মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানাতে হাতছানি দেয় ঐতিহাসিক মুজিবনগর

 

 

মহাসিন আলী/শেখ শফি: পর্যটনকেন্দ্র মুজিবনগর: রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিরোধীদলের টানা হরতাল, সড়ক অবরোধ, যাত্রীবাহীবাসে সহিংসতাসহ নানা কারণে এবছর সময়মতো ভ্রমণ পিপাসুরা দেশের দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরতে যেতে পারেনি। যে কারণে অন্যান্য বছরের ন্যায় শীতের প্রথম দিকে না হলেও শীত শেষে বসন্তে মেহেরপুরের ঐতিহাসিক মুজিবনগরে প্রতিদিন ২শ’ থেকে আড়াইশ’ বাস ভর্তি দর্শনার্থী আসছে। প্রতি শুক্রবার ও শনিবার ছাড়াও ছুটির দিনগুলোতে দর্শনার্থীর ভিড় বৃদ্ধি পায়। দর্শনার্থীদের ভিড়ে মুজিবনগর কমপ্লেক্সে দিনভর থাকে মুখোরিত। শিশু-কিশোর, যুবক-যুবতীসহ সব বয়সের মানুষ আসছে মুজিবনগরে। কেউ বিনোদনে, কেউ অবসর কাটাতে, কেউ ইতিহাস জানতে আবার কেউ পিকনিকের জন্য ঐতিহাসিক মুজিবনগরে আসছেন। সরকার মুজিবনগরের স্মৃতি ধরে রাখতে সেখানে জমি অধিগ্রহণ করে কোটি কোটি টাকা ব্যায় করে বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে তুলেছেন। মুজিবনগর বিশ্বের দরবারে এখন একটি পরিচিত নাম। দেশি পর্যটকের পাশাপাশি বিদেশি পর্যটকরা আসছেন ঐতিহাসিক মুজিবনগরে।

মুজিবনগরের নামকরণ: ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌল্লার পরাজয়ের মাধ্যমে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিলো। এর ২১৪ বছর পর পলাশীর আম্রকাননের অদূরে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা আম্রকাননে বাংলাদেশের স্বাধীনতার নতুন সূর্য উদিত হয়। অস্থায়ী মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণকালে ওই দিন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ উপস্থিত সকলের সামনে ৩০ মিনিটের এক উদ্দীপনাময় ভাষন দেন। ভাষনে তিনি বলেন, ‘আজ থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী হবে এ বৈদ্যনাথতলায় এবং এর নতুন নাম হবে মুজিবনগর’। সেই থেকেই ঐতিতহাসিক মুজিবনগর।

মুজিবনগর কমপ্লেক্সে যাযা রয়েছে: সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদ ১৯৮৮ সালের দিকে মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ, মুজিবনগর গেট ও একটি রেস্টহাউজ নির্মাণ করেন। আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর মুজিবনগরকে উপজেলা ঘোষণা ও মুজিবনগর কমপ্লেক্সের বিভিন্ন প্রকার উন্নয়নের জন্য ৫শ’ কোটি টাকার কয়েকটি কর্মসূচি গ্রহণ করেন। কমপ্লেক্সে মোট জমির পরিমাণ ৮০ একর। রয়েছে ১০৫ বিঘা জমির ওপর প্রায় সাড়ে ১১শ’টি আম গাছের বিশাল আম্রকানন। গড়ে তোলা হয়েছে- শপথ গ্রহণস্থানে স্মৃতিসৌধ, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকেন্দ্র, স্মৃতিকেন্দ্রের বাইরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চ ভাষণের মূর্তিসহ মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের মূর্তি, ৬ দফাভিত্তিক গোলাপবাগান, বঙ্গবন্ধু তোরণ, পর্যটন মোটেল, প্রশাসনিক ভবন, টেনিস মাঠ, গাড়ি পার্কিং ব্যবস্থা, শেখ হাসিনা মঞ্চ, জেলা পরিষদ ডাকবাংলো, স্বাধীনতা ক্লাব ও পাঠাগার, ডাকঘর, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, শিশু পল্লী, শপিং মল, আধুনিকমানের মসজিদ, হেলিপ্যাডসহ বিভিন্ন স্থাপনা। এছাড়াও কমপ্লেক্সর বাইরে উপজেলা পরিষদ, পিকনিক কর্ণার ও মুজিবনগর থানা রয়েছে। এর মধ্যে শপিংমল সুযোগ-সুবিধার অভাবে আজও চালু হয়নি। কমপ্লেক্সের বাইরে বেসরকারিভাবে গড়ে উঠেছে মিনি চিড়িয়াখানা।

স্মৃতিকেন্দ্রে যা যা আছে: মুজিবনগর স্মৃতিকেন্দ্রে নির্মিত গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের মানচিত্র, মুক্তিযোদ্ধাদের আবক্ষ মূর্তিকক্ষ, মিলনায়তন, প্রশাসনিক ভবন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ স্বাধীনতা যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারীদের ম্যুরাল। রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংবলিত আরো কিছু দৃষ্টি নন্দন স্থাপনা। স্মৃতিকেন্দ্রে বাংলাদেশের যে মানচিত্র নির্মাণ করা হয়েছে, সেখানে মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ স্থান ও ঘটনার নিদর্শন রয়েছে। মানচিত্রটিকে যুদ্ধকালীন সময়ের ১১টি সেক্টরে ভাগ করে মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক ঘটনা চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। মানচিত্রের বাইরে নির্মাণ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের ম্যুরাল, ২৫ মার্চের কালরাত্রির চিত্র, পাকবাহিনীর নারী নির্যাতনের চিত্র, ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের শপথ অনুষ্ঠান, ১২ আনসার কর্তৃক অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড অব অনার প্রদান ও সেক্টর বণ্টনসহ অরোরা, নিয়াজি এবং একে খন্দকারের উপস্থিতিতে পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের দৃশ্য সংবলিত ভাস্কর্য।

কিভাবে কাটবে দিন: বছরে একবারের জন্য হলেও বিনোদনের প্রত্যাশায় বাস-ট্রাক, মাইক্রোবাস, প্রাইভেট কার, মোটরসাইকেল, নসিমন, করিমন, আলগামন, আলমসাধুযোগে মুজিবনগরে আসে বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ ও শিশুরা। স্থানীয় দর্শনার্থী ছাড়াও চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, যশোর, মাগুরা, খুলনা, ফরিদপুর, পাবনা, রাজশাহী, দিনাজপুর, রংপুর, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে হাজার হাজার মানুষের ভিড় জমাচ্ছে মুজিবনগরে। ভ্রমনপিয়াসী মানুষের ভিড়ে মুখরিত মুজিবনগর কমপ্লেক্স। কমপ্লেক্সে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টরভিত্তিক বাংলাদেশের মানচিত্র, স্মৃতিসৌধ, আম্রকানন, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বিভিন্ন মূরাল, সরকারি শিশু পরিবার, শাপলা চত্বরসহ বিভিন্ন স্থাপনা ঘুরে ঘুরে দেখছে দর্শনার্থীরা। মুজিবনগরের নৈসর্গিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ এখানে আগত পর্যটকরা।

গাড়ি পার্কিঙের ব্যবস্থার পাশাপাশি খাবার রান্নার জন্য রয়েছে পিকনিক স্পট, নিরাপত্তার জন্য পাশেই রয়েছে মুজিবনগর থানা। পাশেই বিজিবি ক্যাম্প। এছাড়া মুজিবনগর কমপ্লেক্সের জন্য রয়েছে বেশ কিছু আনসার সদস্য। ভারত সীমান্তের নো-ম্যানস ল্যান্ড ও কাঁটাতারের বেড়া দেখতে নিয়ে যাওয়ার জন্য পাঁচ টাকা ভাড়ার রিকসা-ভ্যান। ভিআইপিদের জন্য রয়েছে ৩টি রেস্ট হাউজ।

দর্শনার্থীদের মন্তব্য: মাগুরা থেকে আগত নূরুজ্জামান জানান, একটি দিনের জন্য এখানে এসে ভিন্ন ধরনের আমেজ পাচ্ছি। বিনোদনের জন্য স্ব-পরিবারে ঘুরেতে এসেছি। সন্তানদের বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সেক্টরভিত্তিক মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানাতে পারছি। তবে কমপ্লেক্সেটি নকশা অনুযায়ী পরিপূর্ণতা পেলে পর্যটকের সংখ্যা আরো ব্যাপক হারে বাড়তো বলে তিনি মনে করেন।

কুষ্টিয়া দৌলতপুর থেকে আসা কলেজ শিক্ষার্থী আমিনুল ইসলাম জানান, এখানে পর্যাপ্ত টয়লেট, পানির ব্যবস্থা, বসার যায়গা না থাকায় দর্শনার্থীদের দুর্ভোগ পোয়াতে হচ্ছে। শিশুদের বিনোদনের জন্য কিছু খেলনার ব্যবস্থা রাখা জরুরি। তিনি আরো মনে করেন মুজিবনগরের নৈসর্গিক সৌন্দর্য আরো বৃদ্ধি করা দরকার।

ঈশ্বরদী থেকে আগত আমির হোসেন বলেন, মুজিবনগরে এসে বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রীসভা গঠন ও শপথের স্থান এবং মুক্তিযুদ্ধের সেক্টরভিত্তিক মানচিত্র দেখে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ছি। এটাইতো আমাদের স্বাধীনতার সূতিকাগার। এখানে এসে মুক্তিযুদ্ধের অনেক ইতিহাস জানতে পারলাম। খুব ভালো লাগছে। ছোট্ট শিশু ইতির কথা, ভালো লাগছে। তবে আমাদের খেলাধুলার কোনো সরঞ্জাম নেই; খেলতে পারছি না। তাই মন খারাপ লাগছে।

মুজিবনগরবাসীর প্রত্যাশা: মুজিবনগর উপজেলার সোনাপুর গ্রামের শিক্ষক ফিরোজ আহমেদ জানান, মুজিবনগরে ভারতের সাথে স্থলবন্দর, মুজিনগর-দর্শনা ট্রেন লাইন হওয়ার কথা রয়েছে। মেহেরপুরবাসীর দাবি মুজিবনগরভিত্তিক কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, টেকনিক্যাল কলেজসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ। এগুলো তৈরি হলে মুজিবনগরের গুরুত্ব অনেক বেড়ে যাবে। দেশ-বিদেশ থেকে প্রচুর দর্শনার্থী আসবে এখানে।

এই স্থানীয় মুজিবনগর প্রেসক্লাবের সভাপতি আলহাজ মুন্সি ওমর ফারুক প্রিন্স বলেন, প্রতিবছর শীতে মুজিবনগরে দর্শনার্থীদের পদ চারণায় ভরে ওঠে। এবার রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিরোধীদলের টানা হরতাল, সড়ক অবরোধ, যাত্রীবাহী বাসে সহিংসতাসহ নানা কারণে প্রথম দিকে দর্শনার্থীদের উপস্থিতি কম ছিলো। এ জেলার ৩ উপজেলায় নির্বাচন শেষ হয়েছে। জেলায় এ মুহূর্তে কোনো সহিংসতা নেই। তাই দিন দিন ভ্রমণপিপাসুদের উপস্থিতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটা স্বাধীনতার মাস আবার সামনে আসছে ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর দিবস। ওই সময় পর্যন্ত দর্শনার্থীদের আসা-যাওয়া থাকবে। এছাড়া সারা বছর তো কম-বেশি লোকজন আসা-যাওয়া করেনই।