসনগুলোয় নিযুক্ত করা হয়েছে। গত ৫ মার্চ নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করার পর থেকে এই কর্মকর্তারা নগদ অর্থ জব্দসংক্রান্ত বিভিন্ন অভিযোগ পেয়েই যাচ্ছেন।

গত সোমবার পর্যন্ত পাওয়া সরকারি তথ্য অনুযায়ী নির্বাচনী ব্যয় পর্যবেক্ষক সংস্থা এ পর্যন্ত তামিলনাড়ু থেকে ১৮.৩১ কোটি, মহারাষ্ট্র থেকে ১৪.৪০ কোটি রুপি, উত্তরপ্রদেশ থেকে ১০.৪৬ কোটি এবং পাঞ্জাব থেকে ৪ কোটি রুপিসহ দেশটির অন্যান্য রাজ্য থেকে বেশকিছু নগদ অর্থ জব্দ করেছে। এছাড়া দেশটির অর্থ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন দুটি প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রীয় প্রত্যক্ষ কর বিভাগ ও আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটকে (এফআইইউ) নির্বাচনের সময় সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রগুলোয় কঠোরভাবে নজর রাখার নির্দেশও দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।ভারতের প্রধান নির্বাচন কমিশনার ভিএস সাম্পাত স্বীকার করেছেন, প্রত্যেক প্রার্থীকে নির্বাচনী ব্যয়ের জন্য সর্বোচ্চ ৭০ লাখ রুপির যে সীমা বেঁধে দেয়া হয়েছে, সেই সীমা যে লঙ্ঘন করবেন না, তা নিশ্চিত করা নির্বাচন কমিশনের জন্য সবচেয়ে কঠিন কাজগুলোর একটি। প্রশাসনের ওপর নিয়ন্ত্রণঅভিযোগ গ্রহণ করার পর গত সোমবার বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে বদলি করার নির্দেশ দেয় ভারতীয় নির্বাচন কমিশন। এদের মধ্যে রয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের ৫ জন পুলিশ সুপার, একজন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং দুজন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। আগামী ১৭ এপ্রিল থেকে পশ্চিমবঙ্গের ৫ দফার লোকসভা নির্বাচন শুরু হচ্ছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের কর্মকর্তাদের বদলি সংক্রান্ত আদেশ পাওয়ার পর নির্বাচন কমিশনের প্রতি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন রাজ্যটির মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। এরই ধারাবাহিকতায় নির্বাচন কমিশনের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে মঙ্গলবার তিনি বলেন, যতোক্ষণ আমি দায়িত্বে আছি, ততোক্ষণ আমার রাজ্য থেকে কাউকে নির্বাচন কমিশন কিভাবে সরায়, তা আমিও দেখবো। নির্বাচন কমিশনের প্রতি প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, রাজ্য সরকারের সাথে আলোচনা না করেই কিভাবে নির্বাচন কমিশন কাউকে বদলি করে নতুন কর্মকর্তাদের স্থলাভিষিক্ত করতে পারে? তবে মমতাকে কোনোরকম তোয়াক্কা না করেই তার চ্যালেঞ্জের প্রতিক্রিয়ায় কোনো প্রতিক্রিয়া দেননি দেশটির রাজধানী নয়াদিল্লিতে অবস্থানরত প্রধান নির্বাচন কমিশনার। তিনি জানান, যদি প্রয়োজন হয় তাহলে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সবকিছু জানিয়ে দেয়া হবে। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের বরাত দিয়ে যখন ভারতের গণমাধ্যমের বেশকিছু প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হলো- সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বদলি করা না হলে পশ্চিমবঙ্গের লোকসভাগুলোয় নির্ধারিত নির্বাচন বাতিল করতে পারে নির্বাচন কমিশন, তখন দৃশ্যপট দ্রুত পাল্টে যায়। টনিকের মতোই কাজ হয়। মমতা নতি স্বীকার করেন এবং নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে বাধ্য হন। এরই ধারাবাহিকতায় মঙ্গলবারই নিজ রাজ্য থেকে ৮ কর্মকর্তাকে বদলি করার বিষয়টি মেনে নেয় পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এর পরপরই বদলি হওয়া কর্মকর্তা হিসেবে ৫ জন পুলিশ সুপার, একজন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং দুজন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের স্থলাভিষিক্ত হিসেবে নতুন কর্মকর্তাদের জন্য একটি নামের তালিকা নির্বাচন কমিশনে পাঠিয়ে দেয় মমতার সরকার এবং নির্বাচন কমিশনকে বারবার অনুরোধ জানানো হচ্ছে যেন ওই তালিকার মধ্য থেকেই নতুন কর্মকর্তাদের বাছাই করা হয়। বদলি করা কর্মকর্তাদের স্থলাভিষিক্ত হিসেবে নির্বাচন কমিশন যাদের বাছাই করেছে, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তৈরি করা তালিকায় তাদের কারো নামই নেই। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্য সচিব স্বাক্ষরিত তালিকাটি এরই মধ্যে সংশ্লিষ্ট প্যানেলের কাছে একটি চিঠিসহ পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। বার্তা সংস্থা এনডিটিভির এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, কর্মকর্তাদের বদলি সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত পশ্চিমবঙ্গ সরকার মেনে নিলেও সিদ্ধান্তটি পরিবর্তন করতে নির্বাচন কমিশনের কাছে মুখ্য সচিব বারবার অনুরোধ জানিয়েই যাচ্ছেন।

Leave a comment