বউ-শাশুড়ির ঝগড়ায় ১৪ বছর পর বেরিয়ে এল সত্য

নোয়াখালী প্রতিনিধি: নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলায় চৌদ্দ বছর পর এক নারীর অন্তর্ধানরহস্য বেরিয়ে এসেছে। প্রতিবেশি এক পরিবারের পারিবারিক কলহের সময় তাঁদের কথা বার্তা থেকে বেরিয়ে এসেছে নুরুন্নাহার বেগম নামের ওই নারীকে খুন করে পুঁতে রাখা হয়েছিল। আজ মঙ্গলবার দুই নারীকে গ্রেপ্তার করার পর তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী নুরুন্নাহারের দেহাবশেষ উদ্ধার করেছে পুলিশ।

বিকেলে নির্বাহী হাকিম শরিফুল ইসলামের উপস্থিতিতে থানা পুলিশ উপজেলার কুশুল্লারবাগ গ্রামের একটি খেত থেকে নুরুন্নাহারের হাড়-গোড় উদ্ধার করে। এ সময় নুরুন্নাহারের স্বজনদের আহাজারিতে এলাকার পরিবেশ ভারি হয়ে ওঠে। ঘটনাস্থলে আশেপাশের গ্রামের শত শত মানুষ ভিড় জমায়।

এলাকাবাসী ও পুলিশের সাথে কথা বলে জানা গেছে, কুশুল্লারবাগ গ্রামের বাসিন্দা নুরুন্নাহার বেগম ২০০০ সাল থেকে নিখোঁজ ছিলেন। গত রোববার প্রতিবেশি একটি পরিবারের বউ-শাশুড়ি ও অন্য সদস্যদের মধ্যে জমিজমা নিয়ে ঝগড়া বাধে। এ সময় তাঁদের মধ্যে দুই বউ নিখোঁজ নুরুন্নাহারকে হত্যা করা হয়েছে বলে সবাইকে জানিয়ে দেন। এরপরই নুরুন্নাহারের ছেলে নুরুল ইসলাম (৪০) থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। পুলিশ সামছুন্নাহার বেগম (৪৮) ও তাঁর মা মনোয়ারা বেগম (৭০) নামের এজাহারভুক্ত দুই আসামিকে গ্রেপ্তার করে। তাঁদের দেখিয়ে দেওয়া স্থান থেকে দেহাবশেষ উদ্ধার করা হয়।

নুরুল ইসলাম এজহারে উল্লেখ করেন- তার মা নুরুন্নাহার বেগম বাপের বাড়ির সম্পত্তি বিক্রির ২ লাখ ৩০ হাজার টাকা ব্যবসার জন্য স্ট্যাম্পের মাধ্যমে ধার দেন নুরুল আমিন নামের এক প্রতিবেশিকে। নুরুল আমিন সেখানকার বাসিন্দা সৈয়দ আলীর মেয়ে সামছুন্নাহারকে বিয়ে করে শ্বশুরের পরিবারের সঙ্গেই বাস করছিলেন। এজাহারে উল্লেখ করা তথ্য অনুযায়ী, ধার নেওয়া টাকার বিনিময়ে প্রতি বছর নুরুন্নাহারকে ৩০ মণ ধান দেয়ার কথা ছিলো নুরুল আমিনের। কথা অনুযায়ী ধান না দেওয়ায় এ নিয়ে নুরুল আমিনের সঙ্গে নুরুন্নাহারের কথা কাটাকাটি হয়।
নুরুল ইসলামের অভিযোগ, তাঁর মা বিষয়টি স্থানীয় গন্যমান্য ব্যক্তিদের জানালে নুরুল আমিন তাঁকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেন। এ ঘটনার কিছুদিন পর ২০০০ সালের ৫ জানুয়ারি ভোর থেকে তাঁর মা নুরুন্নাহার বেগম নিখোঁজ ছিলেন।

এজহারে উল্লেখ করা তথ্য ও এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, নিখোঁজ নুরুন্নাহারের কাছ থেকে টাকা ধার নেওয়া নুরুল আমিন এখনও শ্বশুরবাড়ির সঙ্গেই বাস করেন। নুরুল আমিনের স্ত্রী সামছুন্নাহার উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া তাঁর বাপের বাড়ির সম্পত্তি বিক্রি করে দেন। এ নিয়ে গত রোববার সামছুন্নাহারের দু্ই ভাইয়ের স্ত্রী সেলিনা আক্তার ও আছমা আক্তারের সঙ্গে তাঁদের ঝগড়া হয়। এ সময় সেলিনা আক্তার ও আছমা আক্তার বলেন, তাঁদের ননদ সামছুন্নাহার বেগম ও তাঁর স্বামী নুরুল আমিন ও শ্বাশুড়ি মনোয়ারা বেগমসহ পরিবারের সদস্যরা ১৪ বছর আগে নুরুন্নাহার বেগমকে হত্যা করে লাশ গুম করেন। এরপরই নুরুল ইসলাম থানায় এজাহার দেন।

গত সোমবার সন্ধ্যায় সোনাইমুড়ী থানায় প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপকালে মনোয়ারা বেগম নিখোঁজ নুরুন্নাহারের লাশ গুম করে রাখার কথা স্বীকার করেন। তবে তাঁকে হত্যা করা হয়নি বলে দাবি করেন তিনি। তাঁর দাবি, তাঁদের জমিতে মাছ ধরা ঠেকানোর জন্য বৈদ্যুতিক তার টাঙানো ছিল। ভোরে নুরুন্নাহার সেখানে মাছ ধরতে গিয়ে বিদ্যুত্স্পৃষ্ট হয়ে মারা যান। এরপর তাঁরা ভয়ে বিষয়টি কাউকে না জানিয়ে লাশ বাড়ির পাশে খেতে গর্ত করে পুঁতে রাখেন। লাশটি পুঁতেছিলেন তাঁর ছেলে রইছ উদ্দিন ও স্বামী সৈয়দ আলী। সৈয়দ আলী ইতিমধ্যে মারা গেছেন এবং রইসউদ্দিন এখন বিদেশে থাকেন। অন্যদিকে, জামাতা নুরুল আমিন গত রোববারই পালিয়ে যান।

পুলিশ জানায়, থানায় প্রাথমিক জিজ্ঞাবাসাদে মনোয়ারা বেগম ‘নিখোঁজ’ নুরুন্নাহার বেগমের মৃত্যুর ঘটনা বর্ণনা করেন এবং কারা কিভাবে ওই ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাঁর বর্ণনা দেন। তাঁর (মনোয়ারা) এবং মেয়ে সামছুন্নাহারের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই আজ বিকেলে গর্ত খুড়ে ওই হাড়গোড় উদ্ধার করা হয়।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সোনাইমুড়ী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাথার খুলি, অস্থি-মজ্জাসহ শরীরের বেশিরভাগ হাড়গোড়ই উদ্ধার করা গেছে। এর মধ্যে ওই গর্তে পাওয়া রুপার চুড়ি দেখে বোঝা যায়—উদ্ধার করা হাড়গোড়গুলো মহিলার।’

সোনাইমুড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুস সামাদ প্রথম আলোকে বলেন, উদ্ধার করা হাড়গোড় ও অস্থিমজ্জা নোয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করা হবে। সেখানকার কর্মকর্তারা প্রয়োজনীয় উচ্চতর পরীক্ষার জন্য ঊধ্বর্তন কর্তৃপক্ষের নিকট প্রেরণ করবেন।

এ ছাড়া এ ঘটনায় গ্রেপ্তার করা মা-মেয়েকে আজ নোয়াখালীর বিচারিক হাকিমের আদালতে প্রেরণ করা হয়েছে। আদালত তাঁদের জামিন না মঞ্জুর করে জেলা কারাগারে প্রেরণের নির্দেশ দেন বলে আদালত সুত্রে জানা গেছে।

Leave a comment