ভারতে সোনা পাচারের ট্রানজিট বাংলাদেশ

 

স্টাফ রিপোর্টার: গত বছর বাংলাদেশে অবৈধ পথে আসা আটক সোনার পরিমাণ এর আগের বছর ২০১২-এর চেয়ে ২২ গুণ বেশি। আবার চলতি বছরের জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চ- এ তিন মাসে যে পরিমাণ চোরাই সোনা আটক হয়েছে তা ২০১২ সালে সারা বছরের আটক সোনার চেয়ে প্রায় ৯ গুণ বেশি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) শুল্ক গোয়েন্দা শাখা সোনা চোরাচালান বেড়ে যাওয়ার কারণ অনুসন্ধান করে যে প্রতিবেদন তৈরি করেছে তা থেকে এই তথ্য পাওয়া গেছে।

এনবিআরের প্রতিবেদন বলছে, ২০১২ সালে অবৈধ পথে আসা ২৫ কেজি সোনা আটক করে তাদের শুল্ক গোয়েন্দা শাখা। তবে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ২০১৩ সালে আটক সোনার পরিমাণ দাঁড়ায় ৫৫০ কেজি, যার বাজার মূল্য আড়াই শ কোটি টাকার বেশি। আবার চলতি বছরের প্রথম তিন মাসেই আটক সোনার পরিমাণ ২২০ কেজি।

শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মইনুল খান বলেন, শুল্ক গোয়েন্দা শাখা থেকে সোনা চোরাচালানের কারণ অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মূলত প্রতিবেশী দেশ ভারতে সোনা পাচারের ট্রানজিট হিসেবে বাংলাদেশকে ব্যবহার করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক চোরাকারবারের সঙ্গে জড়িত কিছু বাংলাদেশিও এ কাজে জড়িত। তারা সোনা পাচারে সহায়তা করায় বড় অঙ্কের অর্থ পাচ্ছে। কিন্তু পাচারকারীদের নেতারা ধরা পড়ছে না। শুধু যারা বহনকারী হিসেবে কাজ করছে তাদেরই আটক করা সম্ভব হচ্ছে। তারাও আবার বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আইনের ফাঁক গলে বের হয়ে যাচ্ছে। মইনুল খান আরো বলেন, দুবাইয়ের চেয়ে দামের পার্থক্য থাকায় ভারতের বাজারে সোনা বিক্রিতে লাভ রয়েছে। একটি সোনার বিস্কুটে ৮.৫৭ ভরি সোনা থাকে। ১০টি সোনার বিস্কুটে প্রায় ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা লাভ হচ্ছে। অতি সহজে এসব বিস্কুট বহন করা যায়। এভাবে বিভিন্ন কারণ খুঁজে পাওয়া গেছে অনুসন্ধানে।

প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, ভারতে স্বর্ণের ওপর শুল্ক ৩ শতাংশ থেকে বেড়ে ১০ শতাংশ হয়েছে। এতে আগের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি রাজস্ব দিয়ে ভারতে সোনা আমদানি করতে হয়। ভারতে চলতি বছরের বাজেটে ব্যবসায়ীদের পুঁজির ক্ষেত্রেও সীমারেখা দেওয়া হয়েছে। এতে দেশটিতে বৈধ পথে সোনা আমদানিতে ধস নামে। ভারতে আইনি প্রক্রিয়ায় আমদানি গত বছর এপ্রিলে (ভারতে অর্থবছর শুরু এপ্রিলে) ১৪২ টন হলেও জুনে ৪০ টন হয়। জুনের পর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত আমদানি গড়ে একই ধারায় থাকে। শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারতে সোনা পাচারের ট্রানজিট হিসেবে নেপাল ও শ্রীলঙ্কার সড়ক, নদী ও বিমানপথও ব্যবহার করা হচ্ছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতে সোনার চাহিদা বেশি। শুল্ক বেড়ে যাওয়ায় ভারতে সোনা পাচারকে কেন্দ্র করে আন্ডারওয়ার্ল্ডে এ ব্যবসায় মুনাফাও বেড়েছে। সম্প্রতি মার্কিন ডলারের তুলনায় ভারতীয় রুপির মূল্য কমায় ভারতে দুবাইয়ের চেয়ে সোনার দাম বেড়েছে প্রতি কেজিতে ২.৫ লাখ রুপি। এতে দুবাই থেকে সোনা ভারতের বাজারে বিক্রিতে লাভ অনেক বেশি হচ্ছে। তাই চোরকারবারিদের লাভও বেশি। এ ছাড়া গত দুই বছর থেকে আইনের ফাঁক গলে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে মূল্য পরিশোধে বাংলাদেশ থেকে সোনা নিতেই বেশি আগ্রহী ভারতের ব্যবসায়ীরা। কারণ, সে দেশের বাজারে সোনা উচ্চমূল্যে বিক্রি করে আরেক দফা মুনাফা করা যাবে। এতে বাংলাদেশি অনেক সাধারণ ব্যবসায়ীও ভারতীয়দের সঙ্গে ব্যবসায়িক লেনদেনে সোনা সরবরাহ করছেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক সিন্ডিকেট সোনা চোরাচালানে জড়িত। সিন্ডিকেট প্রত্যেক বহনকারীকে প্রতি কেজি সোনা নিরাপদে বহনের জন্য ৫০ হাজার থেকে এক লাখ রুপি নগদে পরিশোধ করছে। এ ছাড়াও ক্যারিয়ারের পরিবহনসহ সব খরচ বহন করা হয়। আবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারিতে ধরা পড়ে জেল বা জরিমানা হলে তাদের রক্ষাও করে সিন্ডিকেট। একই ক্যারিয়ারকে দিয়ে একাধিকবার সোনা আনানো হয়। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন রুট ব্যবহার করা হয়।

গোয়েন্দা রিপোর্টে উল্লেখ আছে, চোরাচালানে এখন নিত্যনতুন উপায় বের করা হচ্ছে। আন্ডার গার্মেন্টস, শকস, ওয়েস্ট ব্যান্ড, সুসোল, ফলস ক্যাভিটি অব ব্যাগ, স্ট্যাপল পিন- এসব বিচিত্র উপায়ে আনা হচ্ছে চোরাই সোনা। রাজধানীর শাহজালাল, চট্টগ্রামের শাহ আমানত ও সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেই সোনা আটকের ঘটনা বেশি ঘটেছে। অবৈধ পথে আসা সোনা বাংলাদেশ থেকে ভারতে যেতে স্থলপথ বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে। বিশেষভাবে বাংলাদেশের দিকে বেনাপোল, সোনামসজিদ, আখাউড়া ও হিলি স্থলবন্দর রয়েছে। অন্যদিকে ভারতের দিকে কালিরানী, আংরাইল, হরিদাসপুর, জয়ন্তীপুর, বানোবেরিয়া, সুটিয়া, বাঁশঘাট পাচারকারিরা বেশি ব্যবহার করছে।

 

Leave a comment